নন্দিনী লুইজা

 “এই পৃথিবী যাদের ঘামে গড়া, তারাই কেন সবচেয়ে অবহেলিত?”—প্রতিবার মে দিবস এলেই এই প্রশ্নটি নতুন করে জেগে ওঠে। ইতিহাসের পাতা থেকে শুরু করে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা পর্যন্ত খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, শ্রমিক দিবস কেবল একটি দিন নয়—এটি একটি আন্দোলনের চেতনা, একটি দাবির ভাষা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দিবসের আদর্শ ও বার্তা কি কেবল ক্যালেন্ডারের একটি তারিখে সীমাবদ্ধ, নাকি আজও বাস্তব প্রেক্ষাপটে এর প্রযোজ্যতা আছে।   ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টার দাবিতে শুরু হওয়া শ্রমিক আন্দোলন এবং হে মার্কেটের রক্তাক্ত ঘটনা শ্রমিক দিবসের জন্ম দেয়।

এই সংগ্রাম কেবল সময়ের সীমার প্রশ্ন ছিল না, এটি ছিল শ্রমিককে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লড়াই। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এই দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর থেকে পৃথিবীর বহু দেশে মে দিবস সরকারি ছুটি ও সম্মানজনক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে।  প্রতি বছর ১ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস—মে দিবস। কিন্তু একবিংশ শতকের এই দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়: সত্যিই কি শ্রমিকের মুক্তি ঘটেছে? নাকি এই দিনটি এখন কেবল আনুষ্ঠানিকতা আর ফাঁকা প্রতীক হয়ে উঠেছে—যেখানে সংগ্রামের মর্মবাণী হারিয়ে যাচ্ছে শব্দের ছায়ায়?

 অগ্রগতি যতটা দৃশ্যমান, বাস্তবতা ততটাই কঠিন অস্বীকার করা যাবে না—বিশ্বের অনেক দেশেই শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, নির্ধারিত কর্মঘণ্টা, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সামাজিক সুরক্ষা আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO)-এর ভূমিকা এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর ক্রমাগত প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী শ্রম-অধিকারের কথোপকথনকে এগিয়ে নিয়েছে। তবে এই সাফল্যের আড়ালে রয়েছে এক জটিল বাস্তবতা—বিশ্বব্যাপী শ্রমিক মুক্তি এখনো অসম্পূর্ণ, খণ্ডিত, এবং বহুক্ষেত্রে প্রতারণামূলক।  নতুন শতকের নতুন শ্রমিক শোষণ আগের মতো কেবল কারখানার চৌহদ্দিতে সীমাবদ্ধ নেই; এটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে, যেখানে উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল হলো উন্নয়নশীল দেশের সস্তা শ্রম, আর মুনাফার ভরকেন্দ্র উন্নত দেশের করপোরেট বোর্ড রুমে।

 যদিও শতবর্ষ পার হয়েছে, কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়: শ্রমিকেরা কি আজ স্বস্তিতে আছেন? কাজের নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, চিকিৎসা ও বিশ্রামের নিশ্চয়তা—এসব কি তারা আদতে পেয়েছেন?  বিশ্ব শ্রম সংস্থা (ILO)-এর ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রায় ২০০ কোটির বেশি মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, যাদের অধিকাংশের নেই কোনো শ্রম আইন, স্বাস্থ্যসেবা বা সামাজিক সুরক্ষা। আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় শ্রমিকরা আজও অমানবিক পরিবেশে কাজ করছেন। এমনকি উন্নত দেশগুলোতেও গিগ ইকোনমি ও অস্থায়ী চাকরির কারণে শ্রমিকেরা চুক্তিবদ্ধ নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত।   শ্রমিকদের আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রযুক্তিগত রূপান্তর।

অটোমেশন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-নির্ভর শ্রম ব্যবস্থার কারণে শ্রমিকরা ক্রমাগত কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন। বিশেষ করে যেসব দেশে দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সীমিত, সেখানে এই পরিবর্তন বৈষম্য আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।  বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তৈরি পোশাক শিল্পে বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাদের মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি নারী। এই শ্রমিকেরা দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪% উৎপাদনে ভূমিকা রাখেন, অথচ তাদের গড় মাসিক বেতন দীর্ঘদিন ছিল মাত্র ৮০০০ টাকা বা তারও কম।  ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মজুরি বাড়িয়ে ১২৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও, বাজারমূল্যের তুলনায় এটি এখনো অপ্রতুল। জাতীয় শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার থাকলেও, বাস্তবে তারা বারবার হয়রানি, চাকরিচ্যুতি এবং আইনগত হুমকির মুখে পড়ে।  ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসে সেখানে ১,১৩৪ জন শ্রমিক নিহত হয়েছিলেন, সেটি শ্রমিক নিরাপত্তা ইস্যুকে আন্তর্জাতিক মনোযোগে আনলেও, এখনও দেশের বহু কারখানায় নিরাপত্তাবিধি মানা হয় না।  

শুধু স্মারক দিবস না, হতে হবে আন্দোলনের ভাষা, সমস্যা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই মে দিবস একটি ছুটির দিনে রূপ নিয়েছে—যেখানে নেতারা বক্তৃতা দেন, কিছু ফুল দেয়া হয়, তারপর সব আগের মতোই চলতে থাকে। অথচ মে দিবস হওয়া উচিত সচেতনতা গড়ার, শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠার, ও শ্রমনীতিতে কার্যকর পরিবর্তন আনার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম। শ্রমিকদের বর্তমান সমস্যা হচ্ছে— আধুনিক প্রযুক্তির কারণে কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা অস্থায়ী, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রথা, মজুরির বৈষম্য, ট্রেড ইউনিয়নের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতি।  মে দিবস যদি সত্যিকার অর্থে বাস্তবমুখী করতে হয়, তবে কেবল বাণীতে নয়, নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। কিছু কার্যকর প্রস্তাব নিতে হবে।  ১. ন্যায্য মজুরি নির্ধারণে শ্রমিক প্রতিনিধিদের যুক্ত করা।  ২. কারখানায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া ৩. গিগ ও অনানুষ্ঠানিক খাতকে শ্রম আইন কাঠামোর আওতায় আনা।  ৪. প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকারে কূটনৈতিক সক্রিয়তা বৃদ্ধি।  ৫. শিক্ষায় শ্রমিক অধিকার অন্তর্ভুক্তকরণ এবং যুব সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি।  আজকের বিশ্বে পণ্য উৎপাদন ও ভোগের ব্যবস্থাটি একটি বৈশ্বিক চেইনে আবদ্ধ।

উদাহরণস্বরূপ, একজন বাংলাদেশি শ্রমিক যে পোশাক তৈরি করেন, তা বিক্রি হয় নিউ ইয়র্ক বা লন্ডনের নামি দোকানে। অথচ সেই শ্রমিকের আয় সেই পণ্যের মাত্র ১%-এর সমান! এই বৈষম্য দূর করতে হলে শ্রমিক দিবসকে একটি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন হিসেবে তুলতে হবে। মে দিবস তখনই সফল, যখন এটি শুধুই অতীত স্মরণে সীমাবদ্ধ না থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য লড়াইয়ের হাতিয়ার হয়ে উঠবে। শ্রমিকের মর্যাদা রক্ষা না করে কেবল অনুষ্ঠান করা মে দিবসের সাথে একপ্রকার প্রতারণা।  আমাদের এখন প্রয়োজন—শ্রমিককে কেবল উৎপাদনের হাত হিসেবে নয়, সমাজ গঠনের অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা। তাহলেই মে দিবস কেবল স্মরণ নয়, বাস্তব  পরিবর্তনের হাতিয়ার হবে।