বইটি পড়ে শেষ করলাম। বলা যায় যেন একটি তথ্যচিত্র দেখলাম। প্রতিটি পাতা পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল চোখের সামনে সব কিছু দেখতে পাচ্ছি- ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত কবি পাম্প সু পায়ে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ধানসিড়ি নদীর পার ধরে। তার কাঁধের ওপরে পাট করে ভাঁজ করা একখানি চাদর। দেখতে পাচ্ছি - আঁটোসাঁটো কালো কোট পরে লাজুক স্বভাবের এই শিক্ষক ক্লাসে ওয়ার্ডস ওয়ার্থের কবিতা পড়াচ্ছেন।
বইটি লিখতে গিয়ে লেখক আমীন আল রশীদ অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। জীবনানন্দ দাশ যেখানে যেখানে গেছেন, বাংলাদেশে ও ভারতে, লেখক মনে হয় তার কোনো একটি জায়গাও বাদ রাখেন নি। মনে হয় তিনি কবির পথ অনুসরণ করেছেন। ছুটে গেছেন তার পেছনে পেছনে। কবির জন্ম হয়েছে যেখানে সেই বাড়ি থেকে শুরু করে, যেখানে ট্রামের তলায় চাপা পড়ে কবির মৃত্যু হয়েছে, সবখানেই গিয়েছেন তিনি।
কোথায় যান নি লেখক - বরিশালে ব্রজমোহন কলেজের করিডোর, অক্সফোর্ড মিশন, লঞ্চঘাট, দিল্লিতে রামযশ কলেজ, বাগেরহাট কলেজ, ল্যান্সডাউনে নিমগাছ ছাওয়া বাড়ি, কলকাতার অলিগলি, শম্ভুনাথ হাসপাতাল যেখানে কবির মৃত্যু হয়, রাসবিহারি এভিনিউ- কিছুই বাদ যায়নি। জীবনানন্দের খোঁজে এখানে ওখানে সর্বত্র ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। এসব স্থানে কবির সঙ্গে যোগসূত্র আছে এরকম যাকে পেয়েছেন তার সঙ্গেই কথা বলেছেন।
কতো হাজার মানুষের সঙ্গে যে কথা বলেছেন লেখক - শিক্ষক জীবনানন্দের ছাত্র থেকে শুরু করে, তার আত্মীয় স্বজন, কবির দেখা পাওয়া লোকজন, জীবনানন্দ যেখানে যেখানে চাকরি করেছেন এবং যেসব বাড়িতে ছিলেন সেখানে যাদের খুঁজে পেয়েছেন, যেসব 'লোকের মাঝে বসে' কবি তার 'নিজের মুদ্রা দোষে' একা আলাদা হয়ে পড়তেন, তাদের সঙ্গেও কথা বলে কবির বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছেন।
বইটি লিখতে গিয়ে অজস্র বই পড়তে হয়েছে তাঁকে। আমার ধারণা জীবনানন্দ সম্পর্কে যতো গ্রন্থ আছে তার একটিও এই লেখকের পাঠ এড়িয়ে যায়নি। শুধু গ্রন্থ নয়, কবির লেখা চিঠি, কবিকে নিয়ে স্মরণিকা, সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট কোনো কিছুই বাদ পড়েনি। এসব গ্রন্থ আর লেখার রেফারেন্স দেওয়া আছে বইটির পাতায় পাতায়।
নিঃসন্দেহ বলা যায় এটি একটি অসম্ভব পরিশ্রম করে লেখা বই। দুই ধরনের পরিশ্রম - শারীরিক এবং মস্তিষ্কের পরিশ্রম। জীবনানন্দের সারা জীবনের পথ পরিক্রমা অনুসরণ করে এবং কবির নিজের লেখা কাব্যগ্রন্থ, গল্প ও উপন্যাসসহ তার ওপর রচিত বই পাঠ করে এমন একটি জীবনীগ্রন্থ রচনা করা চারটিখানি কথা নয়।
'জীবনানন্দের মানচিত্র' বইটিতে যেমন কবির ব্যক্তিগত জীবন খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় তার সময়ের মানুষ, সমাজ এবং প্রকৃতির অসাধারণ বিবরণ। যে নদীর কথা, যে কুয়াশার কথা, যে বিষণ্ণ পেঁচার কথা জীবনানন্দ লিখে গেছেন, বইটি পড়তে পড়তে পর তার সবকিছুই দেখা ও অনুভব করা সম্ভব।
বইটিতে কিছু ছবি সংযোজন করা হয়েছে। জীবনানন্দের ব্যবহৃত জিনিসপত্র, তার বাড়ি, কলেজ, এবং সেই বিখ্যাত কালো ট্রাঙ্ক যার ভেতর থেকে কবির মৃত্যুর পরে বের হয়ে এসেছিল বেশ কিছু অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি। এই ছবিগুলো খুব একটা পরিস্কার নয়। রঙিন হলে আরো বেশি স্পষ্ট হতো এবং কবির ভক্তদের হৃদয় স্পর্শ করতো বলে আমার ধারণা। এছাড়াও আরো কিছু অপ্রাসঙ্গিক বিষয় বাদ দেওয়া যেত। যেমন কবি স্টিমারে চলাচল করতেন সে কথা বলতে গিয়ে লেখক এই জলযানের ইতিহাস লিখে ফেলেছেন। এসব বিবরণ পাঠকের মনে বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে।
জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবি। সম্ভবত বাংলা ভাষায় সবচেয়ে প্রিয় কবি। আমার দুঃখে বিষাদে আনন্দে এবং সর্বোপরি রূপসী বাংলার খোঁজে সবার আগে আমি এই কবির দ্বারস্থ হই। এই কবির ওপর এমন পরিশ্রমী ও গভীর অনুসন্ধানী একটি গ্রন্থ রচনা করার জন্য লেখক আমীন আল রশীদকে অনেক ধন্যবাদ।