বায়োস্কোপ-এর অনুষ্ঠান হয়ে নুরান নবী ভাইজানের ছেলের বিয়ের রাজকীয়, স্মরনীয় সম্বর্ধনায়

--আকবর হায়দার কিরন

ষোল জুলাই দিনটি যেন এবার জীবনের বিশেষ স্মৃতিময় হয়ে গেলো। আগের দিন, শুক্রবার লস এন্জেলেসের সাইফুর রহমান ওসমানী জিতু ভাইয়ের সাথে সকাল বেলায় অত্যন্ত আবেগময় ফোন কথোপকথন, বাবা, মা থেকে রোকেয়া হায়দার আপা ও সরকার কবীর উদ্দিন ভাইজান পর্যন্ত বিষয় নিয়ে। জিতু ভাই বললেন, মীর সাব্বির ভাইয়ের সিনেমায় প্লিজ যাবেন। জানালেন তিনি আপনাকে কল করে আমন্ত্রণ জানাবেন। কিছুক্ষন পর মীর সাব্বির ভাইয়ের কল। বেশ ক’বছর তাঁর সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো যখন আমার প্রিয় বন্ধু ও খ্যাতনামা নাট্য পরিচালক নির্মাতা ফেরদৌস হাসান রানার পাঠানো উপহার নিয়ে।

মীর সাব্বির ভাইয়ের নির্মিত 'রাত জাগা ফুল' পরিবেশনা সংস্থা বায়োস্কোপ ফিল্মস ইউএসএ-র স্বত্বাধিকারী জনাব রাজ হামিদ কল করে বললেন আপনাকে অবশ্যই দেখতে চাই। তিনি আবার আমার এক ভাতিজির জামাই বলে অনেকটা বেশ অবলিগেশনে পড়ে গেলাম। ভাবলাম অন্ততঃ কিছু সময় থাকার জন্য হলেও যাবো। প্রাথমিক ভাবে পরিকল্পনা ছিলো একসাথে যাবো আমার প্রিয় শিব্বীর দাদুর ( বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিক শিব্বীর আহমেদ) সাথে কিন্তু অবশেষে যেন অনেক ভালোবেসে লং আইল্যান্ড থেকে এসে তুলে নিয়ে গেলেন অর্গানিক আবিদ ( বিশিস্ট সাংবাদিক, ডিজাইনার এবং বর্তমান মুলধারার একজন ডাকসাইটে ব্যবসায়ী আবিদ রহমান) ভাই। তিনি জুমার নামাজ পড়ে খালি পেটে উল্কার মতো চলে এলেন আমাকে নিতে। ফ্লাশিং মেডোর বম্বে থিয়েটারে যথাসময়ে পৌঁছালেও দেখি লোকজন ফাঁকা।

ওখানে শুরুতেই দেখি অন্যদিক থেকে রাস্তা পার হয়ে আসছেন প্রিয় মেহফুজ ভাই ( খ্যাতনামা গীতিকার মাহফুজুর রহমান মেহফুজ) ও কয়েকজন সহ। খোঁজ করে মীর সাব্বির ও রাজ হামিদকে দেখা গেলোনা বাইরে, হয়তো ভেতরে কোথাও আছেন। এই সুযোগে উল্টোদিকে আফগান রেঁস্তোরা বাখতার-এ আবিদ রহমান আটজনের বাহিনী নিয়ে ঢুকলেন এবং অর্ডার করতে গিয়ে দেখা গেলো দেশী মানুষ। কিছুক্ষণ পর দেখি বাইরে যেন হঠাৎ অন্ধকার হয়ে এলো এবং ঝুম বৃষ্টি। অথচ এই আবহাওয়ার ফোরকাস্ট যেন জানা ছিলোনা। বম্বে থিয়েটারের সামনে এসে পৌছাবার পর ফোনে কথা হলো ছোটবোন মুন্নার সাথে। কিন্তু আকস্মিক বৃষ্টির কারনে সে রাস্তা পার হয়ে আফগান রেঁস্তোরায় আসতে পারলোনা।

অনেকদিন পর আবার ঢাকা থেকে ফিরে আসা আমাদের আনিসুল কবির জাসির এই অনুষ্ঠানে আসতে গিয়ে বৃষ্টির কারনে রাস্তায় আটকা পড়ে গেলো। খাওয়া শেষে দোকানের সামনে তাকিয়ে দেখি রাস্তা পানিতে সয়লাব হয়ে গেছে। পার হতে গেলে নতুন জুতোর ভেতরে পানি ঢুকে সর্বনাশ হয়ে যাবে। অপেক্ষার পর আল্লাহর রহমতে বৃষ্টি থেমে গেলো এবং কিছুটা পানি নামার পর কোনমতে টপকে রাস্তা পার হয়ে বম্বে থিয়েটারে আবার ফিরে গেলাম। কিছুক্ষণ পর মিলনায়তনে মীর সাব্বির ও রাজ হামিদের সাথে অবশেষে সাক্ষাত, কোলাকুলি ও করমর্দন । থিয়েটারের বেশ বেখাপ্পা শব্দের মাঝেও আনুষ্ঠানিক ভাবে রাজ হামিদ ও মীর সাব্বিরের অল্প কথার পর সিনেমা প্রদর্শন শুরু । কয়েক মিনিট দেখার পর রাজ হামিদকে লবিতে নিয়ে এসে বিশেষ সাক্ষাৎকার নিলাম বায়োস্কোপ ফিল্ম নিয়ে। সহযোগিতা করলেন আবিদ রহমান ও আনিসুল কবির জাসির। সিনেমা প্রদর্শনীর সময় অন্ধকারে মীর সাব্বিরকে আর খুঁজে পাওয়ার অপচেষ্টা করিনি, একটু সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া জানাতে। বোন মুন্নাকে আসার সময় বাই বলে আসতে পারিনি সিনেমা চলছিলো বলে।

আজ শনিবার সন্ধ্যায় আমাদের অত্যন্ত পরম শ্রদ্ধেয় ড. নুরান নবী ভাইজানের ছেলের বিয়ের রিসেপশন, অনুষ্ঠান হবে নিউ জার্সিতে, প্রায় দুই ঘন্টা দুরত্বে । নিহার সিদ্দিকী ভাই এখন বাংলাদেশে, মিনহাজ আহমেদ নিউ ইয়র্কের বাইরে বলে একসাথে বিয়েতে যাওয়া হলোনা। কিন্তু নবী ভাইয়ের আন্তরিক সহযোগিতায় সাহিত্য একাডেমীর মোশাররফ হোসেন ভাই সহ একসাথে যাবো। অবশ্য তিনি আমার অনেক কাছের মানুষ বলে দুর পাল্লায় সাথী হবো বলে যেন অপেক্ষায় ছিলাম। আবিদ ভাই আমাকে ড্রপ করতে আবার ড্রাইভ জ্যাকসন হাইটস এসে মোশাররফ ভাইয়ের কাছে। আজ আমার অনেক প্রিয় শিল্পী তানভির শাহীন ভাইয়ের ফ্লাশিং এর হিন্দু টেম্পল অডিটেরিয়ামে একক কনসার্টে যাওয়া হলোনা। কিন্তু আবিদ ভাই ও মেহফুজ ভাই আমাকে ড্রপ করে ওখানে যাবেন। রাস্তায় আমরা সবাই মিলে একটু গুনগুন করছিলাম। কিন্তু আমি যখন ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গাইতে শুরু করেছি মেহফুজ ভাই ও আবিদ তখন একেবারে চুপ করে থাকলেন। হয়তো খুব পছন্দ করলেন কারন এই গান যখনই করি তখন যেন হৃদয় থেকে আসে ।

নুরান নবী ভাইজানের অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে যাত্রায় বেশ কিছুটা দেরী হলো আমার এবং ট্রাফিকের কারনে। মোশাররফ ভাইয়ের সাথে যোগ দিলেন হোসনে আরা ভাবী, মিথুন ও ওর আম্মা। আমরা যখন পৌঁছালাম তখন প্রায় রাত আটটা। আলিশান হোটেলে পার্কিং করতে বলরুমে ঢোকার আগে যেন এক পশলা বৃষ্টি দিয়ে স্বাগতম জানানো হলো। রিসেপশনে ঢুকে দেখা গেলো রাজ্যের সব জানাশোনা মানুষজন। টেবিলে বসার আগে অনেকদিন পর মোলাকাত, করমর্দন, কোলাকুলি এবং ছবি তোলা। আহা মনে হলো নিহার ভাই থাকলে এই বিশেষ অনুষ্ঠানকে অত্যন্ত স্মৃতিময় করে তুলতেন । নবী ভাইয়ের অনেক স্নেহভাজন জাকারিয়া চৌধুরী দেশে থাকায় সবাই যেন তাকে মিস করছেন। বেদারুল ইসলাম বাবলা ভাইকে ফেসবুকে দেখছিলাম আরুবায় ভ্যাকেশনে কিন্তু দেখি এখানে। বললেন কালকে ফিরেছেন। ফোবানার সাথে আমার প্রায় তিনযুগের বন্ধুত্বের বাবলা ভাই ছাড়াও ফারুক আজম, মীর চৌধুরী, নাহিদ চৌধুরী, গোলাম ফারুক ভুইয়া , আবীর আলমগীর সহ অনেকের সাথে দেখা।

ফেরদৌস সাজেদীন ভাইজান , গোলাম ফারুক ভুইয়া, ফাহিম রেজা নুর, বিশ্বজিত সাহা, তানভীর রাব্বানী ও মোশাররফ হোসেন সহ বইমেলা নিয়ে যেন ছোটখাটো আড্ডা-মিটিং হয়ে গেলো এখানে। বইমেলার অন্যতম আহবায়ক নুরান নবী ভাইজানের অনুষ্ঠানে নাসিমুন নাহার নিনি আপা সহ সবাই মিলে আড্ডাতো খুব স্বাভাবিক । আমার টেবিলে পাশে বসা ছিলেন আবদুর রহিম বাদশাহ ভাই ও তাঁর স্ত্রী। ভাবীর বাড়ী ফেনীর তা জানা ছিলোনা। তিনি বললেন আমার জন্য অনেক দোয়া করেছেন যখন ঐ সময়টায় জীবন মরণ সন্ধিক্ষণে ছিলাম। কিছুক্ষন পর দেখা হলো প্রিয় অজন্তা সিদ্দিকী আপুর সাথে। এটা যেন অত্যন্ত আবেগপ্রবণ সময়। তিনি যেন একটি প্রিয় ভাইকে অনেকদিন পর দেখলেন তিনি জীবিত আছেন । তাঁর আন্তরিকতা আমার হৃদয় স্পর্শ করলো। অজন্তা আপুর সাথে প্রায় আড়াই যুগের কতো আন্তরিক জানাশোনা।

 

নুরান নবী ভাইজানের সাথে আমার প্রথম দেখা প্রায় ৩৫ বছর আগে ঢাকায় আমার কাজের অফিস ডেইলী নিউজ পত্রিকায়। একসাথে ছিলেন সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ ভাইজান ও পদ্মার ঢেউ রেডিও’র আশরাফুল ইসলাম ভাই। আমার মোহন দাদা ( বীর মুক্তিযোদ্ধা অকাল প্রয়াত মাহবুবুল হায়দার মোহন) ও নবী ভাইজানের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিলো। নবী ভাইজানের সাথে বহুবার ফোবানায় যোগ দিয়েছি । কিন্তু ফোবানা আমাকে আর সেই ভালোলাগা আকর্ষণ করেনা। ওদের দলাদলি ও কোন্দল আর ভালো লাগেনা। ফোবানার ভেতর ঢুকে পড়েছে কিছু চোর ছেছড়া ও কনভিকটেড ক্রিমিনাল। অথচ এই ফোবানা নিয়ে আমরা কতো সুন্দর সময় কাটাতাম নবী ভাইজান ও অন্যদের নিয়ে। আবার ফেরার পালা। মোশাররফ ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরলাম দিলরুবা আপা, সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ ভাইজান সহ অর্থকন্ঠ সম্পাদক এনামুল হক ভাইয়ের গাড়ীতে। যেতে যেতে যেন চায়না যেতে ফিরে ফিরে চায়। বিদায় নিতে যেন কষ্ট হয়। রাস্তায় ফেরার সময় আবার জীবনের গল্পে কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া। সম্প্রতি প্রয়াত আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কুটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, জাতিসংঘের আনোয়ারুল করিম চৌধুরী জয় ভাইকে নিয়ে অনেক গল্প এবং আরো কতো কি! মোহাম্মদ উল্লাহ ভাইজান বললেন, কিরন তোমার অসুস্থতার পর এস্টোরিয়া পার্কে বেশ ক’জন মিলে মিলিত হয়েছিলাম আমরা। আমরা আবার করতে চাই ছোট্ট একটি মিলনমেলা। প্রায় মধ্যরাতে বিদায় জানাতে বললাম, 'আবার হবেতো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো’।