বৃদ্ধ বয়সে পুষ্টি

 

খানম উম্মেদ নাহার হোমায়রা

কনসালট্যান্ট নিউট্রিশনিষ্ট ,এম,এইচ,শমরিতা হাসপাতাল এন্ড মেডিকেল  কলেজ।

 

মানুষের জীবনচক্রকে মোট ৪ ভাগে ভাগ করা হয়, যেমন- শিশু কাল, কৈশর, যৌবন ও বৃদ্ধ বয়স।  প্রাকৃতিক কারণেই মানুষ বৃদ্ধ হয়। সাধারণত ৬৫ বছর বা তার পরবর্তী সময়কে বার্ধক্য বলা হয়। তবে এর প্রায় ১০ থেকে ১৫ বছর আগে থেকেই বার্ধক্যের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে শারীরিক, মানুষিক এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় পরিবর্তন আসে যা পুষ্টির প্রয়োজনীয়তাকেও প্রভাবিত করে। এ সময় বিপাক হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পায়।

বৃদ্ধ বয়সে সংঘটিত কিছু পরিবর্তন খাদ্যের ধরণকে প্রভাবিত করতে পারে, যেমন পাচক রসের নিঃসরণ হ্রাস, অন্ত্রের গতিশীলতা হ্রাস এবং পুষ্টি উপাদানের শোষণ ও ব্যবহার হ্রাস।বিষণ্নতা এবং শারীরিক সীমাবদ্ধতা খাবার গ্রহণের ইচ্ছা বা এটি তৈরি করার  ক্ষমতা হ্রাস করে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই কতগুলো বার্ধক্যজনিত দীর্ঘমেয়াদী রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে যেমন- কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমে পরিবর্তন আসে যেমন- এথেরোস্ক্লেরোসিসের প্রকোপ বৃদ্ধি পায় এবং হৃদপেশীর পরিবর্তনের কারনে হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা হ্রাস পায়। কিডনীর কার্যকারিতাও এ সময় হ্রাস পায়। উদাহরণস্বরূপ, কিডনির মাধ্যমে রক্ত ​​​​প্রবাহের হার ৬৫ শতাংশ কমে যায়। 

গ্লুকোজ সহনশীলতা পরীক্ষায় দেখা গেছে, রক্তের শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক স্তরে ফিরে আসতেও অনেক বেশি সময় নেয়। বার্ধক্যের কারনে স্নায়ুতন্ত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটে যেমন-অনুভূতি হ্রাস পায়, দৃষ্টি শক্তি হ্রাস পায়, স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, আচরণে পরিবর্তন আসে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে চুল, ত্বক এবং নখেরও পরিবর্তন হয়। ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা ও কমে যায়। বার্ধক্যে যে পরিবর্তনগুলি নিয়ে আসে তা বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। বয়স্কদের খাবারের পরিকল্পনা সহজ রাখাই ভালো। পুষ্টির লক্ষ্য হওয়া  উচিত সহজ, সুষম, সামঞ্জস্যপূর্ণ খাবার প্রদান করা যা তাদের খাদ্যাভ্যাস এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক চাহিদার সাথে মানানসই।

পুষ্টি উপাদানের চাহিদা:

ক্যালোরি: বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্যালোরির চাহিদা হ্রাস পায়। অবসর জীবন, আর্থ্রাইটিস, কর্মক্ষমতা হ্রাসের কারনে ক্যালোরি গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে না দিলে ওজনাধিক্যের আশংকা থাকে। ২৩ বছর বয়সের পরে, প্রতি ১০ বছরে ক্যালোরির প্রয়োজন ৭.৫ শতাংশ হারে কমে যায়।  একই বয়সের দুজন ব্যক্তির  ক্যালোরির প্রয়োজনীয়তা ভিন্ন হবে কারণ প্রতিটি ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা এবং মৌলিক বিপাকের হারে পার্থক্য রয়েছে।  শর্করা: যেহেতু বৃদ্ধ বয়সে ক্যালোরির চাহিদা কম হয়, তাই শর্করা গ্রহণ নিয়ন্ত্রনের প্রয়োজন  বিশেষ করে সাধারন চিনি। জটিল শর্করা যেমন-গোটা শস্য, আলুর মতো খাবার অন্তর্ভূক্ত করার জন্য উৎসাহিত করা যেতে পারে। শর্করা জাতীয় খাবার মোট ক্যালোরি চাহিদার প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ হওয়া উচিত। বিশেষ করে বয়স্ক ব্যক্তির খাদ্যে অধিক পরিমাণে নরম আঁশযুক্ত খাবার অন্তর্ভূক্ত করা প্রয়োজন। কারন এই ধরনের খাবার অন্ত্রের কার্যকারিতা বজায় রাখতে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।

 

চর্বি: যেহেতু চর্বি শক্তির একটি ঘনীভূত উৎস, তাই খাদ্য তালিকায় কমপক্ষে ৪০-৫০ গ্রাম চর্বি থাকা উচিত। ৫০ বছর বয়সের পরে সিরাম কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।তাই, উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল রয়েছে এমন খাবার যেমন-ডিমের কুসুম, পূর্ন ননীযুক্ত দুধ, অর্গান মিট ইত্যাদি সম্পূর্নরুপে পরিহার করা উচিত। ঘি, চর্বি, মাখন, কেক, পেস্ট্রি, ক্রিম ইত্যাদি ফ্যাটি ফুড না খাওয়াই ভালো। ডায়েটে পর্যাপ্ত পরিমাণে পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ব্যবহার, মাংস থেকে সমস্ত দৃশ্যমান চর্বি বাদ দেয়া যা স্যাচুরেটেড ফ্যাট গ্রহণকে কমিয়ে দেবে। এই অপরিহার্য পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড উদ্ভিজ্জ তেল থেকে আসা উচিত। উদ্ভিজ্জ তেল গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয় যাতে অপরিহার্য ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।সয়াবীন, কর্ন, অলিভ অয়েল ইত্যাদি পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিডের ভালো উৎস।

 

প্রোটিন: বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে প্রতি বছর প্রোটিন সংশ্লেষনের হার হ্রাস পায়। বৃদ্ধ বয়সে ক্যালোরি চাহিদা কমে এলেও প্রোটিনের চাহিদার কোন তারতম্য ঘটে না।ক্যালরির চাহিদার প্রায় ১৫-২০ শতাংশ প্রোটিন সরবরাহ করা প্রয়োজন। তবে শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী এই প্রয়োজনের তারতম্য  হয়ে থাকে। অন্ত্রের সমস্যা, সংক্রমণ বা অসুস্থতা বা ওষুধের ফলে পরিবর্তিত বিপাকীয় সমস্যায় ভুগছেন এমন বয়স্ক ব্যক্তিদের তাদের প্রোটিন গ্রহণ যথাযথভাবে বৃদ্ধি করা বা হ্রাস করা উচিত। দৈনিক প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ কমপক্ষে ১.০ থেকে ১.৪ গ্রাম/কেজি হওয়া উচিত। যেহেতু দুধ ভিটামিন ও মিনারেলের পাশাপাশি প্রোটিনের ভালো উৎস তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ গ্রহণ করা উচিত। প্রতিদিনের প্রোটিনের চাহিদা পূরনের জন্য খাবারে মাছ, মুরগীর মাংস এবং ডিম রাখতে হবে।  

 

ভিটামিন: বৃদ্ধ বয়সের খাবারে ভিটামিনের গুরুত্ব সর্বাধিক।বিশেষ করে ভিটামিন-এ এবং ডি খাদ্যের মাধ্যমে সহজেই পূরন করা যেতে পারে। তবে খাদ্যে অপর্যাপ্ত চর্বি, অপ্রতুল পিত্ত নিঃসরন, ল্যাক্সাটিভ এবং অ্যান্টি-বায়োটিকের ব্যবহারের কারনে এই ভিটামিনের শোষন ও সঞ্চয় ব্যহত হতে পারে। এই সময়ে ভিটামিন-ডি গ্রহনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারন, এই বয়সে হাড়ের ক্ষয় খুবই সাধারন। চোখের বিভিন্ন রোগ ও রাতকানা রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভিটামিন-এ এর প্রয়োজন।  খাবারের মাধ্যমে এই চাহিদা পূরন না হলে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের মাধ্যমে এই চাহিদা পূরন করা যেতে পারে। এছাড়া অন্যান্য চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিনের চাহিদা খাদ্যের মাধ্যমে পূরন হতে পারে। সূর্যের আলো ভিটামিন-ডি এর অত্যন্ত শক্তিশালী উৎস।

 

বয়স্ক ব্যক্তিদের বি-ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের প্রয়োজন বিশেষ করে, থায়ামিন,পাইরিডক্সিন সায়ানোকোবালামিন এবং ফলিক অ্যাসিড। কারণ তাঁদের প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণ কমে যায়, সেই সাথে খাদ্য তালিকায় ভিটামিন গ্রহনের পরিমাণও কমে যায়। ভিটামিন-সি এর অভাবে কখনও কখনও স্কার্ভিও দেখা দেয়। যদি ফল ও সব্জি  থেকে পর্যাপ্ত ভিটামিন পাওয়া যায় তবে সাপ্লিমেন্ট হিসেবে গ্রহণের প্রয়োজন নেই।

 

খনিজ: আয়রন এবং ক্যালসিয়াম এই বয়সের জন্য ২টি গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান। ডায়েটে এই ২টি উপাদানের অভাব হলে তা সাপ্লিমেন্ট আকারে গ্রহণ করতে হবে। মহিলাদের আয়রনের চাহিদা সাধারণত পুরুষদের চাইতে বেশী থাকে, তবে এই বয়সে মেনোপজ হবার কারনে মহিলাদের চাহিদা পুরুষের সমান হয়ে থাকে। বয়সের সাথে সাথে ক্যালসিয়ামের শোষনও হ্রাস পায়, যার ফলে অস্টিওপোরোসিস হবার কারনে হাড় ভংগুর হয়ে পড়ে।

 

অস্টিওপোরোসিস এবং অ্যানিমিয়া 

প্রতিরোধে ক্যালসিয়াম এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।এই সময়ে দাঁত এবং মাড়ির ক্ষয় বৃদ্ধি  বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য খুব সাধারন। সঠিক স্বাস্থ্যবিধি এবং পুষ্টি দ্বারা এটি প্রতিরোধ করা যেতে পারে। পানি:এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটির প্রয়োজনীয়তা পরিবেশের সাথে পরিবর্তিত হয়। এই বয়সে প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমানে তরল গ্রহণ করা উচিত। বেশীর ভাগ বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এটি উপেক্ষা করা হয় যার ফলে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। তবে দিনে পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ এবং রাত্রে অতিরিক্ত তরল গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে যাতে ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। খাদ্য আশ: বয়স্ক ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত আঁশ গ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য ফল, শাকসবজি, গোটা শস্যের ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত। আঁশযুক্ত খাবার কোষ্ঠকাঠিন্য এড়াতে এবং শরীরের কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।

 

খাবার গ্রহণে নির্দেশিকা:১। শরীরের ওজন স্বাভাবিক রাখতে ক্যালোরি গ্রহণের পরিমানে সামঞ্জস্য রাখতে হবে।

২। চিনি, গুড়, গ্লুকোজ ইত্যাদি সহজেই রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ায় তাই এই বয়সে মিষ্টি জাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে।

৩। খাবারের পছন্দ বা অপছন্দ বিবেচনা করে খাদ্য পরিকল্পনা করা উচিত। যেমন-দুধ খেতে না পারলে দই, কাষ্টার্ড এবং পুডিং দেয়া যেতে পারে।

৪। খাবার চিবাতে সমস্যা থাকলে কিমা করা মাংস, মাছ, নরম রুটি, নরম ফল যেমন- পাঁকা পেপে, কলা, আম, তরমুজ ছোট টুকরা করে দেয়া যেতে পারে, এছাড়া নরম সব্জি, স্যুপ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।

৫। ভাজা খাবার যেমন - পুরি, সিংগারা, সমুচা, বিরিয়ানী ইত্যাদি দুষ্পাচ্য খাবার পরিহার করতে হবে।

৬। খাবার গ্রহনে অরুচি থাকলে সারা দিনের খাবারকে ৫ থেকে ৬ ভাগে ভাগ করে অল্প পরিমাণে দেয়া যেতে পারে।

৭।সকালের খাবার গ্রহণে বিশেষ গুরুত্ব  দিতে হবে।  

৮। ঘুমের সমস্যা থাকলে সন্ধ্যার পর চা বা কফি গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।

৯। প্রসাবের স্বাভাবিক পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য সারা দিনে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

১০।  দুশ্চিন্তা এবং একঘেয়েমি এড়াতে এবং 

স্বাভাবিক স্বাস্থ্য বজায় রাখতে প্রতিদিন হাঁটাচলা ও শারীরিক পরিশ্রম আবশ্যক।