দেলওয়ার হোসেন , সুইডেন থেকে
জীবদ্দশায় দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে বহু যুদ্ধ দেখার অভিজ্ঞতা হলো । কিন্তু এবারের রাশিয়-ইউক্রেন যুদ্ধের অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা আর হয়নি । যুদ্ধ দামামা, ধ্বংস, হত্যাযজ্ঞ, শরণার্থীর ঢল এর মত চিরাচরিত যে বীভৎস ও ক্লেশকর দুর্দশার চিত্র ভেসে ওঠে, তার কমতি না থাকলেও এসব ছাপিয়ে এবারের যুদ্ধে দুনিয়ার মানুষকে চকিত করে তুলেছে দ্রব্য মূল্য । যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এমন অবস্থা মোটেও অস্বাভাবিক নয় । কিন্তু এবারের যুদ্ধে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হিসাব-নিকাশ যেন একেবারে মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে ত্রাস সৃষ্টি করেছে । তাই সমর যুদ্ধের চেয়ে জীবন ধারণের জন্য বেশি প্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির অসম সমীকরণ জীবিকা নির্বাহের এক কঠিণ যুদ্ধে ফেলে দিয়েছে মানুষকে । সাধারণ মানুষের চিন্তা এখন স্বাচ্ছন্দে থাকার নয়, খেয়ে পরে বাঁচার । আমরা সমস্যা ও সংকট মুক্ত হয়ে খেয়ে পরে টিকে থাকার কথা চিন্তা করলেও – আমি যে দেশে থাকি অর্থাৎ সুইডেনে এই পরিস্থিতিতে এই দেশ এবং তার প্রতিবেশী ফিনল্যান্ড এর প্রধাণ উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল নিরাপত্তার । তারা যুদ্ধবাজ শত্রুর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাবে কীভাবে ? নিজেরা নিরুপদ্রব ও নিরাপদে থাকবে কীভাবে ?
এই শংকা তাদের দীর্ঘকাল থেকেই । শক্তিশালী বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে তারা নিজেদের রক্ষা করতে সক্ষম নয় । তাই জোটবদ্ধভাবে থাকার প্রয়োজনটা তারা সব সময়ই উপলব্ধি করেছে । আর তাই সুইডেন ফিনল্যান্ডকে আলাদা না করে নিজ দেশের শাসনাধীনে রেখেছিল । ফিনল্যান্ড এমনিতেই কখনও শক্ত মেরুদন্ডের দেশ ছিল না । ১১৫৭ সাল থেকে ১৮০৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৭০০ বছর দেশটি শাসন করেছে সুইডেন । ১৮০৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রাশিয়া ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে বসে । ১৯০৯ সাল পর্যন্ত চলা এই যুদ্ধে রাশিয়া দখল করে নেয় ফিনল্যান্ড । সুইডেন হারায় তার পূর্বাঞ্চলীয় অর্ধেক উপকুল, এক তৃতীয়াংশ ভূমির আয়তন ও এক চতুর্থাংশ জনগোষ্ঠির বসতি ।এই আক্রমণের পেছনে হাত বাড়িয়েছিল নেপোলিয়ন ( Napoleone Bounaparte , জন্ম ১৫ আগস্ট ১৭৬৯, ফ্রান্স , মৃত্যু – ৫ মে, নির্বাসনে, ৫১ বছর বয়সে আটলান্টিক সাগরের সেইন্ট হেলেনা দ্বীপে। শাসন করেছেন ১৮০৪- ১৮১৪ এবং ১৮১৫ ) তিনি ক্ষমতায় আরোহণের পর ফরাসী রাজার সাথে সুইডিশ রাজার মৈত্রীর সম্পর্কের অপমৃত্যু ঘটার পর নেপোলিয়নের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে অনীহা প্রকাশ করেন রাজা চতুর্থ গুস্তাফ । ইউরোপে সুইডিশ রাজার একমাত্র বন্ধু ও মিত্র ছিলেন ব্রিটেনের রাজা । ফলে এই দুজনকে শত্রু পক্ষ ভেবে তাদরকে শায়েস্তা করার জন্য নেপোলিয়নের পরামর্শে রাশিয়ার শাসক জার ৮ লক্ষ সৈন্য পাঠান সুইডেন আক্রমণে ।
দখল হয়ে যায় সুইডেনের অংশ ফিনল্যান্ড । ফিনল্যান্ডে আক্রমণ হয় বহুবার । সর্বশেষ ১৯৪০ সালের ১৩ মার্চ রাশিয়া আবার আক্রমণ চালিয়ে দখলে নেয় ফিনল্যান্ড । মুক্ত করে ১৯১৭ সালে । ফিনল্যান্ডের রয়েছে ১৩৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ অরক্ষিত এক সীমান্ত। এখান দিয়েই বহিঃশত্রুর আক্রমণ ঘটেছে বার বার । এটি নিয়েই সুইডে্ন ও ফিনল্যান্ডের মহা আশংকা । জোট নিরপেক্ষ থাকার কথা ভাবলেও বাস্তব কারণে নিজেদের নিরাপত্তার প্রশ্নে জোটভুক্ত শক্তির বাইরে রাখার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছে না তারা । কুড়ি শতকের শেষ সময় পর্যন্ত ঠান্ডা যুদ্ধ চলার কারণে নিরাপত্তার অভাবটা তারা সেভাবে উপলব্ধি করেনি । কিন্তু শক্তির ভারসাম্য নষ্ট ও নতুন করে পরাশক্তির আশংকাজনক বিস্তার ঘটায় এবং বাড়ির পাশে যুদ্ধ লাগায় উদ্বেগের জায়গাটা তীব্র হয়েছে । আর এ কারণে ফিনল্যান্ড-সুইডেন তড়িঘড়ি করে মরিয়া হয়ে ন্যাটোতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে, সুরক্ষার জন্য । এই হলো দেশ দুটির ন্যাটোতে যোগ দেয়ার প্রেক্ষিত ।এরপর থাকে যুদ্ধের বিশ্বব্যাপী নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি । উৎপাদন , পরিবহণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার যে সমস্যা ও সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান কি – কারো জানা নেই । জ্বালানি, খাদ্যপণ্য সহ প্রয়োজনীয় সকল জিনিসের যে অস্বভাবিক মূল্য বৃদ্ধি গটেছে, তা নিয়েই উঠেছে মানুষের নাভিশ্বাস । পর্যাপ্ত উৎপাদন ও সরবরাহ নেই । ফলে সংকট ও চাহিদা হূ হূ করে বাড়ছে । ২০২৩ সালে বিশ্বজুড়ে তেলের চাহিদা দুই শতাংশের বেশি বাড়বে। এ সময় প্রতিদিন প্রায় ১০ কোটি ২০ লাখ ব্যারেল তেলের প্রয়োজন হবে। কিন্তু তার আগেই দেশে দেশে তেলের দাম বেড়েছে আর দশটা পণ্যের মতই। দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। প্যারিস ভিত্তিক জ্বালানি সংস্থাটি তাদের মাসিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিশ্বে খাদ্য ও জ্বালানি মূল্য বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে । এই অবস্থা চলতে থাকলে সমুহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বিশেষ করে কোভিড মহামারিতে নাজুক অবস্থায় পড়ে যাওয়া দেশগুলো । এমনিতেই কোভিড সৃষ্ট বিপর্যয় ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়ার স্বল্পোন্নত অর্থনৈতিক শক্তি নড়বড়ে করে দিয়েছে ।
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সমীক্ষা অনুযায়ী উন্নত অর্থনীতির দেশগগুলো ২০২২ ও ২৩ সালে সর্বাধিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য দায়ী হবে। এক্ষেত্রে ২০২৩ সালে নেতৃত্ব দিতে পারে চীন। কারণ দেশটি করোনার খড়গ ও বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে সক্ষমতার হাত ধরে। অপরদিকে শ্রীলংকার পর অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়েছে পাকিস্তান! পাকিস্তান সরকার জানিয়েছে, জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেওয়ার সক্ষমতা নেই তাদের। গত মাসের ১৬ জুন এক ধাক্কায় দাম বেড়ে পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে প্রতিলিটার ২৩৩. ৮৯ টাকা দরে। ডিজেল ২৬৩ টাকা ৩১ পয়সা আর কেরোসিন তেল ২১১ টাকা ৪৩ পয়সা।পাক অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, পাকিস্তা্নে লিটার প্রতি পেট্রোলে ২৪ টাকা ৩ পয়সা, ডিজেলে ৫৯ টাকা ১৬ পয়সা, কেরোসিনে ৩৯ টাকা ৪৯ পয়সা এবং লাইট ডিজেল অয়েলে ৩৯ টাকা ১৬ পয়সা ক্ষতি হচ্ছে দীর্ঘ দিন ধরে। মে মাসে এই ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। যেখানে সরকার চালাতে এর তিন ভাগের এক ভাগ খরচ হয়। তবে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা জ্বালানির দাম বাড়লে অন্যান্য দ্রব্যেরও দাম বাড়বে দ্রুত যার নজির হাজির হয়েছে আগাম।
ধনী দেশ জার্মানিরও সংকট এখন মাথার ওপর । মাত্র আড়াই মাস চলার মত গ্যাসের মজুত রয়েছে জার্মানির । নতুন সরবরাহ না পেলে চরম সংকটের মুখে পড়বে তারা । গ্যাসের দাম বেড়ে যেতে পারে দুই-তিন গুণ । সংকট তীব্র হলে গ্যাসের রেশনিং পদ্ধতিতে যেতে হতে পারে জার্মানিকে । ইউক্রেন আক্রমণের কারণে রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি সীমিত করা সহ একরাশ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন- রাশিয়ার ওপর । এর জবাবে রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ইউরোপের ১২টি দেশে । জার্মানির নর্ড স্ট্রিম পাইপ লাইন দিয়ে গ্যাস আসার গতি একেবারেরি শ্লথ হয়ে গেছে । এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামি শীতে প্রয়োজন মেটাতে ৯০ শতাংশ গ্যাসের সংকট দেখা দেবে জার্মানির । শুধু তাই নয় , রাশিয়ান মূদ্রা রুবল এ গ্যাস কেনার শর্ত প্রত্যাখ্যান করায় এরই মধ্যে রাশিয়া – পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক , এবং ফিনল্যান্ডকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে । আর পুতিনের এই পদক্ষেপকে জার্মান অর্থমন্ত্রী রবার্ট হাবেক বলেছেন, এটা আমাদের ওপর পুতিনের হামলা । তাই সংকট মোকাবেলা করতে আমাদের এখন গ্যাসের ব্যবহার কমাতে হবে ।
পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য জার্মান সরকার গ্যাস মজুতকরণ কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস ভর্তি করার জন্য ১ হাজার ৫০০ কোটি ইউরো ঋণ দেবে । এখান থেকে শিল্প খাতে গ্যাস নিলামে বিক্রি হবে । এতে গ্যাস ব্যবহারে শিল্পদ্যোক্তারা মিতব্যয়ী হবে । তবে সরকার এও বলেছে – বাড়তি দামে যে গ্যাস কিনতে হচ্ছে , তা জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে ।লক্ষনীয় বিষয় হলো, বিগত দুইটি বছরে আক্রান্ত গোটা বিশ্ব, করোনা মহামারিতে তছনছ্ হলেও এতবড় বৈশ্বিক মহা সংকটের মধ্যে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির পাগলা ঘোড়ার লাগামহীন গতি পৃথিবী প্রত্যক্ষ করেনি, যা অবিশ্বাস্য রকম ভাবে মহা উদ্বেগ ও আশংকার জন্ম দিয়েছে প্রতিটি মানুষের মনে ।শুধু মাত্র রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার কারণে ।
এর জের ধরে উদ্বিগ্ন বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বের বহু দেশ অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়েছে । এবং তা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে । ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়ার স্বল্পোন্নত দেশগুলোন ইতোমধ্যেই বড় ধরনের মন্দার থাবায় পড়ে গেছে । এর ফলে মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হার এবং প্রবৃদ্ধি হ্রাস বা তথাকথিত ”স্ট্যাগফ্লেশন”- এর ঝুঁকিও বাড়ছে । বিশ্বজুড়ে জ্বালানি ও খাদ্য দ্রব্যের মূল্য লাগামহীন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে । দেখা যাচ্ছে এই আশংকা বাঘা বাঘা বিশ্ব নিয়ন্তা প্রায় সকল অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো একই সুরে আশংকার কথা বলছে ।
ইউক্রেন যুদ্ধ - চীনে লক ডাউন, সরবরাহ শৃঙ্খলা কিংবা সাপ্লাই চেইন লাইনে বিরাট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে । যার ফলে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি প্রবৃদ্ধির ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে । যা অনেক দেশের অনিবার্য মন্দা পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করবে ।সমসাময়িক কালে পণ্যের সরবরাহ সংকট ও উচ্চ মূল্যের যে নজির নিকট অতীতের কয়েক দশকে দেখা যায়নি, তার নিদর্শন হঠাত করেই দেখা গেল সাম্প্রতিক কালের চলমান রাশিয়া – ইউক্রেন যুদ্ধে । তাই প্রশ্ন উঠেছে – ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবেই দেখা দিয়েছে এই পরিণতি – ইউক্রেন ম্যাটারস ( Ukrain Matters ) ! এটিই হয়েছে বড় ফ্যাক্টর । এটিই তার ফল । সেদিকে সংক্ষিপ্ত ভাবে অনুপুঙ্খ নজর দিলেই দেখা যাবে এর অনুঘটকের ভূমিকা ও দৃশ্যমান চিত্রটি।
৪৬ মিলিয়ন অধিবাসীর ইউক্রেনে জনবসতি শুরু হয় ৪৪ হাজার বছর আগে । ইউরোপে রাশিয়ার সর্ব বৃহৎ এই দেশটির আয়তন ৬০৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার । আকারে ফিনল্যান্ডের দ্বিগুন । দেশটির ৫৬% চাষযোগ্য ভূমির এক মিটার গভীর পর্যন্ত রয়েছে অত্যান্ত উর্বর কালোমাটি যাকে পৃথিবীর উর্বর শস্যভুমি হিসেবে বিধাতার আশীর্বাদ বলে গণ্য করা হয় । পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ কালোমাটির অধিকারী ইউক্রেনের বাইরে কালো মাটির অস্তিত্ব পাওয়া যায় রুমানিয়া, হাঙ্গেরি , মোলদাভিয়া ও নর্থ আমেরিকায় । ১৯১৮ সালের ডিসেম্বরে কম্যুনিস্ট বলসেভিকরা কিয়েভ দখল করে ইউক্রেনকে সোভিয়েত রিপাবলিক ঘোষণা দেয় । ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় ২৪ আগস্ট দেশটি সার্বভৌমত্ব লাভ করে ।
দেশটির জাতীয় অর্থনীতির ৪০% বৈদেশিক মূদ্রা আসে কৃষি পণ্য রফতানি থেকে । পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক সূর্যমুখী তেলের উৎপাদক ও রফতানি কারক ইউক্রেন । পৃথিবীর মধ্যে গম উৎপাদনে ১৮ তম, ভূট্টায় চতুর্থ যব এবং আলুতে তৃতীয় বৃহৎ (২০১৯) । গম রফতানিতে যৌথভাবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের অবস্থান বিশ্বের মধ্যে তৃতীয় । বিগত ১৪ বছরের মধ্যে বিশ্ববাজারে গমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে সর্বাধিক । চীন ইউক্রেন থেকে তার মোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ ভূট্টা আমদানি করে থাকে ইউক্রেন থেকে । ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ ইউক্রেনের অবস্থান ইউরোপে প্রথম এবং বিশ্বের মধ্যে সপ্তম । এছাড়া ইউক্রেনের আছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যাঙ্গানিজ খনিজ পদার্থ , কুইক সিল্ভার এর বৃহত্তম খনিজ ভান্ডার ।
ইউরোপে চতুর্থ বৃহৎ গ্যাস রফতানিকারক হিসেবে ২০% গ্যাস সরবরাহ করে ইউক্রেন এবং আনবিক জ্বালানি শক্তি রফতানির দিক থেকে ইউরোপে এর অবস্থান দ্বিতীয় হলেও পৃথিবীর মধ্য সপ্তম । দক্ষিণ পূর্ব ইউক্রেনে ফিনিপ্রপেতরোভস্ট ওব্লাস্ট ইউক্রেনের সর্ব বৃহৎ পারমানবিক চুল্লী সহ গোটা দেশে রয়েছে ৬ টি চুল্লী । এর ক্ষমতা ৫৭০০ মেগাওয়েট । পৃথিবীর মধ্যে ইউক্রেনই সর্ব বৃহৎ আনবিক শক্তির টারবাইন রফতানিকারক দেশ ।বিশ্বে এমোনিয়া রফতানিতে প্রথম, খনিজ লোহা রফতানিতে ৫ম , স্টীল উৎপাদন ১০ম স্থান দখলকারি ইউক্রেন খাদ্য-শস্য পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরন, সিউয়ারেজ ও পানীয় জল শোধন এর বিশ্ব মানের রাসায়নিক উপাদান্ , মিনারেল , জ্বালানি, ডিম, পনির সহ অসংখ্য নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য শস্য ও পন্য রফতানি করে থাকে । (উল্লেখ্য – যুদ্ধের আগে বড় ৩০টি ডিমের প্যাকেট কম মূল্যের অভিবাসী দোকানে পাওয়া যেত ৩০ -৪০ ক্রোনারে , তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ -৮০ ক্রোনারে )
এর পাশাপাশি রাশিয়া গোটা ইউরোপের ৪০ শতাংশ গ্যাস সহ প্লাটিনাম, নিকেল রফতানিকারক হলেও যূক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে কাঁচামাল রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে সংকটময় পরিস্থিতি । রাশিয়ার দ্বারা একই পরিস্থিতির শিকার ইউক্রেনও । যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনের আজভস্কা সাগর থেকে কৃষ্ণ সাগরের দিকে যেতে পারছে না ইউক্রেনের কোন জাহাজ । অবরোধের কারণে জাহাজগুলো আটকা পড়ে আছে বন্দরে । খাদ্য পণ্য পার হবে কি করে ? তাই মহা সংকটের মুখে এখন গোটা বিশ্ব । দ্রব্য মূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্ব গতি ।মূল্য স্ফীতির এই অগ্নিমূল্যে মানুষ আজ দিশেহারা । জীবন যাত্রায় মানুষের উঠেছে নাভিশ্বাস । তবে বাংলাদেশের মানুষের এই নাভিশ্বাসের অভিজ্ঞতা আজ নতুন না হলেও এ ভোগান্তি দীর্ঘকালের । সেই অভিজ্ঞতার একটি অধ্যায় আমি নিজেও পার করেছি ৭৪ সালে । ২-৪ টাকা কেজির লবন যখন হয়েছিল ৮৪ টাকা এবং বাজার থেকে উধাও । এই সংকট গুলো দেশের দুর্ভাগা মানুষকে যখন তখন পোহাতে হয় কোন কারণ ছাড়াই বা অসাধু ও দুর্বৃত্ত চক্রের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কারণে । সার , তেল, চাল, ডাল, চিনি, ছোলা, পেয়াজ , মরিচ, আদা, রসুন, মসলাপাতি সহ যখন যেটায় দুর্বৃত্ত গোষ্ঠী কারসাজির সুযোগ খুঁজে পায়, তখন তারা সেটা নিয়েই মেতে ওঠে জাতির সর্বস্ব লুট করার খেলায় । যার একটা নৈমিত্তিক চর্চা দেশে স্বাধীনতার উত্তরকাল থেকেই চলে আসছে । অন্তত প্রতি রমজান মাস এলেই বাজার মূল্যের দানবীয় ঊর্ধ্ব গতির অবাধ ও নিয়ন্ত্রনহীন তান্ডবের মাশুল জাতিকে দিতে হয় , তা নতুন কিছু নয় । তবে বিশ্বব্যাপি আজকের প্রেক্ষিত আজ কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা বিশ্ব জুড়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে হঠাত করে রাশিয়া –ইউক্রেন যুদ্ধ বাঁধার ফলে । । যোগ হয়েছে বিশ্ববাসীর শংকা ।
একটি বিশেষ কারণে হঠাত করেই বিশ্ববাজারের এই উদ্বেগ জনক চালচিত্র দেখা গেলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট সব সময়ই বিশেষ কারণ ছাড়া বানোয়াট অজুহাতে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির কোন যৌক্তিক দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না । নানান বানোয়াট অজুহাতে ৪০০ টাকা কেজি পেয়াজ, ৩০০ টাকা কেজি কাঁচা মরিচ, ২০০ টাকা কেজি বেগুন, ৫০০ টাকা কেজি আদা এবং আরো বেশুমার রকমের পণ্যের বাজারে যখন অগ্নি মূল্য ছড়িয়ে পড়ে, তখনও আমি সুইডেনের মাটিতে বসে আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের স্বাভাবিক চালচিত্রটা দেখে ক্ষোভে, অপমানে আর আত্মদহনের জ্বলায় নিজের মাথার চুল নিজেই ছিড়ি, যখন অজুহাত হিসেবে শুনি আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য সংকট , অপ্রতুল সরবরাহ ব্যবস্থা ও পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কথা । এই ভানুমতির খেল আমি দেখে আসছি সেই `৮৯ সাল থেকে সুইডেনের মাটিতে বসে । সেলুকাস ! কী বিচিত্র এ স্বাধীন বাংলাদেশ !
অথচ আমি ৯০ দশকে সুইডেনের তাবত পণ্য মূল্য যে পর্যায়ে দেখেছি, তার প্রায় প্রতিটির দাম করোনার আগ পর্যন্ত বিগত ৩০ বছরে বেড়েছিল সরবোচ্চ ৫-১০ ক্রোনার পণ্য বিশেষে । যেমন এক লিটার দুধ কিনতাম ৫ ক্রোনারে, সেই দুধ আজ ২০২২ সালে এসে কিনছি ১১ ক্রোনারে । এবং অনেক পণ্যের মূল্য বেড়েছে কেবলমাত্র ২- ১ ক্রোনার । আয়ের তুলনায় সঙ্গতিপূর্ণ ব্যয় কিংবা ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে পণ্যের বাজার মূল্য, নগন্য হারে মূল্য স্ফীতি এমন সুষম সিস্টেম্যাটিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত যে, সেখানে অনাচার, নৈরাজ্য ও কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কোন সুযোগ নেই । তার বড় কারণ – সুশাসন । সুশাসনের অভাবটাই নৈরাজ্যের বড় কারণ । সুইডেন বা নর্ডিক দেশগুলো অথবা শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করে বলা যায় , এই অঞ্চলের জাতি গোষ্ঠী স্খলিত চরিত্রের ভাইরাসের স্পর্শ থেকে মুক্ত। আদর্শিক জীবনবোধ ও অনুকরনীয় শিষ্ট আচারের অনুসারী এরা প্রত্যেকেই সৎ জীবনের মূর্ত প্রতীক । তাই এরা পৃথিবীর বুকে আজ এতটা সভ্য ও উন্নত । এদের তুলনা এরা নিজেই ।
তবে এবারের যুদ্ধের কারণে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির অসহনীয় হার কেবল আকাশ চুম্বির মতই নয়, তা মানুষের চিন্তা শক্তিকেও বিকলাঙ্গ করে দেয়ার মত । এবং তা কেবল কোন একটি বিশেষ দেশ , অঞ্চল বা যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট দেশেই সীমাবদ্ধ নয় । এর রাহুর গ্রাস বিস্তৃত হয়েছে দুনিয়া ব্যাপী । যার ইতিহাস নিকট অতীতের কোন ইতিহাসে নেই । ১২ ক্রোনার লিটার র্যাপস ওয়েল করোনার আগে কিনেছি ১২ ক্রোনারে, তা পরে কিনেছি ১৬ ক্রোনারে । যুদ্ধের কারণে এখন কিনছি দোকান বিশেষে ৩০ – ৫০ ক্রোনারে । জিনিস পত্রের দাম বেড়েছে এমনই অস্বাভাবিক হারে । পণ্যমূল্যের ফিরিস্তি দেয়ার আর প্রয়োজন নেই । মূল্য বৃদ্ধির এই অসহনীয় উত্তাপ প্রিথিবীর কোন দেশ ও তার জনগণ স্বস্তিতে নেই । ক্রয় ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছ অভাব ও সংকটের থলিতে । মানুষের আয় ও বেতন বাড়েনি । মানুষ দিন গুজরান করবে কীভাবে ?চোখের সামনে `৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ , ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া-ইথিওপিয়া, লেবানন, শ্রীলংকা, ইরান-ইরাক, কুয়েত, লিবিয়ার মত প্রভৃতি দেশের যুদ্ধ সংঘটিত হলো , তখনকার পরিস্থিতিতেও দুনিয়া ব্যাপী পণ্যমূল্যের বাজার এমন অস্বাভাবিকভাবে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠেনি এবং মানুষ এতটা সংকটের মুখে পড়েনি । এই যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেবে এবং সংকট আরো কতটা ঘনিভূত হবে তার জবাব কারো জানা না থাকলেও – যুদ্ধবাজ দুই পক্ষই জানে কোথায় গিয়ে থামবে তারা - কতটুকু লাভ ক্ষতি অর্জনের পর ।
রাশিয়ার হুমকি -
দুই বছরের মধ্যে ‘বিশ্ব মানচিত্রে ইউক্রেনের হয়তো আর অস্তিত্বই থাকবে না’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ। টানা চার মাসের অধিক সময় ধরে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। এরই মধ্যে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ দুটি শহর দখলে নিয়েছে মস্কো।এমনকি আরও বৃহত্তর ভূখণ্ড হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর মিত্র এই দেশটি। এই পরিস্থিতিতে বেশ চাঞ্চল্যকর এই মন্তব্যই সামনে এনেছেন রাশিয়ার সাবেক এক প্রেসিডেন্ট। তার দাবি, বিশ্ব মানচিত্র থেকে অস্তিত্ব হারাতে পারে ইউক্রেন। গত মাসের - জুনের মাঝামাঝি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালনের পর দীর্ঘসময় রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্বপালন করেছেন দিমিত্রি মেদভেদেভ। বর্তমানে তিনি রাশিয়ার সিকিউরিটি কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান।এদিকে দিমিত্রি মেদভেদেভের এমন মন্তব্যের জবাব বেশ উপহাসের সঙ্গে দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পদোলিয়াক। টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেন আছে, এতোদিন ছিল এবং থাকবে। প্রশ্ন হলো- মেদভেদেভ দুই বছর পর কোথায় থাকবেন।’
(লেখক সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক ) স্টকহোল্ম, ১০ জুলাই , ২০২২