আমাদের সময়ে চটুল একটা গান মুখে মুখে ফিরতো- ‘আমি রাজ্জাক কেন হইলাম না, মনের মতো কবরী পাইলাম না।’ কথা শুনে মনে হয়- যেন, চাইলেই রাজ্জাক কবরী হওয়া যায় আর কী !
কিংবা নায়কোচিত দর্শনের একজন ব্যক্তিকে অন্য একজন টিপ্পনি কেটে বলতেন- ‘রাজ্জাক রাজ্জাক ভাব, কবরীর অভাব!’ এখানেও সেই একই কথাই প্রযোজ্য (চাইলেই কবরী পাওয়া যায় না)!
ষাটের দশক এবং সত্তর দশক জুড়ে ‘রাজ্জাক-কবরী জুটি’ আমাদের এই জনপদে জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে গিয়েছিল। এর পরের দশকগুলোতে তাদের বয়োবৃদ্ধির ফলে- দৃশ্যমান দৈহিক গ্ল্যামার কিছুটা ধুসর মনে হলেও জনপ্রিয়তায় তেমন কোন ফাটল ধরেনি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত দু’জনই সমান জনপ্রিয় ছিলেন বাংলাদেশে।
করোনা আক্রান্ত কবরী আপার মৃত্যু সংবাদটি পেয়েছিলাম সংবাদ উপস্থাপক নজরুল কবীরের কাছ থেকে। গভীর রাতে তিনি যখন আমাকে টেলিফোনে কবরী আপার খবরটি জানাচ্ছিলেন- তখোন তিনি কান্না সংবরন করতে পারেন নি। পাশাপাশি আমিও কেঁদেছিলাম প্রায় অঝোরেই! এর অনেক আগে রাজ্জাকের মৃত্যুতেও কেঁদেছি আমি- আপন কাওকে হারানোর মতো বেদনায়! দীর্ঘদিন এতটা কান্না করি নি!
আমাদের কিশোর বয়স থেকে যৌবনের অনেকদূর পর্যন্ত আমাদের মানস গঠনে- ‘ষাটের দশকের’ চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্র ‘পারফরমারদের’ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে! তাঁরা আমাদের কাছে 'আইকন' ছিলেন।
তবে, আজ যেভাবে কেউ একজন বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যদু’জন কিংবদন্তী- ‘উত্তম সুচিত্রার’ কথা অনায়াসে বলতে পারেন- আমাদের বয়সে সেটা সম্ভব ছিলনা! কারন, প্রথমত- উত্তম সুচিত্রার ছবি খুব সুলভে আমরা দেখতে পাইনি সেই সময়ে। ‘পাক ভারত বৈরীতা' তার অন্যতম কারন। সে কারনে ভারতের চলচ্চিত্র আমাদের পূর্ব বাংলায় প্রদর্শন নিষিদ্ধ ছিল!
পক্ষান্তরে, পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবিগুলো কৌশলে আমাদের গলধকরণ করানো হয়েছিল সেই সময়ে! এতে অবশ্য পাকিস্তানিদের দু’টি লাভ হয়েছে। এক. তাদের উর্দু চলচ্চিত্র আমাদের পূর্ব বাংলা থেকে প্রচুর অর্থ আয় করেছে। দুই. অন্যদিকে পাকিস্তানি সংস্কৃতি ‘পুশ’ করেছে আমাদের মধ্যে খুব সুকৌশলে!
তখোন আমাদের বাংলা চলচ্চিত্র একেবারেই যে নির্মিত হচ্ছিলনা- তেমনটি নিশ্চই নয়! কিন্তু, আমাদের নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্রের সংখ্যা ছিল একেবারেই অপ্রতুল! তার ওপরে উর্দু ছবির আগ্রাসনে বাংলা ছবির নির্মাতা এবং প্রযোজকরা হিমশিম খাচ্ছিলেন!
ষাটের দশকে বাংলা ছবির ভাগ্য ফেরালো তো- ‘রূপবান’ ছবিটি! বাংলার লোকজ কাহিনীকে সম্বল করে সালাউদ্দিন সাহেব বাংলা ছবির মোড় ঘুরিয়ে দিলেন ১৯৬৫ সালে।
‘রূপবান’-এর ব্যবসায়িক সাফল্য আমাদের বাঙালি নির্মাতাদের সাহসী করে তুললো। তাঁরা ধুমিয়ে লোকজ সব কাহিনী নিয়ে ছবি নির্মাণ করতে শুরু করলেন সেই থেকে।
সেই সময়েই (১৯৬৬) নির্মিত হলো-
‘বেহুলা’ ‘আবার বনবাসে রূপবান’ ‘গুনাই বিবি’ ‘আপন দুলাল’ ‘মহুয়া’ ‘রাজা সন্ন্যাসী’ ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী’ ‘জরিনা সুন্দরী’ ‘রহিম বাদশা ও রূপবান’- ধরণের ছবিগুলো।
অথচ এরপূর্বে আমাদের জহির রায়হানকেও এক সময় পশ্চিম পাকিস্তানি পরিচালক এ. জে. কারদারের সহকারি হিসেবে কাজ করতে হয়েছে বেশকিছুদিন। সেই ‘উর্দু’ ছবির জোয়ারে স্বয়ং জহির রায়হানকেও ব্যবসার জন্য নির্মাণ করতে হয়েছে- ‘বাহানা’ (১৯৬৫) কিংবা ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪)-এর মত উর্দু ছবি! ‘রূপবান’-এর ব্যবসায়িক সাফল্যের পর জহির রায়হানও লোকজ কাহিনীর ছবি ‘বেহুলা’ (১৯৬৬) নির্মাণ করেন নতুন উদ্যমে।
নতুন প্রজন্মের জন্য জানিয়ে রাখা ভালো- শেখ মুজিবুর রহমান (তিনি তখোনও বঙ্গবন্ধু অভিধায় ভূষিত হন নি) যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী থাকাকালে তিনিই ঢাকার ‘ফিল্ম ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন (এফডিসি)' প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ে যুক্তফ্রন্ট কালের আইনটি (এফডিসি প্রতিষ্ঠা বিষয়ক) ১৯ জুন, ১৯৫৭ থেকে কার্যকর হয়।
এফডিসি প্রতিষ্ঠিত হলেও-
১৯৫৭ এবং '৫৮ সালে বাংলাদেশে কোনও চলচ্চিত্র মুক্তি পায়নি। ১৯৫৯ সাল থেকে এফডিসি থেকে চলচ্চিত্র নির্মিত হতে থাকে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের প্রথম চেয়ারম্যান এবং নির্বাহী পরিচালক ছিলেন যথাক্রমে আবুল খায়ের (১৯৫৭-৫৮) এবং নাজির আহমেদ (১৯৫৭-৬২)। তথ্যসূত্র- ইন্টারনেট।
ওই তথ্য-সূত্রটি বলছে-
ঢাকাই চলচ্চিত্রের ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মোট ২২৪ টি ছায়াছবি ঢাকায় তৈরি হয়েছে। দুইটি ছায়াছবি ছিল পরিত্যক্ত। ২২৪ টি ছায়াছবির মধ্যে ৫৯ টি ছায়াছবি উর্দু ভাষায় নির্মিত, বাকি ১৬৫ টি ছায়াছবি বাংলা ভাষায় নির্মিত হয়েছিল।
আশ্চর্যজনক আরেকটি তথ্য হচ্ছে-
দেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে, ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় আরও ১৮টি ছায়াছবি নির্মিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে।
বন্ধুগণ, লক্ষ্য করুন- ‘১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায়’ আবারো ছবি নির্মিত হয়! চমকপ্রদ বিষয় বটে!...... ‘হুর-এ-আরব’ ‘আবে হায়াত’ ‘বানজারান’ ধরণের ছবিগুলো কবে নির্মিত হয়েছিল সেটা আমাদের মনে আছে নিশ্চই। থাক আপাতত! ওসব নিয়ে আজ আর কথা বলবো না।
ফিরে আসি আমাদের রাজ্জাক কবরীতে। ষাটের দশকে রাজ্জাক কবরী অভিনীত অনেক ছবি অন্য কারো মনে দাগ না কাটলেও আমার মনে গভীর দাগ (ইতিবাচক অর্থে) তৈরি করেছে। যেমন ধরুন- ‘আবির্ভাব’ 'নীল আকাশের নীচে’ ‘দর্পচূর্ণ’ ‘দীপ নেভে নাই’- ধরণের অনেক ছবি।
রাজ্জাক এবং কবরী অভিনীত চরিত্রগুলোর যে বিষয়টি আমাকে মনের অজান্তেই খুব টেনেছিল- তা হলো তাদের অতি সাধারণ বাঙালিয়ানা। তাদের দু’জনের পোষাক-আসাক, চলন-বলন-কথন, খুনসুটি, প্রেম-অভিমান বিরহ কিংবা মিলনের আনন্দের যে অভিব্যক্তি- সেগুলো ছিল আমার চৌদ্দ পুরুষের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার নন্দিত প্রকাশ। এতে কোন ‘টোনাল জার্ক’ নেই। কোথাও আমাকে ধাক্কার মুখোমুখি হতে হয়নি।
তাদের অভিনয়ের ‘চলন’টি ছিল আমাদের যাপিত জীবনের রোজকার আটপৌরে ধাঁচের। ফলে, তাদের সাথে দর্শকদের মিশে যেতে কোন কষ্ট হয়নি; বরং আনন্দের সাথে বয়ে গিয়েছিল তাদের অভিনয়ের স্রোতধারায়। এই বিষয়টি সত্যিই অনবদ্য বটে।
শুরুতে যেই ছড়া বা চটুল গানটির কথা বলেছিলাম - 'কেনো রাজ্জাক হইলাম না, মনের মত কবরী পাইলাম না'! বন্ধুগণ লক্ষ্য করুন- গানটিতে মূল আরাধনা কিন্তু খোদ 'কবরীকে' পাওয়া নয়, বরং কবরীর মতো একজন নারীকে পাওয়ার আকাংখাই বাঙময় হয়ে উঠেছে ছড়াটিতে।
অর্থাৎ, একটু আগে যে বললাম- রাজ্জাক কবরী অভিনীত চরিত্রগুলোর আটপৌরে বাঙালিয়ানার কথা- সেই 'বাঙালিয়ানা'কেই বাস্তব জীবনে খুঁজেছে একজন ষাটের দশকের যুবক- তার আরাধ্য নারীর মাঝে! এখানটাতেই 'রাজ্জাক-কবরী আইকন' 'কালের' একটি আরাধ্য উপাদানে পরিণত হয়েছিল! বিষয়টি অত্যন্ত চমকপ্রদ! আজ নতুন করে ভেবে দেখার মতো বটে!
আজকালের চলচ্চিত্রাভিনেতাদের অভিনয় দেখে কোথায় যেনো খটকা লাগে (অল্প ব্যতিক্রম বাদে)। মনে হয় যেন ‘এ আমার নয়’! মার্জনা করবেন যদি ভুল বলে থাকি। থাক, আজ আর বেশী্দূর যাবো না।
রাজ্জাক কবরী যেখানেই থাকুন- অনেক ভালো থাকুন সেখানে। মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁদের প্রতি সদয় হবেন।
রাজ্জাক কবরীর এই ছবিটি বন্ধু আশিকুর রহমানের পোস্ট থেকে নিয়েছি। অনেক ধন্যবাদ আশিক ভাই।