নারী কাজী নজরুল ইসলাম সাম্যের গান গাই, “আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!  আপনারে আজ প্রকাশের তব নাই সেই ব্যকুলতা, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।  আজ তুমি ভীরু আড়ালে থাকিয়া নৈপথ্যে কও কথা! চোখে চোখে আজ চাহিতে পারনা; হাতে রুলি,পায়ে মল, মাথার ঘোমটা ছিঁড়ে ফেল নারী, ভেঙ্গে ফেল ও শিকল! যে ঘোমটা তোমা করিয়াছে ভীরু ঊড়াও সে আবরণ! দূর করে দাও দাসীর চিহ্ণ, ঐ যত আভরণ!”  'নারী' এই কবিতায় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'পর্দা' ছুঁড়ে ফেলার আহ্বানকে অনেক সমালোচক ভুল বুঝেছেন, বিশেষ করে রক্ষণশীল মুসলমানরা, এবং সুবিধামতো তারা নজরুলের পর্দা অপসারণের আহ্বানকে নারীর ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার পরিপন্থী বলে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু তা 'নারী' এই কবিতায় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'পর্দা' ছুঁড়ে ফেলার আহ্বানকে অনেক সমালোচক ভুল বুঝেছেন, বিশেষ করে রক্ষণশীল মুসলমানরা, এবং সুবিধামতো তারা নজরুলের পর্দা অপসারণের আহ্বানকে নারীর ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার পরিপন্থী বলে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। তবে তা নয় ।   লিঙ্গ-সংবেদনশীল কবি নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন। তিনি নারীদের জন্য সমতার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং সমাজে লিঙ্গগত ভূমিকা ধ্বংস করে  দিতে চেয়েছিলেন।   একজন মুসলিম নারীর জন্য পর্দার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে বোঝা জরুরি।

হিজাব এবং নিকাব (মাথার পোশাক এবং মুখ ঢেকে রাখার টুকরা) ইসলামে বাধ্যতামূলক আনুষাঙ্গিক বা অনন্য শৈলী নয়; বরং পর্দাকে সামাজিক রীতি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সমাজ থেকে শুরু করে সমাজে, নানা কারণে। অনেক সমাজে, এটি পশ্চাদপদতা বা নিপীড়নের প্রতীক হয়ে উঠেছে এবং কেউ সম্ভবত এই কবিতার বার্তাটি আরও ভালভাবে বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে পারেন ।   বোরকা পরা ইসলামী আইনের অংশ নয়; সংস্কৃতি তা গ্রহণ করেছে। বরং বোরকা পরা ছিল পুরোনো দিনের সংস্কৃতির অংশ। কিছু মুসলিম নারী মাথায় স্কার্ফ এবং এক টুকরো কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখতে পছন্দ করেন।  আবার কিছু মুসলিম নারী এই আনুষঙ্গিক জিনিসগুলি পরতে চান না, কারণ এগুলি মুসলিম নারীদের শালীনতা বা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পর্দা রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় নয়।  পনেরো শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে, হিজাব ব্যবহার করা অনেক ধর্মের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে ওড়না বা অতিরিক্ত বাইরের পোশাক (পুরো শরীর ঢেকে রাখার জন্য লম্বা পোশাক) সামাজিক পছন্দের অংশ হয়ে উঠেছে।নারীরা কখনও কখনও পরিবার প্রধানের চাপের কারণে বা নারীদের নিজেদের পছন্দে এই ধরনের আনুষঙ্গিক পোশাক পরছেন।   সুতরাং, এই প্রবন্ধটি কানাডা এবং বিশ্বব্যাপী মুসলিম মহিলাদের উপর প্রয়োগ করা  দ্বৈত মানদণ্ডের ওপর আলোকপাত করে। কেউ পর্দা/হিজাব/নিকাব/হ্যান্ড গ্লাভস নিয়ে কথা বলছেন , কেউ মুসলিম নারী নেতৃত্ব এবং মুসলমানদের সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কথা  বলছেন ।   বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন মতামতের পরিধিকে নির্দেশ করে। সর্বত্র মুসলিম ইস্যু নিয়ে যেভাবে আলোচনা করা হয় তা একজন প্রকৃত মুসলমানের চূড়ান্ত দৃষ্টিভঙ্গি নয়।। মিডিয়াতে উপস্থাপনার সমস্যার একটি অংশ হল, কিছু মানুষ জ্ঞান অর্জন না করে এলোমেলোভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তারা কেবল মুসলিম কণ্ঠস্বর বা অমুসলিম কণ্ঠস্বর হয়ে যায়; তবে একাধিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে ভালো হতো। যখন আমরা একজন নারীকে পর্দা, হিজাব, বা নিকাব পরা দেখি, তখন আমাদের বৈচিত্র্যের ধারণা পরিবর্তন করা উচিত নয়। আমাদের ভয় পেয়ে দূরে থাকা বা উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং, আমাদের বোঝাপড়া এবং সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত এবং রক্ষণশীল মুসলিম নারীদের অপরাধী বা ভয়ের কারণ হিসেবে না দেখে, তাদেরকে দুর্বল এবং বোঝার জন্য আগ্রহী ব্যক্তি হিসেবে দেখা উচিত।  বিশ্বজুড়ে ইসলামোফোবিয়া এবং ISIS আন্দোলন এবং পুরো বিশ্বের জনগণকে মুসলিম ও ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার ঘোষণার মধ্যে একজন সৌদি আলেম হিজাব পরার বিরুদ্ধে একটি নতুন ফতোয়া জারি করেছিলেন। সৌদি আরবের মক্কায় Commission for the Promotion of Virtue and Prevention of Vice - এর  সাবেক প্রধান আহমেদ বিন কাসিম আল-গামিদি এই ফতোয়া জারি করেন। তিনি বলেন, 'ইসলামে নারীদের বোরকা পরার বাধ্যবাধকতা নেই' উল্লেখ করে তিনি বলেন, নারীরা মেকআপ পরতে পারেন , নিজেদের ছবি তুলতে পারেন  এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতে পারেন । সৌদি ধর্মীয় নেতা বলেন, 'কোনো নারী যদি তার চেহারা দেখান  বা প্রসাধনী ব্যবহার করে থাকেন,  তাতে দোষের কিছু নেই।  তিনি আরও বলেন যে, "শুধুমাত্র নবী মুহাম্মদ (সা.) এর স্ত্রীরা হিজাব পরতে বাধ্য ছিলেন, যাতে তাদের কাছের পরিবারের বাইরে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষরা তাদের দেখতে না পারে।" তার দাবি সমর্থন করতে গিয়ে তিনি ফিলিস্তিনি ইসলামী পণ্ডিত ইবন কুদামাহ আল-মাকদিসির একটি পূর্ববর্তী উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছিলেন, "যদি নারীর মুখ ও হাত তার শরীরের অন্তরঙ্গ অংশ হতো, তবে আল-হাজ পালন করার সময় তার জন্য এগুলি ঢেকে রাখা হারাম হতো না।" আহমেদ বিন কাসিম আল-গামদি যোগ করেন যে নারীদের দোষারোপ করার পরিবর্তে, পুরুষদের দোষারোপ করা উচিত, যাদের দৃষ্টি নিচু রাখার কথা বলা হয়েছে। এই সৌদি আলেম মরক্কোর পণ্ডিত কাজী আইয়াদের উক্তি উদ্ধৃত করে বলেন, "নারীর জন্য তার বাড়ির বাইরে মুখ ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটি সুন্নাত মুস্তাহাবা (পছন্দনীয়, কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়)। অন্যদিকে, পুরুষদের উচিত তাদের দৃষ্টি নিচু রাখা।" মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ ২০১৪ সালের ৬ই ডিসেম্বর এই সংবাদটি প্রকাশ করেছিল।   মুসলিম নারীরা কীভাবে মক্কা এবং সারা মুসলিম বিশ্বে পর্দা/হিজাব পরা শুরু করেছিলেন, তা স্পষ্ট নয়। এটি কি পুরুষদের দ্বারা ইসলামী শাসনের নামে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, নাকি এটি সমাজে নারীদের উচ্চ মর্যাদার প্রতীক হিসেবে পরিচিত হওয়ার জন্য একটি নিয়মে পরিণত হয়েছিল, তা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

  লেখক প্যামেলিয়া রিভিয়ের  অনুবাদ করেছেন ফাহমিদা ফাইরুজ নাদিয়া  ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই)  ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি