এই প্রবন্ধে বা রম্যরচনায় আমি মিথ্যা আর সত্য কথনের উপর ব্যাক্তিগত ইচ্ছার প্রতিফলন সম্বন্ধে বলতে বসেছি।  তবে বিষয়ের গভীরে যাওয়ার আগে আমি সহানুভুতিশীল পাঠিকাদের এবং পাঠকদের কাছে পরিষ্কার করে বলছি, সত্যি করেই বলছি – আমার এ লেখাটি কি আদৌ প্রবন্ধ না নিবন্ধ সে সম্বন্ধে আমার নিজেরই কোন ধারনা নেই। ​ এটাকে রম্যরচনা বলা যায়, না সন্দেহাতীত ভাবে অরম্যরচনা বলেই সবাই একে নেবে কিনা তাও জানিনা।  যাহোক কোন বিভাগে পড়লো এ লেখা সেটা আমার মাথা ব্যাথা নয়, আমার মাথা ব্যাথা সেই প্রতিজ্ঞাকে রক্ষা করা – ‘যাহা বলিবো মিথ্যা বলিবো’। ​ ইংরেজীতে একটা অপ্রচলিত কথা আছে, ‘If you are honest, just because you know that honesty is the best policy, than you are already dishonest’. এর মোটা অর্থ সবাই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আমি যে তাৎপর্য খুঁজে বের করেছি এ উক্তি থেকে, সেটা হলো, ‘উদ্দেশ্য প্রনোদিত সততা মূল্যহীন’। একটু সাদামাটা ভাষায় বলা চলে – উদ্দেশ্য প্রনোদিত সত্য-কথন কোন অংশেই মিথ্যের চেয়ে মহত্ত্বর কিছু নয়।

চলুন আমরা আরো খানিকটা  এগিয়ে যাই এবং আরো সুস্পষ্ট কিছু মর্ম আলোতে আনতে চেষ্টা করি। যদি উদ্দেশ্য প্রনোদিত সত্য এবং মিথ্যার মাঝে কোন তফাৎই রইলনা, তবে কেন এত ঘটা করে আবার সত্য বলা, সত্য কথনের উপর ভারিক্কি আলোচনা, আর কেন আদালতের সেই প্রতিজ্ঞা – ‘যাহা বলিবো সত্য বলিবো’? ​ সত্য বলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে সত্যি করে বলছি, আমি আর বেশী দূর এগোতে চাই না, কেননা সে সত্য নাকি মিথ্যারই নামান্তর!  তবে শ্রদ্ধেয় পাঠকবৃন্দের কাছে হাতজোড়ে বলছি, আগাগোড়া মিথ্যা বলবো না। সত্যের সাথে মিথ্যের অংশবিশেষ জুড়ে দেবো। আর তাছাড়া সে মিথ্যাকে ইচ্ছে করলেই আপনারা সত্য হিসেবে ভেবে নিতে পারেন। যদি উদ্দেশ্য প্রনোদিত সত্য-ভাষন মিথ্যেরই নামান্তর হয়, উদ্দেশ্য সম্বলিত দু’একটা প্রাসঙ্গিক মিথ্যাকেও ইচ্ছে করলে আপনারা সত্য হিসেবে বিচার করতে পারেন। তদুপরি, সে মিথ্যার সাহচর্য দিতে রয়েছে অজস্র নির্ভেজাল সত্য।

আসুন দেখতে চেষ্টা করি, প্রতিজ্ঞাহীন-সত্য আর উদ্দেশ্য সম্বলিত প্রাসঙ্গিক মিথ্যার মাঝে  কোন তেলে-জলে সম্পর্ক রয়েছে কিনা! দুধ এবং জল যে ভাবে  একাকত্ত্বতা ঘোষনা করে, তাই এই রাজধানীতে জলোদুধ খাটি দুধের সন্মান কেরে নিয়েছে, ঠিক তেমনি ভাবে  মিথ্যে এবং সত্য শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের  মাধ্যমে খাটি সত্যের চেয়ে বড় কিছু সৃষ্টি করতে পারে কিনা সে বিষয়ে চলুন নিরিক্ষা চালানো যাক। ​ সেটা বেশ অনেক বছর আগেকার কথা। তখনও আমরা ইসলামিক প্রজাতান্ত্রিক পাকিস্তানের এক অংশ। ইসলামি প্রজাতন্ত্রের তখন একটা ইসলামিক ফ্যাশন ছিল – অনৈসলামিক কাজ কারবার করে, পাশ্চাত্যের অনুসারি বলে জাহির করা। এতে যেমন অনুসারীদের মুন্সীয়ানা বজায় থাকতো, বজায় থাকতো আভিজাত্য আর প্রগতিবাদের প্রতি নির্ভেজাল আস্থা। তেমনি প্রগতিশীল-অভিজাত-ইসলামে প্রচন্ড আস্থাবান দু’জন ‘নিশান-বরদার’-এর দেখা হলো ট্রেনের অভিজাত কামরায়। এ’দুজনের মাঝে এই প্রথম সাক্ষাৎ নয় – ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজে এদের প্রথম দেখা হয় পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় রাজধানীতে। তখন শুধু সাক্ষাৎ এবং পরিচয়ই হয়েছিল, অন্তরঙ্গতা হয়নি আলাপের সূত্রে – কারন দু’জনই ব্যস্ত ছিলেন প্রভু-কূলের প্রতিনিধীদের প্রীত করতে। ​ আবারও বলছি, দু’জনই ব্যাবসায়ী, দু’জনেরই গন্তব্য স্থান চাটগা।

প্রথম জন চলছেন ঢাকা থেকে, আর দ্বীতিয় জন চেপেছেন ভৈরব থেকে। প্রথম জন ট্রেনে চেপেই নীরস যাত্রার নিকুচি করলেন মনে মনে, তারপর কামরার দ্বার আটকিয়ে, রসহীন যাত্রাকে রসময় করতে, রসের রাজা সূরার স্বরনাপন্ন হলেন। আগে থেকেই আবস্থার কথা ভেবে রেখে ভদ্রলোক রসের রাজার সঙ্গ চেয়েছিলেন। রেলের ব্যুফে কারে ভেবে ছিলেন কিছু টেনেটুনে রমজান মাসের অন্যতম চিন্তা সিয়ামের উপকারিতার কথা ভাবা যাবে। কিন্তু এক রাশ বিরক্তি এসে সূরা-স্বপ্নকে জলো করে দিলো ট্রেন যখন ভৈরব পৌছালো। দরজায় ঘা পড়লো, ‘ভাই দরজাটা খুলুন’। রোযার মাস তাই অতি সন্তর্পণে বোতলটা গুছিয়ে রেখে, কসরত করে মুখটা সড়িয়ে রেখে দরজা খুলে দিলেন প্রথমজন। - ‘আরে আরে, ইসলাম সাহেব না! আসুন আসুন। তা’ আপনিও বুঝি চাটগা যাচ্ছেন?’ ​ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন দ্বীতিয় জন। তারপর মুখো মুখি বসে কুশল দেয়া নেয়া আর পোষাকী সংলাপ চললো কিছুক্ষন। ট্রেন আবারও গতি পেলো। দু’জনার মুখই গম্ভীর হলো। অনেকক্ষন ইতস্ততঃ করে প্রথমজন লজ্জিত হেসে জিজ্ঞাসিলেন, - ‘ভাই সাহেব কি রোজা নাকি?’ বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে না যেয়ে ইসলাম সাহেব বললেন – - ‘জ্বিনা, আজ আমি রোজা রাখিনি’। ​সামান্য বিরতি দিয়ে সংযোগ করলেন, - ‘রাখিনি বললে ঠিক হবে না – রাখতে চেয়ে ছিলাম, প্রথম ক’দিন রেখেও ছিলাম। কিন্তু পেটের যন্ত্রনায় ডাক্তারকে ডাকতেই সে ব্যাটা বললো, আপনার গ্যাস্ট্রিক আছে, ওসব রোজা-টোজা রাখা চলবেনা। তাই বুঝতেই পারছেন, আজ তিন দিন হলো সেটা বাদ দিয়েছি’। প্রথমজন উৎসাহের সাথে পকেট হাতড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট একটা বেড় করলেন, বিদেশী ব্র্যান্ডের, বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, - ‘নিন তাহলে।

আমিতো বেচারা চিরকালই ভোজন বিলাসি, ভোজন-আনন্দ বলতে পারেন আমাকে। এসব সংযম টংযম আমার পোষায় না। রোজাও রাখা হয় না। ​ সহযাত্রী এবার সংকোচের মৃয়মান গলায় সাথে সাথে বললেন, - ‘ধুমপানের অভ্যেস আমার নেই বললেই চলে, তবে আপনাকে কোম্পেনী দেবার জন্যই নিচ্ছি শুধু’। ​ বিগলিত হেসে ভোজনানন্দ সহযাত্রীর এবং নিজের মুখাগ্নি করলেন। তারপর অতি শ্লথ গতিতে বাক্যধারা, প্রশ্ন ও উত্তরে এগোতে লাগলো। সদা-সত্যবাদী বা নির্ভীক-সত্যবাদী প্রথম ভদ্রলোক মনে মনে পীড়িত হচ্ছিলেন, স্বর্গীয় প্রবেশকে কাছে টানতে পারছিলেন না বলে, অর্থাৎ সূরার সঙ্গ পাচ্ছিলেন না বলে। অবশেষে মড়িয়া হয়ে বলেই ফেললেন, - ‘তা ইসলাম সাহেব, একটু আধটু চলবে কি?’ তীর্যক দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে, ম্লান হেসে, গম্ভীর গলায় তিনি উত্তর দিলেন, - ‘ওসবে আমার মোটেও অভ্যেস নেই, ধারে কাছেও ঘেসেনি কখনো’। থেমে আবার বললেন, - ‘আপনি চালাতে পারেন, আমার অসুবিধে হবে না’। - ‘না না, সে কি, তা হয় না। তাহলে থাক’! বোতল রাখতে রাখতে লজ্জিত হয়ে বললেন প্রথমজন। ইসলাম সাহেব উঠে হাত ধরে ফেললেন ভদ্রলোকের। - ‘না না, হোসেন সাহেব, তা হয় না, আমি খাবো না বলে আপনাকেও নিরামিষ থাকতে হবে? সে কি রকম কথা। আপনি চালিয়ে যান’। অতঃপর কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে বললেন – - ‘থাক, আসুন আমি না হয় একবার টেস্ট করে দেখি – আপনাকে সঙ্গ দি’। হোসেন সাহেবের মুখে যেন হাসির একটা আভা দেখা দিল।

করমর্দন করলেন ইসলাম সাহেবের সাথে, বললেন, - ‘থ্যাঙ্কস, দ্যাটস দ্যা স্পিরিট’। ইসলাম সাহেব হেসে উত্তর দিলেন, - ‘বাট জাস্ট ওয়ান্স, আর আমাকে অল্প করে দেবেন’। ​ কিছুক্ষনের মাঝেই দেখা গেল সঙ্গ দানকারী সঙ্গী তাঁর সহজাত্রীকে যেন প্রতিপক্ষ বানিয়ে কম্পিটিশনে নেমেছেন। কিন্তু অপরজনের তখন মানসিক অবস্থা এমন সুস্থ নয় যে তিনি তাঁর সঙ্গীটির কথার সাথে কাজের কতটুকু তফাৎ বিচার করবেন। ​ ঘন্টা দু’য়েক পরের কথা। দু’জনে বসে আলাপে মগ্ন। হোসেন সাহেব এক নাগাড়ে বলে চলছেন তাঁর জীবনের স্মরনীয় সব ঘটনা। আর গর্বিত সব অভ্যাসের (এবং বদভ্যাসের) কথা। কি না হলে তাঁর চলে না, কি না হলে তিনি বোর-ফিল করেন। এবং কোথায় কোথায় রাত না কাটালে তিনি মানসিক পীড়াগ্রস্থ হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে সঙ্গীকে জিজ্ঞেস করেন, - ‘তা’ আপনার এসব অভ্যেস একদমই নেই?  কি আশ্চার্য্য! আপনার লাইফটাকে ডাল মনে হয় না, মাঝে মধ্যে? তাহলে কি নিয়ে আর কি ভাবে আপনি লাইফটাকে আকড়ে ধরে আছেন’? ইসলাম সাহেব বিগলিত হেসে বললেন, - ‘তেমন কিছুই নেই, তবে জীবনে আমার একটা অবলম্বনই আছে – শ্রেষ্ঠতম, সুন্দরতম আমার কাছে। এবং সবচেয়ে সুবিধেরও। আগে আপনার কথা শেষ করুন, তারপর এ সম্বন্ধে বলবো আমি’। ​ হোসেন সাহেবের চাঞ্চ্যলকর জীবন কাহিনী যখন শেষ হলো, তখন ট্রেন পৌছে গেছে গন্তব্য স্টেশনে। তারাহুড়ো করে দু’জনেই যখন নেমে চলে যাবেন, তখন হোসেন সাহেবের মনে পড়লো, বন্ধুবরটির কথাতো শুনা হয়নি! বিদায় নিতে যেয়ে তিনি বললেন, - ‘তা ভাই, আপনার সেই একমাত্র অবলম্বন আর সর্বকালীন সঙ্গী সম্বন্ধে তো কিছুই শুনা হলো না’! মৃদুহেসে হাত নেড়ে বিদায় জানাতে জানাতে তিনি বললেন, - - ‘তা এমন কিছু নয়। সেটা হলো, মিথ্যে বলা! আমার একমাত্র স্বাদ, আহ্লাদ, হবি, অভ্যেস, যাই বলেন না কেন – তা’ হলো এই মিথ্যে বলা। এবং সব সময়েই মিথ্যে বলা’! ​ আমার কিচ্ছার যবনিকা এখানেই পড়লো। এবার আমি পাঠকদের কাছে বিচারের ভার দিলাম, ‘সদা সত্য কথা’ বলার আর না বলার মাঝে কোনটাকে আপনারা শ্রেষ্ঠত্ত্বের আসন দেবেন। আমাদের বাস্তব জীবনের প্রয়োজনের দিকে একটুকু নজর রেখে – আপনারাই ঠিক করুন!

এ গল্পটা  হয়তো অনেক-কেই সাহায্য করবে শ্রেষ্ঠত্ত্ব বিচার করতে বসলে। কিন্তু আমার মত হলো – এখন থেকে বাস্তববাদিদের প্রত্যেকেরই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করা উচিৎ ‘যাহা বলিবো – মিথ্যা বলিবো’। ​ এ প্রতিজ্ঞাটা কাজে পরিণত করাটাও খুব একটা কঠিন কিছু নয়, সে ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। তবে কেউ যদি বলেন, ‘একটা মিথ্যের জন্য আরো দশটা মিথ্যে বলতে হয়, এবং তাই মিথ্যে বলা উচিৎ নয়’। তবে আমার উত্তর হলো, ‘মেনে নিচ্ছি, একটা মিথ্যে কথা রাখতে যেয়ে, বা ঢাকতে যেয়ে আরো দশটা মিথ্যে কথা বলতে হয়। সেটা একটা সত্যি কথা রাখতে যেয়ে, সত্যি সত্যিই  সেই কাজটা করার ঝামেলার চেয়ে কম নয় কি?’ সর্বোপরি এ প্রতিজ্ঞা নিলে আপনি একটা এডিশনাল বেনিফিট পাচ্ছেন, ইন্সুরেন্স কোম্পানীর দেওয়া এডিশনাল বেনেফিট নয়, সত্যিকারেরই (মিথ্যের রাজত্ত্বে এ কথাটা তখন বেখাপ্পা শুনাবে – সবাই সন্দেহ করছেন না তো আমাকে?) সেটা। তাহলো, আপনি মিথ্যেবাদী হয়েও সত্যবাদী থাকছেন। এবার বলুন, ‘যাহা বলিবো – মিথ্যা বলিবো’ এ প্রতিজ্ঞাটা নেওয়া উচিৎ কি না? ​ঢাকা ​৫ই নভেম্বর ১৯৭২