আমার জীবনে ঢাকার আগারগাওয়ে রেডিও অফিসে যাওয়া ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিকতা করি। ততদিনে বেশ কিছু অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও প্রচ্ছদ কাহিনি রচনা করায় ভালো একটা পরিচিতি তৈরি হয়েছে। এই সূত্রে পরিচয় হলো বাংলাদেশ বেতারের একজন পরিচালক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান ফারুকের সঙ্গে। এসময় আমি নিয়মিত তার কাছে যেতাম আড্ডা দিতে। বয়সে আমার পিতার সমান হলেও ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন সমবয়সী বন্ধুর মতো।
একদিন আমাকে রেডিওর স্টুডিওতে নিয়ে গেলেন তিনি। অদ্ভুত একটা ঘর। বেশ ঠাণ্ডা। চারদিকে ফোমের মতো দেয়াল। মাঝখানে একটা টেবিল। উপর থেকে ঝুলছে একটা মাইক্রোফোন। এক পাশের দেয়ালের কিছুটা অংশ কাঁচের। ওপাশ থেকে কেউ একজন ইশারা দিলে, মাইক্রোফোনে কথা বললে, রেকর্ড করা শুরু হয়ে যায়।
সেদিন ফারুক ভাই আমাকে সেখানে বসিয়ে দিলেন। বললেন পরিবেশ নিয়ে কিছু কথা বলতে। বললাম। সেটা রেকর্ড করা হলো। স্টুডিও থেকে পাশের ঘরে আসতেই দেখি অনেক বড় ফিতার একটা গোল ক্যাসেটের মতো। সেটা বাজানো হলো। এই প্রথম আমি নিজের কানে নিজের কন্ঠ শুনতে পেলাম।
এটাকে বলে কথিকা। সপ্তাহে একদিন এসে কথা রেকর্ড করে যেতাম। পরের দিন রাতের বেলায় সেটা প্রচার করা হতো। সেই কথা শোনা যেতো বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। একদিন বিস্মিত হলাম এটা জেনে যে গ্রামের বাড়িতে আমার আত্মীয় স্বজনরা সপ্তাহের ওই বিশেষ দিনটিতে আমার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করে। আমি ভেবেছিলাম রেডিও কেউ শোনে না কি! কিন্তু যখন দেখলাম ইথারে ভেসে যাওয়া আমার কণ্ঠ চিনে কেউ কেউ আমার কাছে চিঠি লিখে ফেলেছেন, তখন সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাম।
এর পর তো কেবল শুরু।
চেয়েছিলাম সাংবাদিক হবো, কিন্তু বেতার সাংবাদিক হবো সেটা কোনোদিন ভাবিনি। অথচ এর পর হঠাত করেই বদলে গেলো জীবন। দেশ ছেড়ে পাড়ি দিলাম জার্মানিতে। ডয়েচে ভেলের কোলন স্টুডিওতে বসে কথা বলতাম, সেই কথা ছড়িয়ে পড়তো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে।
ডয়েচে ভেলেতে পাঁচ বছর কাজ করার পর ফিরে গেলাম স্বদেশে। আবার ফেরা হলো প্রিন্ট মিডিয়াতে। কিন্তু সেই ফেরা স্থায়ী হলো না। মাইক্রোফোনের প্রতি ততদিনে আমার যে তীব্র ভালোবাসা তৈরি হয়ে গেছে তা আমাকে টেনে নিয়ে এলো লন্ডনের বিবিসি স্টুডিওতে।
এর পরে তো কতো কাহিনি, কতো ঘটনা।
এক এক করে কেটে গেলো ১৭ বছর। এতো দীর্ঘ সময় জীবনে আর কোথাও কাজ করিনি। কখনও করাও হবে না। পেছনে ফিরে তাকালে দেখি এই সময়ে আমি কতো ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছি। অজস্র ঘটনা প্রবাহ, অসংখ্য মানুষের সাক্ষাৎকার। আমার মনে হয় এমন কেউ নেই যার সাক্ষাৎকার আমি নেই নি। একেকটি সাক্ষাৎকারের পেছনে আছে কতো না বলা গল্প। সেসব লিখলে একটি মাত্র গ্রন্থে তার সংকুলান হবে না।
আজ আমার এই দীর্ঘ রেডিও জীবনের অবসান হতে যাচ্ছে। ৮১ বছর পর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বিবিসি বাংলার রেডিও সম্প্রচার। এই ৮১ বছরের মধ্যে আমি নিজেই ১৭ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলাম।
আমার রেডিও জীবনে অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। এই ভালোবাসা কেমন সেটা এখানে লিখে বোঝানোর মতো ভাষা আমার নেই। সেটা প্রকাশে আমি পুরোপুরি অক্ষম। মনে পড়ে একজন শ্রোতার চিঠি। তিনি লিখেছিলেন - যেদিন রাতে তিনি আমার অনুষ্ঠান মিস করতেন, সেদিন তিনি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তেন। এমন ভালোবাসার প্রতিদান দেয়া কি সম্ভব?
যারা এতদিন আমার সঙ্গে ছিলেন, আমাকে শুনেছেন, আমার ভুল ভ্রান্তি উপেক্ষা করেছেন, উৎসাহ যুগিয়ে গেছেন, তাদের প্রতি রইলো অফুরন্ত ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা
আজ আমার এই দীর্ঘ রেডিও জীবনের অবসান হতে যাচ্ছে-- মিজানুর রহমান খান
প্রকাশিত: ০৮ জানুয়ারী, ২০২৪, ০২:২৪ পিএম

সারাবাংলা রিলেটেড নিউজ
.jpeg)
Bangladesh officially accedes to the International Convention for Protection of All Persons from Enforced Disappearance

অনন্তযাত্রায় একজন আলী ইমাম এবং একটি খাটিয়ার গল্প--- লুৎফর রহমান রিটন

ভিওএ ফ্যান ক্লাবের পথিকৃৎ সৈয়দ আসাদুজ্জামান বাচ্চু এবং আবদুল হাই খানের উপর বিশেষ স্মৃতিচারণ আলোচনা সভা

বিটিভি ভবনে ভয়াবহ আগুন, সম্প্রচার বন্ধ
.jpg)
নওগাঁ শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্বরণে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন

বগুড়ায় শব্দ কথন সাহিত্য আসরের কবিতা পাঠ অনুষ্ঠিত

যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ থেকে আইরীন পারভীনের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত

বঙ্গবন্ধু আন্তঃ জেলা ফুটবল টুর্ণামেন্টের উদ্বোধন