।। পুরনো পালে নতুন হাওয়া……………।। দীর্ঘ ১৭ বছর পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আবারো অভিনয় করলাম গতকাল (২৫ ডিসেম্বর, '১৮)।  নাটকের নাম ‘আশ্রয়’। রচনা করেছেন ইরানী বিশ্বাস। অনুষ্ঠান প্রযোজক আফরোজা সুলতানা পরিচালনা করছেন এই নাটকটি। নাটকটি প্রচারিত হবে সম্ভবত আগামী জানুয়ারীর চার কিংবা পাঁচ তারিখ রাত ন’টায়।    প্রযোজকের প্রধান সহকারী তারেক ক’দিন আগে ফোনে আহবান জানালো এই নাটকটিতে অভিনয়ের। প্রযোজক আফরোজা সুলতানার সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিলনা। তারেকই যোগাযোগের সাঁকো হিসেবে কাজ করেছে।  একসময়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- নিজেকে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নেবো। কিন্তু কেনো জানি পারলাম না সেটা। মঞ্চে আবারো অভিনয় শুরু করেছি ‘গ্যালিলিও’ দিয়ে। গতকাল বিটিভি’র এই নাটক দিয়েই শুরু করলাম টিভি-অভিনয়। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ অবশ্য কো্নদিনই ছেড়ে দেইনি, সেটা এখনো চলছে পুরোদমে, চলবে আমৃত্যু।   প্রায় ৪৫ মিনিটের এই নাটকে (আশ্রয়) আমার সিকোয়েন্স মাত্র একটি। সংলাপ আছে সাকুল্যে আনুমানিক ৭/৮টি! চরিত্রটি আহামরি কোন চরিত্র নয়। এক দৃশ্যে অভিনয় করে ‘ফাটিয়ে’ দেবার কোন সুযোগ ওতে নেই। নেই তেমন কোন চমক! তারপরেও তারেকের কথায় কেন যে রাজী হয়ে গেলাম বুঝিনি, আজো বুঝতে পারছিনা, ঘোরের ভেতরে বিচরণ করছি যেন!   ২০০১ সালে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে আর কোনদিন বিটিভি’র স্টুডিওতে আমি ঢুকিনি। লম্বা সময়ের বিরতির পর গতকালই প্রথম গেলাম ওখানটায়।  স্টুডিওগুলো ঠিক তেমনই আছে- যেমনটি ছিল আগে। কিন্তু আগের মানুষগুলো (অধিকাংশই) আর নেই। অনেক কলাকূশলী, শিল্পী- এরমাঝেই চলে গেছেন না ফেরার দেশে। একজন ক্যামেরাম্যানও দেখলাম না- যিনি কীনা আমাদের সেই সময়টাতে (১৯৭৭ থেকে ২০০১) এই স্টুডিওগুলোতে ক্যামেরার পেছনে থাকতেন।  বিষয়টি আসলে মান্না দে’র সেই সুবিখ্যাত গানের বাণীর মত প্রায়! “সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবুও আছে সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই, একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি শুধু সেই সেদিনের মালী নেই। কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়,  কতজন এলো গেলো কত জনই আসবে কফি হাউজটাই শুধু থেকে যায়”!  পৃথিবীটা বড়ো বিচিত্র,  আর সময় খুব নিষ্ঠুর!  এখন অবশ্য পুরনো সেইসব ক্যামেরাম্যানরা থাকলেওবা কী এমন করতেন! থ্রি-ক্যামেরা অপারেশনের জায়গায় এখন ‘সিঙ্গেল-ক্যামেরা’ অপারেশন চলছে। তাতে একজন ক্যামেরাম্যান দিয়েই দিব্যি কাজ চলছে।  অবশ্য থ্রি-ক্যামেরা অপারেশনে অভিনয় করতে গিয়ে পুরো সিকোয়েন্সটি এক ‘টেক’-এ ধারণ করার সময় শিল্পীদের অভিনয়ের যে ইন্টেন্সিটি এবং টেম্পো কাজ করতো- এখন সেটা ব্যাহত হচ্ছে, আমি অন্তত তাইই অনুভব করেছি!  আজকাল অবশ্য হাজার হাজার প্যাকেজ নাটকে সিঙ্গেল-ক্যামেরা অপারেশনই কাজ হচ্ছে। আমি নিজেও একটি সময়ে প্রায় শ’তিনেক প্যাকেজ নাটকে (সিরিয়ালসহ) ক্যামেরা চালিয়েছি। কয়েকটি নাটকে ছিটেফোটা অভিনয়ও করেছি। সেগুলোর স্বাদ অবশ্য আলাদা!  কিন্তু আমরা যারা সত্তর দশকের শেষভাগ থেকে শুরু করে পুরো নব্বই দশক থ্রি-ক্যামেরা অপারেশনে অভিনয় করেছি বিটিভি’তে- তাদের জন্য ‘সেই চিরচেনা স্টুডিও’টিতে সিঙ্গেল-ক্যামেরা অপারেশনে কাজ করতে গিয়ে একটু বেখাপ্পা লাগতেই পারে- অস্বাভাবিক কিছু নয় বটে। মানুষ সবকিছুতেই এক সময়ে ধাতস্থ হয়ে যায়, আমিও মানুষ, আমিও হয়তো  হয়ে যাবো একদিন!   তবে একটি সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছি- এখন থেকে ‘টেলিভিশন নাটকে’ আবারো অভিনয় করবো নিয়মিত! সেটা প্যাকেজ কিংবা অন্যকিছু- যাইই হোকনা কেন! আপনাদের মতামত, পরামর্শ এবং আশীর্বাদ চাই। আমি বিশ্বাস করি- অভিনয় বিষয়টি একটি গুরুমুখী বিদ্যা। এই সুযোগে আমি আমার টিভি-নাটক এবং টিভি-অনুষ্ঠানের গুরুদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই, প্রণাম জানাই।  ১৯৭৭ সালে আমার আমার প্রথম টিভি অনুষ্ঠান’টির শিরোনাম ছিল- ‘প্রাণ তরঙ্গ’। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ছিল মোস্তফা মনোয়ারের। প্রযোজক ছিলেন দু’জন। বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী বেলাল বেগ এবং স্বদেশবাসী আলী ইমাম। ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা দিয়েই আমার টিভি-জীবনের যাত্রা শুরু।  টিভি-নাটকে প্রথম প্রযোজক নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। এরপরে তো হেন কোন প্রযোজক নেই- যাঁদের নাটকে আমি অভিনয় করার সুযোগ পাইনি। এই মুহুর্তে আমি কয়েকজন নাট্য প্রযোজক- আমি যাঁদের ছায়াতলে বেড়ে ওঠেছি তাঁদের নাম উল্লেখ করতে চাই কৃতজ্ঞতার সাথে। রিয়াজ উদ্দিন বাদশা, ফখরুল আবেদিন দুলাল, কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী, মোহাম্মদ আবু তাহের, খ ম হারূন, ফরিদুর রহমান, মাহবুবুল আলম, বদরুন্নেসা আব্দুল্লাহ, হাবিব আহসান কোহিনূর, জিয়া আনসারী, ম হামিদ, মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ,  আতিকুল হক চৌধুরী, মুস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, আব্দুল্লাহ আল মামুন। আরো যাঁদের নাম এই মুহুর্তে স্মরণ করতে পারলামনা- তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইছি।  স্টুডিওতে যাবার আগে প্রথমেই গেলাম টিভি-ক্যান্টনে। নতুনভাবে নির্মিত প্রায় সুরম্য একটি নাদুস-নুদুস দালানে এই ক্যান্টিনের অবস্থান। আগের চাইতে অনেক ফিটফাট এবং পরিচ্ছন্নও বটে। শিল্পীদের জন্য আলাদা কামরা রয়েছে। রয়েছে উচ্চ পদস্তদের জন্য আলাদা কামরা (ক্যান্টিনের একজন জানালেন)। বেশ ভালো লাগলো দেখে। কিন্তু টিভি ক্যান্টিনের পুরনো কিছু স্মৃতি মনে এসে হৃদয়টি কেনজানি একটু আর্দ্র হয়ে ওঠল!  ’৭৭ সালে বিটিভি ক্যান্টিন ছিল কীনা আমি স্মরণ করতে পারছিনা! বিটিভি’র একজন কর্মচারী এক কেতলী চা আর দুই প্যাকেট নাবিস্কো’র (ক্রীমসহ) বিস্কিট নিয়ে বসতেন ভবনের পশ্চিম কোণায়। ওই চা-বিস্কুট শেষ হয়ে গেলে আর কিছুই পাওয়া যেতনা খাওয়ার জন্য।  আমরা সেই সময়ে দুপুরে খাওয়ার জন্যে যার যার সাধ্য অনুযায়ী (আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) খাবার নিয়ে গিয়ে অনুষ্ঠানের সবাই মিলে ভাগ করে খেতাম অনেকটা ‘তবলীগ’ স্টাইলে! বেশ আন্তরিকতা ছিল তখন সবার মাঝে।

 এরপরে ক্যান্টিন হল বিটিভি ভবনের নিচতলার একটি কামরায় (শিল্প নির্দেশকদের কামরার পাশে)।  তারও পরে ক্যান্টিন চলে যায় টিভি ভবনের প্রবেশ পথের বাম পাশে। সেই ক্যান্টিনের একটি অসাধারণ স্মৃতি আমাকে আজো আবেগপ্রবন করে তোলে।  গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাঁর লেখা গান তখন সবার মুখে মুখে। বড়ো বড়ো শিল্পীরা ওঁর গান গাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতেন তখন।  ওই সময়ে একদিন নজরুল ইসলাম বাবু সেই ক্যান্টিনে বসে চা পান করতে গিয়ে হঠাৎ গানের কিছু কথা মাথায় এসে যায়! তখন তখনই তিনি গানটি লিখে ফেলার জন্য একটি কাগজ খুঁজতে থাকেন। কারো কাছে কোন কাগজ না পেয়ে অবশেষে বাবু তাঁর সিগারেটের প্যাকেটটি ছিড়ে তার ভেতরের সাদা অংশে যে গানের বানীগুলো লিখে ফেলেন সেটাই আজ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রতিটি সংবাদ প্রচারের আগে বাজতে থাকে (সব ক’টা জানালা খুলে দাওনা......)!  থাক ওসব পুরনো কথা। আজকের প্রজন্ম হয়তো কথাগুলো বিশ্বাসই করতে চাইবেনা!  স্টুডিওতে ঢুকেই প্রথমে আমার কো-আর্টিস্টকে খুঁজে নিয়ে রিডিং-রিহার্সাল করে নিলাম কিছুক্ষণ। আমি জানিনা, বিটিভি’র নাটক ধারণের আগে এখন আর আগের মত কমপক্ষে তিনিদিন মহড়া হয় কীনা!  আমার বিপরীতে যিনি ছিলেন- উনার নাম জোসনা।  ওহো, বলে রাখা ভালো- আমি এই নাটকে একজন রাশভারী বনেদী গৃহকর্তার (হিন্দু) ভূমিকায় অভিনয় করেছি।

 স্টুডিওতে শুধু একজন শিল্পীকে পেলাম যিনি আমাদের সময়ের। শিল্পী সরকার অপু। অপু দেখতে ঠিক তেমনিই আছেন। আগের মতই চিবিয়ে কথা বলেন, মৃদু হেসে! দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পরে বোধহয় উনার সাথে দেখা হল। একসাথে জলপান করলাম। পুরনোসব কথাবার্তা হল। জানালেন- উনার ছেলে এখন বেশ ভালো শিল্পী হয়ে ওঠেছে। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সর্বশেষ ফিল্মে উনার ছেলে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছে। শুনে বেশ আপ্লুত হলাম।  দেখা হল তরুণ অভিনেতা মুরাদের সাথে।  ও বরাবরই বেশ উচ্ছল। গতকালও তার কোন ব্যত্যয় দেখলাম না। পরিচয় হল অন্যান্য সব তরুণ শিল্পী কলাকূশলীদের সাথে। সবাই বেশ আন্তরিক। এরপরে, আজকাল যা হয়- চললো ছবি তোলার পালা।  এই নাটকের প্রযোজক আফরোজা সুলতানা বেশ চমৎকার মানুষ। আদ্যোপান্ত প্রফেশনাল। বলেন কম কিন্তু কাজ করেন বেশ! বেশ কো-অপারেটিভ। আর সহকারী তারেকের তো কথাই নেই।

সে বরাবরই প্রাণবন্তু, মাতিয়ে রাখে সবাইকে।  বিটিভি ভবন এবং চারপাশটা বেশ পরিচ্ছন্ন আর দেখতে বেশ নান্দনিক হয়েছে। বিটিভি’র বর্তমান মহা পরিচালক হারুন অর রশিদ সাহেব অবশ্যই ধন্যবাদ পেতে পারেন। হারুন সাহেব নিজেও একজন ভালো অভিনয় শিল্পী। এক সময় ‘আরণ্যক’ নাট্যদলে অভিনয় করতেন। সবচেয়ে মজার বিষয়- উনি কিন্তু 'মাউথ অর্গান' বাজিয়ে থাকেন বেশ ভালো। জানিনা, এই বিষয়টি ক’জনের জানা আছে!  গতকাল ২৫ ডিসেম্বর ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ডিআইটি’র ছোট্ট পরিসরে ‘ঢাকা টেলিভিশন’ যাত্রা শুরু করে। আর আমারও কী কপাল, বিটিভি’র জন্মদিনে টিভি-অভিনয়ে আমি পুনর্যাত্রা শুরু করার সুযোগ পেলাম। তারেক এবং নাট্য প্রযোজক আফরোজা সুলতানাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা- আমাকে এই দিনে ‘পুনর্যাত্রা' শুরু করার সুযোগ করে দেবার জন্যে।  যত যাই বলুন- অভিনেতা হিসেবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল কিন্তু এই বাংলাদেশ টেলিভিশনই। বিটিভি আমার পরিচয়ের অন্যতম স্তর। আমি কৃতজ্ঞ এই প্রতিষ্ঠান’টির  কাছে।  অনেক ভালো থাকুন বন্ধুগণ। জোয় হোক বাংলাদেশ টেলিভিশনের। --------------------------------------------------------------------   ছবিগুলো প্রধানত আমার প্রোডাকশন ম্যানেজার কামরুল হাসানের তোলা।December 26, 2018   ·