সুইডেন প্রবাসী কবি, সাংবাদিক এবং কলাম লেখক দেলওয়ার হোসেন একজন পোড়খাওয়া জীবনবাদী মানুষ। জীবনের নানান ঘাত- প্রতিঘাত পেরিয়ে নিজেকে শাণিত করেছেন তীক্ষ্ণ তরবারির মতো। চিকিৎসক পিতা মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। একজন শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে শহীদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন যখন ভূলুণ্ঠিত হয়, ঠিক তখনই তার কবি চিত্ত বেদনায় কুঁকড়ে ওঠে, প্রতিবাদে উদ্দীপ্ত
হয়।
আমাদের যাপিত জীবনে সমাজের নানান অসঙ্গতি, অনিয়ম, দুর্নীতি, অনাচার তাঁকে ব্যথিত করে। হৃদয়ের গহীন কোণে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু কথামালা দিয়ে তিনি সাজিয়েছেন তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ চন্দ্রাহত জ্যোৎস্নার পঙ্ক্তিমালা'।
এ কবিতাগ্রন্থে সবগুলো কবিতাই পাঠককে মুগ্ধ করবে, কিঞ্চিৎ হলেও চেতনায় টোকা দেবে। প্রথম কবিতাগ্রন্থ হলেও পাঠক নিশ্চয় হতাশ হবেন না, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় ।
,
দেলওয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৬০ সালে নীলফামারী জেলার রেল শহর সৈয়দপুরে। মা হামিদা বেগম, বাবা শহীদ ডাঃ এম এ আজিজ সরকার (জন্ম: ১৯২০, রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার ভেন্ডাবাড়ি ইউনিয়নের বেহবতপুর গ্রামে)। স্বাধীনতাকামী এই অকুতোভয় যোদ্ধা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সৈয়দপুরে স্বাধীনতাবিরোধী শত্রুপক্ষ বিহারিদের হাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন।
সেখানে তিনি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ৯ মার্চ, ১৯৭১ সালে রেলওয়ে কলোনিতে নিজ নিবাস ও ডিসপেন্সারিতে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন ও বিতরণ করে বিহারিদের টার্গেটে পরিণত হন। লেখক এই আত্মত্যাগী শহীদের চতুর্থ পুত্র সন্তান। লেখাপড়া করেছেন পীরগঞ্জের ভেন্ডাবাড়ি হাই স্কুল, সৈয়দপুর সরকারি টেকনিক্যাল হাই স্কুল এন্ড কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজীবনের শুরু থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখি করেছেন। ১৯৮০ সাল হতে বিভিন্ন সংবাদপত্রে নিয়মিত লিখছেন। মূলত দৈনিক ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক সচিত্র স্বদেশ, দৈনিক বার্তা, ঢাকা ব্যুরো, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, সাপ্তাহিক ২০০০-সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে। বর্তমানে দৈনিক জনকণ্ঠ সুইডেন প্রতিনিধি এবং কলামিস্ট হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। এছাড়াও নিয়মিত কলাম লিখছেন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রতিদিন, উত্তর আমেরিকা সংস্করণ-এ।
,
১৯৮৯ সাল থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোল্মে বসাবাস করছেন। তিনি সুইডিশ ফরেন প্রেস এসোসিয়েশনের সদস্য। চাকরি করেছেন সুইডিশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বলিষ্ঠ ধারক-বাহক দেলওয়ার হোসেন সুইডেন থেকে ‘প্রজন্ম একাত্তর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেছেন ।
প্রচার বিমুখ নিভৃতচারী লেখক নিয়মিত গল্প, কবিতা ও ছড়া লিখলেও রয়ে গেছেন প্রকাশ ও প্রচারের আড়ালে। তবে আত্মকথনে বিমুখ লেখক নৈতিক দায়বদ্ধতা কাঁধে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অকুতোভয় বাবার অপ্রকাশিত বীরত্বগাঁথা এবং সৈয়দপুরে সংঘটিত নারকীয় গণহত্যার ওপর এক প্রামাণ্য দলিল ‘মোর নয়া মিয়া আর ফিরি আসপে না' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
আমরা তার এ গ্রন্থের কয়েকটি কবিতা পাঠ করবো—
অক্ষমতা
যদি হতে পারতেম তোমার মতো গৃহত্যাগী নদী-
তবে হয়ে যেতাম ভাঙ্গনের কাব্য গাঁথা লেখার উদাস বাউল কবি ৷
2.
বিস্মৃতি
মনে রাখার স্মৃতি আজ সুদূর অতীত,
কেউ তো লেখে না এখন বুকের পাঁজর ভাঙ্গা দুঃখ জাগানিয়া গীত ।
৩.
গহীনের অশ্রু
তুমি অতল বেদনার অশ্রু ঝরাও বুকে,
আমি তো দেখি শুধু কালিমার কাজল—
তোমার বিষণ্ন চোখে ।
8.
স্মৃতির শব
না হয় ছিন্ন হয়েছে বন্ধন— তাতে কী?
তবুও তো মনে পড়ে তার মায়াবী কাজল চোখ, সুন্দর বিক্ষত হওয়া মনে— দেখি আজ স্মৃতির শব পড়ে আছে যেন হিমশীতল মৃত্যুর মতোই নিবর ।
৫.
শোক
ভরা বর্ষায় ভিজলো না চোখ ।
বারুদ বিস্ফোরিত আগুনে পুড়লো না হাত, খঞ্জরের আঘাতে রক্তাক্ত হলো না শরীর-
তবে ঝরা ফুলের শোকে হলাম শোকার্ত অস্থির।
৬. উপমা
কোথাও পেলাম না খুঁজে তোমাকে উজ্জ্বল—
জ্যোৎস্নার সাথে মেলাবার উপমা,
তুমি যে রয়ে গেলে শরতের বিষণ্ন নীলিমা।
৭.
দুঃখ বিলাস
সাড়া শব্দহীন অনন্তের মৌনতায় যে—
লালন করে সহিষ্ণুতা,
হৃদয়হীন না হলে কেউ কি বলে তাকে
দুঃখ বিলাসিতা ?
দিন শেষের ছায়া
দুঃখ আর গেল কই?
বেদনার আগুনে পুড়ে— পাঁজর করলাম অঙ্গার,
দুঃখ এসে বলে এখন তো সময়—
তোমার ওপারে যাবার !
৯.
শয্যা
এভাবে আর কতকাল দেখবো কীট—
কবলিত নষ্ট সময়,
সুদিনের অপেক্ষায় স্বপ্নচারী জীবন
পড়ে গেল রোগ শয্যায় !
১০.
লৌকিকতা
অন্তরে ভালোবাসা নেই এতটুকু,
অথচ দেখাও এক বুক
এ কাজ করে শুধুই উজবুক!
১১. অন্বেষা
সূর্য আর ওঠে না এই চরাচরে,
প্রতিটি ধূলিকণাই আজ বিষাক্ত
,
সেই বিষের ঘ্রাণে-পীড়িত আত্মা আমার— বকুল-বেলির গন্ধ খোঁজে খোঁপায় তোমার ।
১২.
পাথর প্রতিজ্ঞা
বর্ষা সমাগত হলেই জাগে ভাবনা,
তুমি দেশান্তরী হবে বর্ষার ঢলে—
আমি তো পড়ে থাকবো সেই বালুচরে,
আমি যে পারি না যেতে তাকে একা ফেলে !
১৩.
দৃষ্টি
না হয় অভিমানে বসে ছিলাম দূরে,
গহীনের আল পথ ধরে বুক চিরে বয়ে গেল নদী —
হয়তো জাগবে ফেরার আকুতি,
,
শ্রাবণ আকাশের উদারতা নিয়ে তাকাও যদি ।
১৪.
শূন্যতা
আমার তারা ভরা আকাশ কখনই ছিল না
চাইনি স্বপ্নের বসত-বাটি,
মুক্তাহীন অঞ্জলিতে ধরেছি কেবল অবহেলার ধুলোমাটি
তাই থাক না খাঁটি ।
১৫.
অবোধ শিশু
ধর্ম তুই ভয় দেখিয়েই করলি কাবু
সেই ভয়ে চিরকাল রয়ে গেলাম অবুঝ বাবু ৷
১৬.
মরুবাসী
আংটি থেকে খসে পড়া মুক্তা তোমাকে —
খুঁজে পাইনি অরণ্যের অন্ধকারে,
সেই অরণ্য আজ বিরান মরুভূমি
সেখানেই তুমি কীভাবে পড়ে থাকলে এতকাল ধরে !
১৭.
কাজল রেখা
মুখের ভাষা যতই দাও জলাঞ্জলি,
মুছতে কি পেরেছো এতটুকু চোখের জলের— অমোচনীয় কালি?
সেখানেই দেখি, কাজল কালিতে—
লেখা তোমার দুর্বহ বেদনার পদাবলি !
১৮.
নিয়মবন্দি জীবন
জীবন কি কারো ইচ্ছের মতো হয়— সবুজে-ফুলে ফলে শাখা ও পাতায়, সে যে হেমন্ত আসার আগে চৈত্রের— শুকনো পাতা হয়ে ঝরে যায় !
১৯.
মরুদিগন্তের পথিক
জানি না কতটা সুদূর বাঁকা পথ হেঁটে ক্লান্ত তুমি,
তোমার পথ চেয়ে বসে থাকা—
কোন পথিকের দৃষ্টি সীমায় তুমি যে ধূসর মরুভূমি ।
২০.
চাতক জীবন
পাজর চূর্ণ করে হেঁটে গেছো তুমি— বুকের আলপথ ধরে তারপর দেখা নেই,
আমি যে তৃষ্ণার দাহে জ্বলে— প্রতীক্ষায় বসে আছি,
সহিষ্ণুতার সুধা পান করে ৷
উপরের ২০টি কবিতা থেকে আমরা কবির যাপিত জীবনে সমাজের নানান ঘাত-প্রতিঘাতগুলো যে স্পর্শ করেছে— তারই এক সরল বয়ান উঠে এসেছে অবলীলায়। এ কবিতাগ্রন্থে এমন মোট ২৬৯টি কবিতা স্থান পেয়েছে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৬। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা মাত্র। প্রতিটি কবিতাই পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করবে। ‘এবং মানুষ প্রকাশনী থেকে জুন ২০২৩-এ প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থটি এখন রকমারি ডট কমসহ সর্বত্র পাওয়া যাচ্ছে। কবিতাগ্রন্থটির চমৎকার দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদ এঁকেছেন আল নোমান। কবির জন্য শুভকামনা রইল । কবিতাগ্রন্থটির বহুল প্রচার ও পাঠকপ্রিয়তা প্রত্যাশা করছি। কবিতার জয় হোক ৷
আনোয়ার কামাল
কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য আলোচক
ঢাকা ৷