সরাফ আহমেদ 

সাবেক কূটনীতিক ও কলামিস্ট মহিউদ্দিন আহমেদ

 

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বহির্বিশ্বে প্রথমবারের মতো সবচেয়ে বড় সমাবেশ চলছে। একজন বক্তৃতা করছেন। বক্তৃতার মাঝখানে হঠাৎ জনতার মধ্য থেকে উল্লাসের ধ্বনি ভেসে এল। জনতার এ উল্লাসের কারণ সমাবেশ চলাকালে লন্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনের দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করতে এসেছেন। হাজার হাজার মানুষ চিৎকার করে উঠল, ‘জয় বাংলা! জয় বাংলা!’ প্রবাসীদের সেই জমায়েত দেশপ্রেমে দীপ্ত হয়ে আরও উচ্চকিত হয়ে উঠল।

 

স্বাধীনতার প্রশ্নে অটল প্রায় ১৫ হাজার বাঙালি যুক্তরাজ্যের ছোট–বড় নানা শহর থেকে বাস ভাড়া করে সেদিন সেই ঐতিহাসিক সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। সরকারি উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে স্বাধীনতাকামীদের পাশে দাঁড়ানো সেই মহিউদ্দিন আহমেদ সোমবার আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর মহান অবদানের কথা দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে অজানাই থেকে গেল।

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারের জমায়েত। 

 

বাংলাদেশ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মহিউদ্দিন আহমেদ সমন্ধে জানতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। প্রায় ৫১ বছর আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে প্রবাসে সবচেয়ে বেশি বাঙালি ছিল যুক্তরাজ্যে। সেই সময় প্রবাসে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস হামলা ও অত্যাচার ঠেকাতে ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত ছিল সেখানকার প্রবাসী বাঙালিরা। মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৭১ সালে লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশনে দ্বিতীয় সচিব পদে কর্মরত ছিলেন।

মহিউদ্দিন আহমেদ আমাকে জানিয়েছিলেন, ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রেস অ্যাটাচি আমজাদুল হক এবং দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব কে এম শিহাব উদ্দিন পাকিস্তান হাইকমিশনে পদত্যাগপত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থনের ঘোষণা দেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সেই বৈরী সময়ের অকুতোভয় কূটনৈতিক যোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমেদ স্বাধীনতার ইতিহাসে আমাদের মধ্যে চির অম্লান থাকবেন

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই দুজন বাঙালি কূটনীতিবিদ দেশপ্রেম আর স্বাধীনতার নজির উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। এর আগে বিশ্বে পাকিস্তানের আর কোনো কূটনৈতিক মিশন থেকে নিজ দেশের স্বাধীনতার দাবিতে সপক্ষ ত্যাগ করে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার ঘটনা ঘটেনি। এখানে উল্লেখ করা দরকার, মুজিবনগর সরকার তখনো গঠিত হয়নি। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এবং শপথ গ্রহণ করে ১৭ এপ্রিল, মুজিবনগরে, তখন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা।

মহিউদ্দিন বলেছিলেন, দিল্লির এই সপক্ষ ত্যাগের ঘটনা তাঁর মনেও দাগ কেটেছিল এবং ইউরোপে বাংলাদেশের সপক্ষে কূটনৈতিক ফ্রন্ট খুলতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি সেই সময় ভেবেছিলেন, ফ্রন্টের মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি প্রবাসে কূটনীতিকেরা স্বাধীনতার সপক্ষে কাজ শুরু করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ বহির্বিশ্বে আরও প্রাণ পাবে।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু প্রথম সংবাদ সম্মেলন করেন ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনের ক্লারিজ হোটেলে। বঙ্গবন্ধুর পেছনে (টাই পরা) মহিউদ্দিন আহমেদ

 

এ প্রসঙ্গে তিনি দৈনিক প্রথম আলোতে ২০১৫ সালের ১১ মার্চ ‘স্বাধীনতার মাস, লন্ডন’ ৭১: ৪ মুক্তিযুদ্ধের কূটনৈতিক ফ্রন্ট’ শিরোনামের প্রবন্ধে মহিউদ্দিন আহমেদ লিখেছেন, ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই “পূর্ব-পশ্চিম” উপন্যাসটিতে নিচে আমার সম্পর্কে উদ্ধৃত অংশটুকু এই ছোট্ট আলোচনার জন্য প্রাসঙ্গিক মনে করি: বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বদূত। তিনি নিপীড়িত, মুক্তিকামী পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের দাবির সমর্থনে দেশে দেশে প্রচার অভিযান চালাচ্ছেন।

ট্রাফালগার স্কয়ারে সব সময় টুরিস্টদের ভিড় লেগেই থাকে। আজ সেখানে চার থেকে পাঁচ হাজার বাঙালি এসে জড়ো হয়েছে। প্রথমে ১৩০ জন ব্রিটিশ এমপির স্বাক্ষরিত একটি আবেদন পাঠ করে শোনানো হলো, তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগার থেকে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেছেন। তারপর বিভিন্ন বক্তা শোনাতে লাগলেন বাংলার গ্রামগঞ্জে পাকিস্তানি সেনাদের অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনি। একজন প্রস্তাব তুললেন, পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসকে পৃথিবীর সব দেশের বয়কট করা উচিত। কারণ, তাদের যাত্রীবাহী বিমান বেআইনিভাবে অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বহন করে নিয়ে যাচ্ছে ঢাকায়।’

 

সাবেক কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমেদ আর নেই

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রবাসে, বেশি করে ইউরোপে স্বাধীনতার সপক্ষে কূটনৈতিক ফ্রন্ট খোলার বিষয়ে মহিউদ্দিন আহমেদ স্বপ্রণোদিত হয়ে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসেই পাকিস্তানি হাইকমিশন ছেড়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে প্রবাসে কাজ করবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সেই সময় লন্ডনে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসে কর্মরত শেখ আবদুল মান্নান প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত সব রকমের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গঠিত স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মহিউদ্দিন আহমেদের সপক্ষ ত্যাগ করার প্রস্তাব শুনে আবু সাঈদ চৌধুরী মহিউদ্দিন আহমেদকে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।

কিন্তু একাত্তরের ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারের সমাবেশ দেখে মহিউদ্দিন আহমেদ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সকাল সাতটার দিকে টেলিফোন করে আবু সাঈদ চৌধুরীকে বলেছিলেন, ‘স্যার, এত বড় একটি সমাবেশে যদি প্রকাশ্যে আমার পদত্যাগের ঘোষণাটি দিতে অনুমতি দেন, যুক্তরাজ্যের বাঙালি মহলে তো বটেই, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মিডিয়া জগৎ এবং কূটনৈতিক মহলেও ব্যাপক ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বলে আমার বিশ্বাস। নিজের কাছে খুব অপরাধ বোধ করছি স্যার।’
মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আবু সাঈদ চৌধুরী তখনই কিছু না বলে ১০ মিনিট পর তাঁর সিদ্ধান্ত জানাবেন বলে জানিয়েছিলেন। ১০ মিনিট পর তিনি আমাকে আমার অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর বাসায় যেতে বলছিলেন। দ্রুতই আমার গাড়িটি চালিয়ে তাঁর উত্তর লন্ডনের বাসায় চলে যাই। আমার স্ত্রীকে সেখানে রেখে স্যারের সঙ্গে ট্যাক্সিতে ট্রাফালগার স্কয়ারে গিয়েছিলাম।’

এই সপক্ষ ত্যাগের ঘটনা সেদিন বিকেল থেকে রেডিওতে প্রচার হলো। পরদিন লন্ডন টাইমসের ওভারসিজ নিউজ সেকশনে মহিউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন এবং গার্ডিয়ানের পেছনের পাতায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে সেই বৈরী সময়ের অকুতোভয় কূটনৈতিক যোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমেদ স্বাধীনতার ইতিহাসে আমাদের মধ্যে চির অম্লান থাকবেন।