২০০১ সাল থেকে আমেরিকায় যাতায়াত করছি। বিভিন্ন ক্যাটাগরীরর ৭টা ভিসা। এর মধ্যে দুটো ৫ বছরের মাল্টিপল ভিসা। ২০১৮ এর আগস্টে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় ভাবলাম ভিসাটা রিনিউ করে রাখি। কখন লাগে ঠিক নেই। ডিসেম্বরে ড্রপবক্সে (VSF অফিসে) পাসপোর্ট জমা দিলাম। পাঁচদিন পর ম্যাসেজ, তোমার পাসপোর্ট VSF অফিসে দেয়া হয়েছে। ভিসা নিয়ে কোন টেনশন নেই আমার। কিন্তু পাসপোর্ট হাতে নিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! ভিসা দেয়নি! একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়েছে। আমার ব্যাক্তিগত সাক্ষাৎকার নেবে। কয় কি! এতোগুলো ভিসা, সারাদিন ওদের সাথে ফুটুফাটাং করি! এর আগে কখনো ফরমাল ইন্টারভিউ হয়নি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেয়ার জন্য মূলত: যাওয়া। এখন লজ্জায় কাউকে বলতেও পারছি না।অনলাইনে ইন্টারভিউ এর ডেট পেলাম ফেব্রুয়ারীর শেষে। তাতেই সই। কোন তাড়াহুড়াও নেই। অবশেষে লাইন ধরে নানান ফরমালিটিস শেষ করে ভিসা অফিসার মহিলার সামনে। পাসপোর্টগুলো নেড়েচেড়ে দেখছেন। কোন কথা নেই। কিছুক্ষন পর আমি বললাম, লাইনে দাড়িয়ে আমেরিকান ভিসা নিতে আমার এই প্রথম আসা। তিনি বললেন, I know. জিজ্ঞাসা করলেন তুমি এতো প্যারিস যাও কেন! বললাম, ভালো লাগে। ইউরোপ গেলে আমি যাওয়া বা আসা প্যারিস হয়ে করি। I am in love with Paris. একটা পাসপোর্ট রেখে বাকীগুলো ফেরত দিলেন। সাথে একটা কাগজ। বললেন, প্রশ্নের উত্তরগুলো তাড়াতাড়ি ইমেইল করে দিও। বিগত ১৫ বছরের সে এক বিশাল তথ্য ভান্ডার যা এখন ভিসা ফর্মের সাথে সংযুক্ত করা। আমি কেন বলেছিলাম I am in love with Paris তার একটা প্রেক্ষাপট আছে।
ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য মুখস্ত করেছিলাম। তার মধ্যে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার একটা আশ্চর্য ছিল। ওই সময়েই আব্বা একটা লুডু কিনে দেন। সম্ভবত একপাশে ছিল সাপলুডু আর এক পাশে ছিল বিশ্বের বিখ্যাত সব জিনিষ আর জায়গার ছবি। সেই লুডু খেলতে গিয়ে বিগবেন ঘড়ি, চীনের প্রাচীর, মস্কোর ঘন্টা, মিশরের পিরামিড এসবের সাথে পরিচয়। কল্পনায় দেখতাম এসব জায়গার ছবি। বিদেশী স্টাম্প, কয়েন, কারেন্সী নোট আর ভিউকার্ড সংগ্রহের অভ্যাস তখন থেকেই। মিশরের নীল নদ, ইউরোপের সব থেকে দীর্ঘ দানিউব নদী এসবের নামও তখন জেনেছি।অল ইউরোপীয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবা) এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা তখনো শুরু হয়নি।
ইতালী থেকে নাসিম আমাকে অনুরোধ করলো বাংলাদেশ থেকে এই সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য। আমি শুভকামনা জানিয়ে শুরুতেই আমার অপারগতা জানালাম। এভাবে চললো প্রায় দুই মাস। এক পর্যায়ে নাসিম বললো এই প্রস্তাব যে কাউকে দিলে লুফে নেবে, আপনার সমস্যা কি! এক পর্যায়ে রাজী হলাম শুধুমাত্র আয়েবার প্রেস কনফারেন্সটা করে দিতে। সেখানে ঘোষনা হবে ২০১২ সালের ১-২ ডিসেম্বর এথেন্সে আয়েবার গ্রান্ড কনভেনশন এর। আমার ছোট অফিস তখন আয়েবার অস্থায়ী কার্য্যালয় হয়ে গেছে। বিবৃতি, কাগজপত্র তৈরীর সময় জানলাম কাজী এনায়েত উল্লাহ নামে একজন প্যারিস থেকে আসবেন প্রেস কনফারেন্স এ যোগ দিতে। আয়েবার বর্তমান সভাপতি ইন্জিনিয়ার জয়নুল আবেদীন সাহেব, মাঈনুল ইসলাম নাসিম, সাংবাদিক নুরুল ওয়াহিদসহ কয়েকজন তখন ঢাকায়।
২০১২ এর ১৪ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবের সাংবাদিক সন্মেলনে অন্যান্যদের সাথে যোগ দিলেন জনাব কাজী এনায়েত উল্লাহ, প্যারিসের বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী ও কমিউনিটি ব্যাক্তিত্ব যিনি ইনু ভাই নামে সমধিক পরিচিত। প্লেন থেকে নেমে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে চলে এসেছেন। কোন আনুষ্ঠানিক পরিচয়, কথা হলো না। সংবাদ সন্মেলন শেষে আমরা প্রেসক্লাবের নীচে কথা বলছি। বললেন, গাড়ীতে ওঠেন। চলেন আমার সাথে। গেলেন সোনারগাঁ হোটেলে।সেখানে উনার একটা অফিস আছে জানলাম প্রথম। এর পর আয়েবা নিয়ে আরো দুটো অনুষ্ঠান, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রনালয় আর চ্যানেল আইতে করলাম সবাই একসাথে। সেখানেই আমার দায়িত্ব শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল!নভেম্বরের মাঝামাঝি গ্রীস থেকে জয়নুল আবেদীন সাহেব ফোনে বললেন, তানবীর সাহেব, আপনাকে এথেন্স কনভেনশনে আসতে হবে।
আমি অপারগতা জানালাম এবং নাসিম এর সাথে আমার কি কথা হয়েছিল সেটা বললাম। তিনি বললেন, ওসব রাখেন আপনি না আসলে আমি লজ্জায় পড়বো। হাতে সময় কম। ভিসা করার সময়ও তেমন নেই। বললেন দেখি কি করতে পারি। এথেন্স এর বাংলাদেশ দুতাবাসের এনডোর্সমেন্ট পাঠালেন। আমার তখন ফেরার পথ নেই। ধুমধামের সাথে এথেন্সে গ্রান্ড কনভেনশন শেষ হলো। জয়নুল আবেদীন সাহেবকে সভাপতি এবং কাজী এনায়েত উল্লাহ সাহেবকে সেক্রেটারী জেনারেল করে আয়েবার ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কার্যকরী কমিটি হলো। আমাকে ইসিতে বাংলাদেশ কোঅর্ডিনেটর করা হলো।
পরদিন যে যার গন্তব্যে। আমার রিটার্ন টিকিট দুদিন পর এথেন্স থেকে ঢাকা। লবিতে ইনু ভাইদের সাথে দেখা। ওনারা প্যারিস যাচ্ছেন। আমাকে বললেন, আপনার ভিসা কতদিনের? প্যারিস চলেন আমাদের সাথে। বললাম যার আমন্ত্রনে এসেছি তার সাথেও তো ঠিক মতো কথা বলা হয়নি এখনো। বললেন প্যারিস আসেন। পরদিন নাসিম জানালো আমরা প্যারিস যাচ্ছি আগামীকাল। পড়লাম মহা ফাপড়ে। প্যারিসের টিকিট, ঢাকায় ফেরার ডেট চেন্জ এসব ঝামেলা কে করবে। ম্যাজিকের মতো সব হয়ে গেল। সম্ভবত ডিসেম্বরের ৪ বা ৫ তারিখে প্যারিস গেলাম। সেই যে বন্দী হলাম ইনু ভাইয়ের আতিথেয়তার কারাগারে আর বের হওয়া হলো না সেখান থেকে। ক্যাফে লুনা যেন সেকেন্ড হোম হয়ে উঠলো। জীবনে প্রথম দাঁড়ালাম আইফেল টাওয়ার এর সামনে। সে ছিল এক অন্য অনুভূতি! প্যারিস গিয়েছি শুনে আমেরিকা থেকে বোন বললেন প্যারিসের বিখ্যাত ক্যাবারে Moulin Rouge না দেখে আসবি না। ওই ক্যাবারের ন্যূনতম টিকিট ১৫০ ইউরো! একদিন সন্ধ্যায় লিটন ভাই (প্রয়াত ম্যাজিক লিটন) জানালেন আমরা চারজন Moulin Rouge এ যাচ্ছি। ইনু ভাই ব্যাবস্থা করেছেন।
এর পর গড়িয়েছে আরো ৮টি বছর। অনেক কথা অনেক স্মৃতি প্যারিস, আয়েবা, ইনুভাইকে নিয়ে। আয়েবার এক একটা মিটিং যেন এক একটা অধ্যায়। রাতভর আড্ডা দিয়ে ভোরে হোটেল রুমে ফেরা। পেয়েছি বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য বন্ধু, সুহৃদ এর ভালোবাসা।
অনেক কথা আছে, ভালোবাসা জমে আছে যা আপনাকে বলা হয়নি ইনু ভাই।হয়তো কখনো হবেও না। লিখবো কখনো। আমেরিকার ভিসা অফিসারও জানবে না আমার প্যারিস কাহিনীর কিছু। আমার ছেলে ভার্সিটিতে গেছে শুনে ওর জন্য দামী উপহার যে কতটা মূল্যবান সেটা ও না বুঝলেও আমি বুঝি।
শুভ জন্মদিন ইনু ভাই।
#KaziEnayetUllah