আজ ১১ অক্টোবর ২০২২,বিবিসি বাংলা সম্প্রচারের ৮১ বছর পূর্ণ হলো। ভেবেছিলাম বিবিসি বাংলা সম্প্রচার হয়তো শতবর্ষ পূর্ণ করেও টিকে থাকবে। সে সময় অনেক বড় করে শ্রোতা সম্মেলন হবে, আমি হয়তো থাকবো না এই নশ্বর পৃথিবীতে, তবুও সে সময়ের শ্রোতারা দারুণভাবে উপভোগ করবে সে অনুষ্ঠান। কিন্তু না ৮১ বছর পরে অবশেষে বিবিসি বাংলা বেতার অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এর মধ্যে।

বিদেশী বেতারে বাংলা অনুষ্ঠান প্রথম শুরু করে বিবিসি। ১৯৪১ সালের ১১ অক্টোবর বিবিসি থেকে বাংলা বেতার অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়েছিলো। সপ্তাহে মাত্র ১৫ মিনিটের বাংলা অনুষ্ঠান। বাংলা ভাষীদের কাছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের খবর পৌঁছে দিতে বৃটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের এই উদ্যোগ। তখন রেডিও এত সহজলভ্য ছিলো না। তাই কতজন বাংলাভাষীর কাছে সে অনুষ্ঠান পৌঁছাতো তা কোথাও লেখা নেই।

আমার বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শোনার বয়স প্রায় ছাপ্পান্ন বছর হয়ে গেলো। মনে আছে ১৯৬৬ সালের কথা। বাসায় একটা বিদ্যুৎ চালিত মার্ফি রেডিও ছিলো। সেদিন বোনের বিয়ে উপলক্ষে অনেক আত্মীয় স্বজনরা এসেছিলেন। আমার এক বড় ভাই রেডিওতে রাতের বেলা বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শোনার চেষ্টা করে পেয়ে গেলেন। শুনতে পেলাম এক সময়ের বহুল পরিচিত একটা গানের সুর, যা সিগনেচার টিউন ছিলো, আমিও শুনছিলাম। একটা ঘোষণা আমার কিশোর মনে দাগ কেটে গেলো। সেতুর উপর বৃটিশ ডাক বিভাগ কিছু ডাকটিকেট প্রকাশ করেছে যার কিছু বাংলা অনুষ্ঠানের আগ্রহী শ্রোতাদের দেওয়া হবে। ডাকটিকেট চেয়ে আমিও একটা চিঠি লিখলাম। কিছুদিন পরে ডাকযোগে আমার চিঠির উত্তর কবে দেওয়া হবে সেটা জানিয়ে ডাকটিকেট লাগানো একটা নীল খামে লন্ডন থেকে চিঠি পেলাম। আর নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠানে আমার নাম ঠিকানা ও অনুষ্ঠান সম্পর্কে আমার লেখা চিঠির কিছু অংশ শুনে ভীষণ খুশী হয়েছিলাম।

সেই থেকে শুরু, বিবিসিকে নিয়ে আরো অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ষাটের দশকে কি আগ্রহ নিয়ে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শুনতাম। শুরুতে সপ্তাহে তিনদিন ম্যাগাজিন ধরনের পাঁচমিশালি অনুষ্ঠান হতো। শনিবার ভারতীয় শ্রোতাদের জন্য 'বিচিত্রা' বুধবার পূর্ব পাকিস্তানের শ্রোতাদের জন্য "আঞ্জুমান" পরে নতুন নামকরণ নিয়ে 'দিগন্ত' আর সোমবারের অনুষ্ঠানটি উভয় বাংলার জন্য 'সোমবারের আসর' নামে প্রচার হতো। যা পরবর্তীতে এক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে 'বাতায়ন' নামকরণ করা হয়। প্রচার সময় ছিলো আমাদের দেশে দুপুর সাড়ে তিনটা, সেদিনই ভূমধ্যসাগরীয় রিলে কেন্দ্র থেকে পুনঃপ্রচার আমাদের সময় রাত পৌনে দশটা থেকে সোয়া দশটা। প্রবাসী বাঙালিদের সাক্ষাৎকার ভিত্তিক অনুষ্ঠান ছিলো দিগন্তে 'সাগর পারের বাণী' আর বিচিত্রা অনুষ্ঠানে ছিলো 'সেতুবন্ধন'। সাগর পারের বাণী অনুষ্ঠানের সিগনেচার টিউন ছিলো একটা গান, "সাগর পারে নোঙর বাঁধা আমি........"। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা জানতে পারতাম লন্ডন প্রবাসী বাঙালী দের জীবনের কথা। আর একটা অনুষ্ঠান আমাকে আকৃষ্ট করেছিলো সেটা হচ্ছে "তরুণ উদ্ভাবক ক্লাব" যেখানে বিজ্ঞানের নতুন আবিষ্কার আর এ সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপন করা হতো।

এর মাঝেই শুরু হয় সকাল সাড়ে ছয়টায় বিশ্বসংবাদ সম্প্রচার আর সংবাদ পর্যালোচনা, সপ্তাহে একদিন পশ্চিমা গানের অনুষ্ঠান 'পপ এক্সপ্রেস'। তারপর অনেক বিবর্তন হয় বিবিসির বাংলা বিভাগের বেতার সম্প্রচারে। সপ্তাহের তিনটা অনুষ্ঠানের পাশাপাশি প্রতিদিন সন্ধ্যায় সংবাদ ভিত্তিক বাংলা অনুষ্ঠান সংযোজিত হয়।সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানের অনেক কিছুই সংযোজিত হয় সান্ধ্য অধিবেশনে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বিবিসির বাংলা বেতার অনুষ্ঠানের গুরুত্ব বাঙালিদের কাছে সত্য খবর এর উৎস হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়ে শ্রোতাদের আগ্রহের কারণে সান্ধ্য অধিবেশন ৪৫ মিনিট হয়ে যায়। মনে পড়ে বিবিসি বাংলা বিভাগ আয়োজিত একটা রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হয়েছিলাম। বিজয়ী হিসেবে আমার নাম ঠিকানা ১৯৭১ সালের মার্চ এপ্রিলে সান্ধ্য অনুষ্ঠানে বেশ কিছুদিন ঘোষণা হয়েছিলো। যদিও পুরষ্কারটি পেয়েছিলাম ১৯৭২ এর শেষে। তখন ছিলো এক সংকটময় পরিস্থিতি।

বিবিসি বাংলা বিভাগ ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত একটা বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতো। অনুষ্ঠানটির নাম ছিলো "সেতুবন্ধন সাগর পারের বাণী", এই অনুষ্ঠানে পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের সাথে তাদের নিকটজন দের যোগাযোগ করিয়ে দেবার উদোগ নিয়েছিলো বিবিসি বাংলা। এটা ছিলো একটা বিশেষ অবস্থায় মানবিক উদ্যোগ। আর কোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে এই রকম মানবিক সহায়তার সুযোগ বিবিসি বাংলা বিভাগের কাছে আসবে কি না জানা নেই।

প্রায় ছাপ্পান্ন বছরের বেশী সময় ধরে যে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান আমাকে আকৃষ্ট করে আসছে, তা আর শুনতে পাবো না ভাবতেই কেমন যেনো অবিশ্বাস্য লাগছে। একে একে বিভিন্ন বেতারের অনুষ্ঠান বন্ধ হতে দেখে মনে হচ্ছে সত্যিই কি রেডিওর দিন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে? গ্রামোফোনের মতো রেডিও কি এন্টিক হিসেবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে গণ্য হবে?

মনে পড়ছে ২০১৬ সালের কথা। বিবিসি বাংলা সম্প্রচারের ৭৫ বছর পূর্তি খুব সাড়ম্বরে পালন করেছিলো বিবিসি নিউজ বাংলা। সে সময়ে 'বিবিসি প্রবাহ' টেলিভিশন অনুষ্ঠান, ১১ অক্টোবর এর প্রত্যুষা ও প্রভাতীতে আমার সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়েছিলো। পরে খুলনায় অনুষ্ঠিত শ্রোতা সম্মেলনে ফেসবুক লাইভেও আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো। এ সবই স্মৃতি হয়ে থাকবে আমৃত্যু।

এক দীর্ঘ সময় ধরে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শুনে আসছিলাম। সেই সকাল সাড়ে ছয়টার আগে ঘুম ভেঙে যাওয়ার অভ্যাস বদলাতে পারিনি।

বুঝতে পারছি সারা বিশ্বে এক সংকটময় মূহুর্তে বিবিসি থেকে বাংলা সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় বেতার অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছে। এক সংকটময় সময়ে বিবিসিতে বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয়েছিলো, আসন্ন আর এক সংকটময় সময়ে বিবিসির বাংলা বেতার অনুষ্ঠান হারিয়ে যাবে।

বিবিসিকে নিয়ে আরো অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ১৯৮৩ সালে ঢাকায় আমরা কয়েকজন বন্ধু আয়োজন করি বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠানের ৪২ বছর পূর্তি অনুষ্ঠান। হোটেল পূর্বাণীতে অনুষ্ঠিত সে অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সে সময়ের বিশিষ্ট সাংবাদিক তখনকার বাসস এর সভাপতি জনাব গিয়াস কামাল চৌধুরী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সে সময়ের বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রী সৈয়দ নাজমুদ্দিন হাশিম। বিশেষ অতিথি ছিলেন ইংরেজি দৈনিক অবজারভার সম্পাদক জনাব ওবায়দুল হক, ঢাকাস্থ বৃটিশ রাষ্ট্রদূত ফ্রাঙ্ক মিলস ও বিবিসি বাংলা বিভাগের জনপ্রিয় প্রযোজক সিরাজুর রহমান। অনুষ্ঠানে এসেছিলেন অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ শহীদ জননী জাহানারা ইমাম,টিভি ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানী, বিবিসি বাংলার ঢাকা সংবাদদাতা সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। বিটিভি অনুষ্ঠানটি ক্যামেরাবন্দী করলেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তা আর প্রচার হয়নি। এ উপলক্ষে আকবর হায়দার কিরন এর সম্পাদনায় একটা স্মরণিকা প্রকাশ করা হয়েছিলো। আমার কাছে মনে হয়েছে বিবিসি বাংলা বিভাগের শ্রোতাদের আয়োজিত এ অনুষ্ঠানটি ছিলো এযাবৎকালের সব চাইতে বড় অনুষ্ঠান।

কয়েকদিন আগে বিবিসি বাংলার সান্ধ্য অধিবেশনে বিবিসির বাংলা বেতার সম্প্রচার বিষয়ে শ্রোতাদের স্মৃতিচারণ মূলক ফোনইন শুনলাম। সব শ্রোতার মধ্যেই হতাশা রয়েছে মনে হলো। প্রথমেই যে শ্রোতা কথা বললেন তিনি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তাঁর কষ্ট নিশ্চয়ই অনেক বেশী। আমার মতো মানুষ যাদের চোখের সমস্যা রয়েছে তাদের কাছেও কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনে বেশী সময় ধরে দেখায় বিধিনিষেধ থাকায় আমার কাছেও বিবিসির ওয়েবসাইট দেখা হয়তো সম্ভব হবে না।

আগামী কয়েক মাস পরেই হারিয়ে যাবে বিবিসির বাংলা বেতার সম্প্রচার। কোনো রকম খরচ ছাড়াই একটা রেডিওতে সঠিক খবরের জন্য যেভাবে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান শোনা যায় তা আর হবে না। পয়সা খরচ করে ওয়েবসাইট ঘেটে বিবিসির কাছ থেকে আমাদের খবর পেতে হবে। নতুন প্রজন্ম হয়তো এটার সাথে খাপ খাওয়াতে পারবে, আমাদের মতো বৃদ্ধ মানুষ ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে বিবিসি সোনার হরিণ হয়ে যাবে। কারণ এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের ইন্টারনেট সেবার খরচ অনেক বেশী আর ব্যাপ্তি সীমিত।

বিবিসি বাংলা বিভাগ হয়তো আগামী বছর ১১ অক্টোবর ৮২ বছর পূর্তি পালন করবে। তা হয়তো শুধুমাত্র ওয়েবসাইট ভিত্তিক হবে। শ্রোতা নয় ওয়েবসাইট দর্শক/পাঠক গণই সেই দিন চিঠি লিখবে বিবিসিতে।

স্মৃতি সব সময় কখনও হাসি আনন্দের কখনও বেদনার। নিজের এই বৃদ্ধ বয়সে শুধু স্মৃতি নিয়েই আগামী দিনগুলো কেটে যাবে হয়তো।

হারিয়ে যাবে বিবিসির বাংলা বেতার সম্প্রচার। এত দীর্ঘ সময় আর কোনো বিদেশী বেতার কেন্দ্র বাংলা অনুষ্ঠান প্রচার করেনি। বিবিসি দীর্ঘ সময় ধরে বাংলা বেতার অনুষ্ঠান সম্প্রচারের কৃতিত্ব নিতেই পারে। দুঃখ এখানেই যে এমন সময় বিবিসির বাংলা বেতার অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যখন বাংলাদেশের শ্রোতাদের কাছে সঠিক সংবাদের প্রয়োজন সব চাইতে বেশী। আগামী ২০২৩ সাল এক সংকটময় বছর হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। আর সে সময়েই বিবিসির বাংলা বেতার সম্প্রচার থাকবে না।

ছবিতে ১)১৯৬৭ সালে বিবিসি বাংলা বিভাগ, ২)১৯৮৩ সালে বিবিসি বাংলা অনুষ্ঠানের ৪২ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্মরণিকার প্রচ্ছদ ৩) স্মরণিকায় বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রযোজক সিরাজুর রহমানের বাণী ৪) ২০১৬ সালে বিবিসি বাংলার ৭৫ তম বার্ষিকী উপলক্ষে শ্রোতা সম্মেলনে সম্পাদক সাবির মুস্তাফার সাথে আমি ও ঢাকার শ্রোতা এস আলম ৫) ১৯৭০ সালে রচনা প্রতিযোগিতার পুরষ্কার ডক্টর ক্রিস্টিয়ান বার্ণার্ড এর লেখা বই ও ৬)উক্ত পুরষ্কার এর ভিতরে বিবিসির সিরাজুর রহমান এর স্বাক্ষরিত স্বীকৃতি ও ডক্টর ক্রিস্টিয়ান বার্ণার্ড এর অটোগ্রাফ।