আটটি জাতীয় দিবস বাতিল করেছে সরকার। এর মধ্যে ৭ই মার্চও রয়েছে। ১৯৭১ সনের ৭ই মার্চে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০২০ সনের ডিসেম্বরে দিবসটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০২১ সাল থেকে দিবসটি সরকারিভাবে পালন করা হয়। এই দিবসটি বাতিলের সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ বলছেন, ঐতিহাসিক এই দিনটি নিয়ে বিতর্ক না করাই ভালো। আবার কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ কয়েক দফা ক্ষমতায় ছিল। তারা শুরুতে এ দিবস নিয়ে কিছু করেনি। যখন স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ চালাচ্ছিল তখন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। যে সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয় সেটি দেশের মানুষের দ্বারা নির্বাচিত ছিল না। তাই ওই সিদ্ধান্ত বাতিল যৌক্তিক। এমন যৌক্তিকতা থেকেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফে বলা হয়েছে।  

এ বিষয়ে বুধবার সচিবালয়ে কথা বলেন- অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক মনে করে না। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে ক্ষমতায় ছিল। মানুষের ভোটাধিকার হরণ ও গুম-খুন করে এবং গণহত্যা করে তারা ক্ষমতায় ছিল। কাজেই কারা তাকে জাতির পিতা বললো, তারা কোন দিবসকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করলো, নতুন বাংলাদেশে সেটার ধারাবাহিকতা থাকবে না। আমরা বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করতে চাচ্ছি। ফলে ইতিহাসের প্রতি আমাদের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আনতে হবে। তিনি বলেন, যেসব জাতীয় দিবস বাতিল করা হচ্ছে, সেগুলো চাপিয়ে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ফ্যাসিস্ট আচরণ ছিল সেটা। সরকার মনে করেছে, সেগুলো গুরুত্বহীন, তাই বাতিল করা হচ্ছে।  কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম বলেন, ঐতিহাসিক অনেককিছুই রয়েছে।

এগুলো নিয়ে এসব করা ভালো না। ৭ই মার্চ না থাকলে আমাদের অনেক কিছুই থাকে না। দিবসটি কারও ব্যক্তিগত না। এটা পুরো জাতির। এটা করা ঠিক না। তবে ভিন্ন কথা বলেন- বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমার মনে হয় ঠিকই আছে। এদিন এমন কিছু হয় নাই। এটা নিয়ে একটা পলিটিক্যাল প্রোপাগান্ডা আছে। এদিন স্বাধীনতার ঘোষণাও দেয়া হয় নাই। এটা ছিল রুটিন মিটিং। শেখ সাহেব (শেখ মুজিবুর রহমান) চারটি দাবি দিয়েছিলেন। এরমধ্যে অন্যতম সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে, জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। অর্থাৎ পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই পদক্ষেপগুলো নিতে বলেছিলেন। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিল কিন্তু জাতীয় দিবস হওয়ার কোনো দিন হতে পারে বলে মনে হয় না।   তিনি আরও বলেন, এই দলতো (আওয়ামী লীগ) স্বাধীনতাও চায়নি। পরবর্তীতে ক্র্যাকডাউনের ফলেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নামতে হয়েছিল। পরবর্তীতে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয়। মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, এগুলো হচ্ছে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

আমি আবার বলবো, ৭ই মার্চ জনসমাগম হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে কিন্তু জাতীয় দিবস হওয়ার মতো কোনো দিন বলে আমার কাছে মনে হয় না।  বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মানবজমিনকে বলেন, ৭ই মার্চ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অন্যান্য দিবসের মতো এ দিবসটিও আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ ওই দিনটিতে বঙ্গবন্ধু কী ভাষণ দেবেন তা দেশ-বিদেশে সবার কাছে বেশ গুরুত্ব ছিল। তাই এ দিবসকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। সরকার কী করলো, না করলো- তাতে এ দিবসটির তাৎপর্য মলিন হবে না। আমাদের ইতিহাসে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মনি সিংহ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ অনেকের অবদান আছে। কমিউনিস্টরাও আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছে। যেগুলো সেভাবে তুলে ধরা হয় না। তাই এ দিবসটি বাতিল করা যুক্তিহীন একটা সিদ্ধান্ত।

কেউ চাইলে ইতিহাসকে বিকৃত করতে পারে না, কেবল ইতিহাসের ভাষণকে বিকৃত করতে পারে। সরকারের আরও অনেক বিষয় আছে সেগুলোতে মনোনিবেশ করা উচিত বলে মনে করি।   সরকারি এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ ফেসবুকে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় লিখেন-  ৭ই মার্চ আওয়ামী লীগের দলীয় দিবস নয়, এইদিনের ঐতিহাসিক বক্তৃতাও শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত নয়। সারা দেশের, সকল স্তরের মানুষের, প্রায় সব দল-মত সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ অনুপ্রাণিত উদ্দীপ্ত চৈতন্যের প্রকাশই ঘটেছিল এইদিনে। মুজিবের বক্তৃতার শক্তিও তৈরি হয়েছিল জনগণের অসাধারণ উত্থানের শক্তি থেকে। প্রকৃতপক্ষে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল এই দিনেই। ৭ই মার্চ অবশ্যই আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শেখ মুজিব রাজনৈতিক চরিত্র, তার সমালোচনা- পর্যালোচনা অবশ্যই হবে কিন্তু ইতিহাস মোছার চেষ্টা চলবে না।