কাওসার চৌধুরী
।। নিছক লোহালক্কড়ের স্থাপনা নয়.........।।
অতি বর্ষণে পাটুরিয়া ফেরিঘাট প্লাবিত; জলমগ্ন দৌলতিয়া ঘাট! তীরে ভেড়ার কোন জায়গা পাচ্ছে না ফেরি! শত শত যাত্রীবাহী গাড়ি আর পণ্যবাহী ট্রাকগুলো সারি বেঁধে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে পাটুরিয়া আর দৌলতিয়া ঘাটে! নারী-শিশু আর বয়ষ্ক যাত্রীদের দূর্ভোগ চরমে! অজস্র পঁচনশীল কাঁচামাল পদ্মার দু’পাড়ে পঁচে গলে ধ্বংস হয়ে যাবার উপক্রম! এ যাত্রায় কয়েক’শ কোটি টাকার পণ্য আর সম্পদ নদীর ঘাটেই নষ্ট হওয়ার আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ধরণের সংবাদগুলো এখন থেকে আর খবরের কাগজে দেখা যাবে না! দেখা যাবে না টেলিভিশনের পর্দায়। কারন একটাই- পদ্মা সেতু। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হয়ে যাবার পর দূর্ভোগ আর সম্পদহানির এই ‘পুরনো চিত্রে’র অবসান হলো বলেই ধরে নেওয়া যায়। এখন সম্ভবত শুনতে হবে না- পদ্মায় ফেরি পারাপারে অসহনীয় জটের কারনে আটকে পড়া কোন রোগীকে এ্যাম্বুলেন্সেই প্রাণ দিতে হয়েছে। শুনতে হবে না পদ্মায় লঞ্চডুবিতে মৃত্যুর খবর। টিভি পর্দায় দেখতে হবে না- পদ্মায় নিখোঁজ যাত্রীদের স্বজনের উদ্বিগ্ন মুখ। শুনতে হবে না পদ্মায় সন্তান হারানো মায়ের বুকফাটা কান্না। না; এসব আর শুনতে হবে না বলেই বিশ্বাস করছি। বাস্তবতাও তাই। পদ্মা সেতু তার দূর্গম যাত্রায় উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশের মানুষের সেবায় বুক পেতে আছে!
সেতু বিভাগ ঘোষণা করেছে, আগামী ২০২৩ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলচল শুরু হবে। আশা করা যায়- পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচল শুরু হলে বরিশালে বসবাস করেই প্রতিদিন রাজধানী ঢাকা শহরে অফিস করার স্বপ্ন পূরণ হবে। মাদারিপুর, গোপালগঞ্জ, শরিয়তপুর, ফরিদপুর- এগুলো ঢাকার নিকটবর্তী জেলা। রেলপথ চালু হয়ে গেলে উল্লেখিত জেলাগুলোসহ- যশোর, নড়াইল, মাগুড়া, খুলনা থেকেও রাজধানীতে অফিস করা যাবে। এ কালে ১০০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল কোন দুঃস্বপ্নের বিষয় নয়; যেখানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে বুলেট ট্রেনের কথা ইতোমধ্যেই সরকারি প্রস্তাবনায় চলে এসেছে বলেই জানি।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সারাদেশের মানুষের মাঝে, বিশেষত পদ্মা সংলগ্ন ২১টি জেলার মানুষের মাঝে যে আবেগ উচ্ছাস পরিলক্ষিত হয়েছে, সেগুলো নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। মাত্র ৩ (তিন) ঘন্টায় ঢাকা থেকে বরিশালে পৌঁছে যাওয়া বয়ষ্ক বাস যাত্রীদের আনন্দাশ্রু দেশের মানুষ টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করেছে। পদ্মাপারের মানুষ একটি সেতুর অভাবে, ঘন্টার পর ঘন্টা ফেরিঘাটে কিংবা যাত্রীবাহী যানবাহনে যে নিদারুন সময় কাটিয়েছেন এতদিন, অবর্ণনীয় কষ্ট করেছেন- তার বর্ণনাও দেখা গেছে টিভি চ্যানেলগুলোয় আর পত্র পত্রিকার পাতায়। বিবিসি রেডিওতে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে অশীতিপর এক মানুষের আবেগভরা কথা শুনে নিজের অশ্রু ধরে রাখা সম্ভব হয় নি।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন- ‘পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হবে অর্থনৈতিক অঞ্চল’। তারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে এখনই! পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগকে ঘিরে মহাপরিকল্পনা নিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এই তিন বিভাগের ২১টি জেলায় নতুন করে ১৭টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) স্থাপনের পদক্ষেপ নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশের দক্ষিন ও দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে শিল্পায়ন গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান বেড়ে যাবে কয়েক গুণ।
ইতোমধ্যে ‘বেজা’ বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলায় ২০৫ একর জমি নিয়ে মোংলা ‘ইজেড’ স্থাপন করছে। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে তিনটি শিল্প নির্মাণে এরই মধ্যে জমি বরাদ্দের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর পাশে প্রায় ১০৫ একর জমিতে স্থাপন করা হচ্ছে আরেকটি ‘ইজেড’।
৫২৫ ও ৬৮৬ একর জমি নিয়ে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা ও গোসাইরহাট উপজেলায় দুটি ‘ইজেড’ স্থাপনে ‘বেজা’ গভর্ণিং বোর্ডের অনুমোদন রয়েছে। মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলায় ১ হাজার ১২৫ একর জমিতে ‘ইজেড’ স্থাপনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেই জানা যায়। এসব ছাড়াও ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনার বটিয়াঘাটা, মাগুরা, সাতক্ষীরা, বরিশালের আগৈলঝাড়া, কুষ্টিয়া এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারাতেও ‘ইজেড’ স্থাপনের পরিকল্পনা এবং কর্ম প্রক্রীয়াধীন আছে বলে জানা যায় (সমকাল ২৯ জুন, ২০২২)।
এসব মহাপরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে বদলে যাবে দেশের দক্ষিন এবং দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবয়ব। দেশের দক্ষিন এবং দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের এই উন্নয়ন শুধু নিজেদের এলাকাতেই নয় বরং বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন তথা জিডিপিতে যোগ করবে ইতিবাচক ‘মাইলেজ’। ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ যে ‘উন্নত দেশ’ হিসেবে নিজেদের অবস্থান নির্ণয়ের লক্ষ্য স্থির করেছে- তাতে এই উন্নয়ন প্রভাবকের ভূমিকা পালন করবে। প্রভাবক হবে পদ্মা সেতু।
আনন্দের দিনেও পেছন ফিরে তাকিয়ে দুঃখের সাথে বলতে হয়- পদ্মা সেতু নির্মাণের পথটি সহজ ছিল না। বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় (প্রধানত) নির্মাণের কথা ছিল পদ্মা সেতু! কিন্তু ‘দূর্নীতির’ অজুহাত দিয়ে নির্মাণ সহযোগিতা থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক! এখানেই থেমে থাকেনি এই প্রতিষ্ঠানটি। ওই সময়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি এক বিবৃতিতে বলেন, 'ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্পে বাংলাদেশকে ঋণ পেতে হলে অনেক ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। অনেক কথা মাঝে তিনি এটাও বলেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০১৪ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত) কোন পদ্ধতিতে হবে, সে বিষয়েও শেখ হাসিনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে বিশ্বব্যাংকের কাছে!' যেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’কেও হার মানায় তাদের ‘আব্দার’! শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি কানাডার আদালত। সত্যের জয় হয়েছে শেষ পর্যন্ত। জয়ী হয়েছে বাংলাদেশ, জয় পেয়েছে বাংলাদেশের মানুষ।
বিগত আড়াই হাজার বছরের খাতায় বাঙালির অনেক ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। সে সব ইতিহাস রচিত হয়েছে বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন সময়ের হাত ধরে। ওসব ইতিহাসের কোনটা বেশ উজ্জ্বল, কোনটা কালো, কোনটা আবার ম্রীয়মান! কিন্তু ২৫ জুন ২০২২ তারিখে, বাংলাদেশের ইতিহাসে যে নতুন পাতাটি যুক্ত হলো- তা শুধু বাংলাদেশই নয় ররং বিশ্বের জন্য এমন এক দৃষ্টান্ত- যা যুগে যুগে মানুষ স্মরণ করবে- ‘দৃঢতার, গর্বের আর প্রতিবাদে’র এক ইতিহাস হিসেবে।
পদ্মা সেতু লোহালক্কড়ের একটি স্থাপনাই শুধু নয়- এটা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার দৃঢতা, দূরদর্শিতা, দক্ষতা, আর সৎসাহসের উজ্জ্বল প্রতীক। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের একটি কবিতার ক’টি লাইন উদ্ধৃত করে বলেছেন- ‘সাবাশ, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী/ অবাক তাকিয়ে রয়ঃ /জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার/ তবু মাথা নোয়াবার নয়।’ বাংলাদেশ কোন ষড়যন্ত্র কিংবা কারো রক্ত চক্ষুর কাছে মাথা নোয়ায় নি, নোয়াবেও না কোনদিন।