- আকবর হায়দার কিরন
বাংলাদেশে ইংরেজী ভাষার সাংবাদিকতার ইতিহাসে একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক জনাব কাজী মন্টু । তিনি প্রায় তিন দশক ধরে দেশের বাইরে, নিউ ইয়র্ক সিটিতে বর্তমানে তাঁর বসবাস। কিন্তু তিনি সেই সাংবাদিকতার দিনগুলো কখনোই ভুলে থাকেননা। জ্যাকসন হাইটসে তাঁর অফিসে গেলে আমার যেন মনে হয় ‘কাজীর দরবার’ এ যাওয়া এবং স্বাধীনতার পর সাংবাদিকতার কতো কথা, কতো স্মৃতি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
ক’দিন আগে চিরতরে চলে গেলেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নেতা রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ভাই। এই শোকাহত হৃদয় নিয়ে মন্টু ভাইয়ের অফিসে গিয়ে কিছুটা সময় যেন চোখের পাতা ভারী হয়ে যায় আমাদের দু’জনের। মাত্র ক’দিন আগে রিয়াজ ভাইয়ের সাথে কথা হলো মনজুর আহমেদ ভাইজানের সাথে। কথা ছিলো মনজু ভাইয়ের সাম্প্রতিক স্মৃতিচারণমূলক প্রকাশনা রিয়াজ ভাই অবশ্যই সংগ্রহ করবেন এবং পড়বেন। কিন্তু সেই চাওয়া আর পুরণ হলোনা।
রিয়াজ ভাই নিউ ইয়র্ক আসা মানেই কাজী মন্টু ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত, মোলাকাত এবং বিশেষ সময় কাটানো। মাঝে মাঝে মান অভিমান হতো তিনি বাসায় না এসে হোটেলে উঠলে । মন্টু ভাই ঢাকায় গেলে রিয়াজ ভাই প্রেস ক্লাব, ঢাকা ক্লাব সহ কতো জায়গায় ঘোরাঘুরি করতেন। মন্টু ভাই ও ভাবী দু’জনেই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বললেন, "আর কোনদিন এই প্রিয় মানুষটিকে দেখতে পাবোনা।" সেদিন মন্টু ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিলো সাপ্তাহিক হলিডে’র তাঁর সহকর্মী আকবর ইমাম ভাইকে নিয়ে। তাঁকে মন্টু ভাই হায়ারও করেছিলেন। আকবর ভাই আমারও খুব প্রিয় ছিলেন । তাঁর অনুপ্রেরনায় হলিডেতে বেশ ক’বার আমি লিখেছিলাম বিশেষ করে কুটনীতি নিয়ে। বহু বছর আগে আকবর ইমাম ভাই পরলোকে চলে গেছেন। তাঁর ছোটভাই সাইদ ইমাম জিলানী ভাই ইটালী প্রবাসী। মন্টু ভাই ও আমার চেনা তিনি। মন্টু ভাইকে নিয়ে হলিডে পত্রিকার সময়টা নিয়ে কথা হচ্ছিলো সেদিন।
বলছিলাম ‘কাজীর দরবার’ নিয়ে। তাঁর এখানে কতো বড় বড় সাংবাদিকদের আনাগোনা হয়! সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান (মিন্টু) থেকে বিচিন্তার মিনার মাহমুদ, বাসস’র কামরুল চৌধুরী, খ্যাতিমান ফটো সাংবাদিক আবু তাহের খোকন, নাসিমুন নাহার নিনি, ফাজলে রশিদ, হাসান মাসুদ, দিলীপ বড়ুয়া, পাভেল রহমান, শামসুল ইসলাম আলমাজি, মাহবুবুল আলম সহ আরও কতোজন তাঁর এখানে এসেছেন। মন্টু ভাইয়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ তিনজন- সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান মিন্টু , সম্পাদক মাহবুবুল আলম ও সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ - বহুবার এসেছেন!
মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে ভারতে এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিশন নিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজী মন্টু ভাই ঘুরেছেন। সেই দিনগুলোর কথা শুনে রোমহর্ষক মনে হয়। মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূত এনায়েত উল্লাহ খান মিন্টু ১৯৭৬ সালে কাজী মন্টু ভাইকে হায়ার করেন সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায়। তাঁর সাথে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রেখেও মন্টু ভাই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের নিউ নেশানে যোগ দেন '৮১ সালে। চীফ রিপোর্টার থেকে শুরু করে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এর মধ্যে চীন, আমেরিকা, ইউরোপ সহ বিভিন্ন দেশে আমন্ত্রণে ভ্রমন করেন ।
তিনি আনোয়ারুল ইসলাম ববি সাহেবের মর্নিং সান-এ যোগ দেন '৮৯ সালে। সেই কমলাপুরের অফিসে আমার বহুবার যেতে হয়েছে । ঠিক কিছুদিন আগেই আমি যে পত্রিকায়, ‘ডেইলী নিউজ’-এ, কাজ করতাম তার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। কথাবার্তা হলেও আমি ডেইলী স্টার-এ কাজ করিনি কিন্তু ইতিমধ্যে সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী ভাইজানের আমন্ত্রণে বিচিত্রায় ‘কুটনীতি‘ কলাম লিখছিলাম। এই কলামটি এর আগে লিখতেন
মতিউর রহমান চৌধুরী (সংক্ষেপে লেখা হতো 'ম চৌ' নামে) , ফারুক ফয়সল ('ফা ফ' নামে) এবং আমি লিখতাম 'আ হা কি' নামে।
কাজী মন্টু ভাই থাকাকালীন সময়ে মর্নিং সান এ জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন নুরুল কবির। অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন বলে তিনি একজন খ্যাতিমান, এবং অনেকদিন পর সম্পাদক হয়েছেন নিউ এইজ-এর। মন্টু ভাই আবার গেলেন নতুন মিশনে- দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায়, রিয়াজ ভাই সহ। দায়িত্ব নিলেন নিউজ এডিটর হিসেবে । নিউ নেশানে থাকার সময় মইনুল হোসেনের পাশাপাশি অনেক সখ্যতা ছিলো ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার
হোসেন মজ্ঞুর সাথেও। বিদেশী পত্রপত্রিকায় মজ্ঞু ভাইয়ের লেখালেখিতে বিশেষ সহযোগিতা থাকতো মন্টু ভাইয়ের। তিনি কয়েকবার এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে, সরকারের আমন্ত্রণেও আসেন । তারপর আবার মনস্থির করলেন এই দেশে, নিউ ইয়র্কে, থাকবেন। এখানে অনেকের খুব প্রিয় কাজী মন্টু ভাই ভালোই আছেন। তাঁর সাথে আমার আবার দেখা হবে, কথা হবে সেই অন্যজগত নিয়ে, ফেলে যাওয়া চলে যাওয়া সেই দিনগুলো নিয়ে।
১২ জানুয়ারী, ২০২২