মো: সিরাজুল ইসলাম

 ১৯৭৭সালের ফেব্রুয়ারি মাস। আমি গ্রামের স্কুলের ৫ম শ্রেণিতে পড়ি। পেশায় কৃষক,মননে আধুনিক বাবার সাথে ঢাকায় গেলাম চাচার বাসায়। রাজধানী শহর দেখার আনন্দে দিন কাটছে। এক সকালে দীর্ঘ দেহধারী,সুপুরুষ চেহারার ডেপুটি সেক্রেটারী চাচা অফিসে যাবেন,আজীমপুর গভর্ণমেন্ট স্টাফ কোয়ার্টার থেকে। গাড়ি আসবে। সকাল ৭টার খবর রেডিওতে জুড়ে দেয়া। এ খবর শুনেই তাঁর অফিসে যাবার অভ্যাস। হাফ প্যান্ট পরা আমিও তার কক্ষে প্রবেশ করে রেডিওতে কান রেখেছি। আগের রাতে টিভি দেখেছি। গ্রামের বাড়িতে আব্বার সাথে রেডিওতে খবর,নাটক,গান শুনি। তবে ভরাট কন্ঠে সেদিন রেডিওর খবরের উচ্চারণ আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল।অফিসে যাবার আগে রেডিওর খবর শুনে বের হতে দেখে এর গুরুত্ব বুঝতে শিখলাম। সে ঘরের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে পদ্মা প্রিন্টার্সে ছাপানো ১৯৭৭ সালের বাংলাদেশ বিমানের ক্যালেন্ডার। ঝলমলে পাতা উল্টে দেখতে থাকলাম। ‘আমি এইটা নেবো’ বলে আবদার করেছিলাম। ভালোবাসার বেশ কিছু স্মারকের মধ্যে সেই ভারী ক্যালেন্ডার নিয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। কথাগুলো মনে এলো নন্দিত সংবাদ পাঠক ‘সরকার কবীরূদ্দীনের ডায়েরি’বইটি হাতে এলে। বাংলাদেশ বিমানের প্রকাশনার দায়িত্ব পেয়ে সে বছর এবং পরের বছর উন্নতমানের ক্যালেন্ডার ছাপতে অক্লান্ত শ্রম দিয়েছিলেন সরকার কবীরূদ্দীন,যা প্রিয় সংবাদ পাঠকের লেখা সুখ-স্মৃতিকে সামনে নিয়ে এলো। চুয়াডাঙ্গার আব্দুল্লাহ ভাই বইটি উপহার পাঠিয়েছেন। স্মৃতি তাড়িত হয়ে কলম নিয়ে বসলাম। সেই ছেলেবেলা থেকে রেডিওর ভক্ত এই আমার জন্য এ বই এক অনন্য সংগ্রহ। সরকার কবীরূদ্দীন আমার দৃষ্টিতে সংবাদ পাঠকদের মধ্যে এক জীবন্ত কিংবদন্তী।তাঁর লেখার অনেকগুলো অনুষঙ্গ আমার ভালোলাগার জগতে যাদুর কাঠি ছুঁয়ে দিয়েছে। শৈশব থেকে রেডিও হয়ে আছে আমার নিত্যসঙ্গী। জ্ঞান-বিনোদনের পিপাসা মেটাবার প্রিয়তম বন্ধু। বাবাকে দেখাদেখি রেডিওকে সাথী করে বেড়ে উঠেছি। কাফি খান,সরকার কবীরুদ্দীন,রোকেয়া হায়দার,নাজমা চৌধুরী,সেরাজুল মজিদ মামুন-এঁরা সংবাদ পরিবেশনের আইকন। রেডিওর গায়ক,অভিনেতা,কন্ঠদাতা,সংবাদ পাঠকগণ আমার স্বপ্ন জগত জুড়ে থাকেন। সিনেমা দেখে যেমন আপন হয়ে ওঠেন নায়ক-নায়িকারা। যাঁর কথা বলছি,তিনি তো সিনেমার রূপালী পর্দায় নায়কও ছিলেন। ছোটবেলা থেকে কিছু পছন্দের গানের একটা‘নতুন নামে ডাকো আমায়’ যে আমার প্রিয় সংবাদ পাঠকের অভিনীত সিনেমার গান। তবে এসব জেনেছি অনেক পরে। উঠতি বয়সে বেশিরভাগ মানুষেরই জীবনের একটা লক্ষ্য থাকে-বড় হয়ে কী হবো? হ্যাঁ,আমিও হতে চেয়েছিলাম। তবে ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক,অফিসার এইসবের কিছু না।রেডিওতে প্রিয় মানুষদের খবরপড়া শুনে শুনে আমি স্বপ্ন দেখতাম সংবাদ পাঠক হবার। প্যানোরমা,মার্কিন পরিক্রমা বাবার সংগ্রহ থেকে দেখতাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালে,১৯৭৯ সাল থেকে বৈদেশিক বেতারে চিঠি লিখতাম। রেডিও পিকিং,রেডিও মস্কো,ভয়েস অব আমেরিকার অনুষ্ঠান শুনে চিঠি লিখে অনুষ্ঠানসূচি,পত্রিকা,ক্যালেন্ডার,ডাকটিকিট এরকম উপহার সংগ্রহ করতাম। ইরানী নিউজ লেটার এর গ্রাহক ছিলাম। এতে করে ডাকপিওনদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। ছোট্ট,ফর্সা,ধূতিপরা,পান চিবানো পোস্টমাস্টার কৃষ্ণপদ সেন এর নজর কাড়ি। তাঁর বাহুডোরে বাধা পড়ি। রেডিওতে জ্ঞানসমৃদ্ধ হয়ে,লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করে,১৯৯৫ সালে ১৫তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি পেলাম ডাক বিভাগে, পোস্টাল ক্যাডারে। সহকারী পোস্টমাস্টার জেনারেল পদে যোগ দিয়ে আড়াই বছর চাকরি করেছি। সে চাকরিকালে বৃহত্তর ফরিদপুরের অনেক স্থানে,সারাদেশে ঘুরেছি। আমার প্রিয়তম মিডিয়া স্টার এর বাবা পোস্টাল সার্ভিসে ছিলেন, ফরিদপুরের প্রত্যন্তে কাজ করেছেন,এতেও কোথায় যেন আমি তাঁর আত্মার সান্নিধ্য অনুভব করছি।লেখাপড়ার অনেকখানি করেছি আমার শহর ফরিদপুরে। সরকার কবীরূদ্দীন এ শহরে শৈশবের কিছুদিন কাটিয়েছেন পড়ে আরো অনেকখানি আপনার করে ভাবতে পারছি তাঁকে। কোলকাতার সন্নিকটে মধুপুর নানা বাড়ি,খিদিরপুরে শৈশব,দেশভাগে পূর্ববাংলায় চলে আসা,স্কুল জীবন শুরু করা, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কথা,এভাবে জীবনের গল্পগুলো টুকরো করে বলে গেছেন তিনি। নৈতিকতা শিক্ষা, শিক্ষার গুরুত্ব,শিক্ষকের ভ‚মিকাও চমৎকারভাবে  উপস্থাপন করেছেন। শিক্ষার জন্য চাই জীবন-ঘনিষ্ঠ পরিবেশ। তাঁর দৃষ্টিতে শিক্ষকতা বহুলাংশে কেবল পেশা নয়,মানুষ তৈরির দরগা বা আশ্রম। অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ দর্শন বিতরণ করে শিক্ষার্থীর অনুসন্ধিৎসা জাগিয়ে তোলেন একজন আদর্শ শিক্ষক।

এভাবে গড়ে ওঠে তার মনন। সে মননে গড়ে ওঠে ছন্দোময় জীবন-অনেকটা এভাবেই সরকার কবীরূদ্দীন শিক্ষক আর শিক্ষকতার নির্যাসটুকু দেয়ার চেষ্টা করেছেন। আর আমিতো শিক্ষকতার নেশায় ফিরে এসেছিলাম আবারো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে। কর্মজীবন অতিবাহিত করেছি সরকারি কলেজের অধ্যাপক হিসেবে। আদর্শ মায়ের সতর্ক সিদ্ধান্তে,উঠতিকালে লেখাপড়ায় সিরিয়াসনেস না থাকায়,তাঁকে মামার কঠোর শাসনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেখানে থেকে ম্যাট্রিকুলেশন উৎরাতে পেরেছিলেন,উদাহরণ দিয়ে বলার চেষ্টা করেছেন। সরকার কবীরূদ্দীন তাঁর বইতে লেখাপড়ার গল্পে গ্রাজুয়েট হবার অকপট সত্য উচ্চারণ করেছেন। নির্মোহ ব্যক্তি প্রকৃতি তুলে ধরেছেন। একসময় রাষ্ট্ধসঢ়;্রীয় কর্মীবাহিনীর বৈশিষ্ট্য হতো রাষ্ট্ধসঢ়;্রীয় স্বার্থ রক্ষা করা। নিরপেক্ষ ভ‚মিকায় থাকা। পিআইএ এবং বাংলাদেশ বিমানের সাবেক প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে অনেক প্রসঙ্গ তাঁর বইএ তুলে এনেছেন।

বিমানের হাল ,আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথা বলেছেন। কয়েকজন রাষ্ট্ধসঢ়;্রপ্রধানের সান্নিধ্যের বর্ণনা রয়েছে তাঁর এ বইতে। আইউবের উন্নয়ন দশক নিয়ে সরকার কবীর প্রামাণ্য চিত্র করেছেন। করাচি থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নিজে পালিয়ে এসেছেন স্বাধীন বাংলাদেশে। শেখ মুজিবের সহায়তায় স্ত্রী পরিবারকে ফিরিয়ে এনেছেন। বিমানের কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে রাওয়ালপিন্ডি গেছেন। আবার প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাথে পাকিস্তান গেছেন ১৯৭৭সালে। জেনারেল এরশাদ এর সাথেও বৈদেশিক সফর করেছেন। তাঁর লেখায় রাষ্ট্রনায়কদের চেনা যাবে আলাদা করে। সার্ভিসের মান বজায় রাখায় দক্ষ,অনন্য পাবলিক রিলেশন্স পারফর্মার এবং মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সরকার কবীরূদ্দীনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল এমনই। কর্মসূত্রে তাঁর কয়েকটি বৈদেশিক ভ্রমণের গল্প ভালোলাগবে পাঠকের।

এ বইতে ৭২ পৃষ্ঠার লেখার পরে ৮ পৃষ্ঠাব্যাপী গেøাসী অফসেট পেপারে ৩৩টি দুর্লভ রঙিন ছবি স্থান পেয়েছে শেষাংশে। পাকিস্তান পর্ব, ইউএস পর্বের ছবি রয়েছে। বাংলাদেশ পর্বের২/৩টি ছবি রয়েছে। তার মধ্যে ঢাকা ছেড়ে যাবার কালের,শ্রেষ্ঠ টেলিভিশন সংবাদ পাঠক পুরস্কার:১৯৭৬ এর ক্রেস্টের ছবি স্থান পেয়েছে। তাঁর অভিনীত তিনটি সিনেমা: নতুন নামে ডাকো ,নতুন ফুলের গন্ধ,মায়ার সংসার এ অভিনয়ের কিছু গল্প বলেছেন। সিনেমা ছেড়ে আসার কারণটাও জানিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশে বিশ্ব হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ আলী’র রাজকীয় সংবর্ধনার গল্প নিয়ে এসেছেন চমৎকারভাবে। ভালোবেসে কর্মে মনোযোগী হলে সফল হওয়া যায়-এই জীবন সঞ্চিত অভিজ্ঞতা পাঠককে ভাগ করে দিয়েছেন। করাচীতে কলেজে পড়াকালে রেডিও-টিভিতে খবর পড়া,চাকরি,ঢাকায় এসে সিনেমায় অভিনয়ের,বিজ্ঞাপনে কন্ঠ দেবার ব্যস্ততম দিনগুলির স্মৃতির দিনলিপি তুলে এনেছেন।

পারিবারিক পরিচয়,পরিবারের ভেতরের কিছু কথা এনেছেন প্রসঙ্গক্রমে। কাশ্মিরী কন্যা নিশাত গুল-কে স্ত্রী হিসেবে কাছে পাবার সব কথা বলতে চাননি। খোলাশা করেননি লেখক। ফ্লাপে দেয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। ভিওএতে সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী হবার গল্প পাঠককে বলেননি। ছোট গল্পের মতো শেষ করেও যেন শেষ করেননি। অবশ্য প্রথম ফ্ল্যাপে একটি আশাবাদ রেখেছেন-‘আরো সিরিয়াস কিছু লেখার ইচ্ছে আছে।’ আমরা ভক্ত পাঠক শ্রোতাক‚ল প্রতীক্ষায় রইলাম,ঢাকা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী হবার গল্পসহ আরো কিছু আগামীর লেখায় উপহার দেবেন। বলিষ্ঠ গড়নের শ্মশ্ধসঢ়;্রুমন্ডিত পাঠান পুরুষ যেন বারান্দায় বসে প্রিয় বই বা ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছেন গভীর অভিনিবেশে।

গোধূলি রঙের প্রচ্ছদে মেরুণ রঙের শার্টের উপর সোনালী কোটি পরা সরকার কবীরূদ্দীনের এমনতরো ছবি দারুণ মানানসই হয়েছে। বইএর কভার পরিকল্পনায় মুন্সীয়ানার ছাপ রয়েছে। বইটি স্ত্রীকে উৎসর্গ করেছেন এই বলে ‘আমার এটু জেড জীবনসঙ্গী নিশাত কবীর।’ পাক জমানায় ব্যবহৃত আড্ডা সংক্রান্ত গুলতানী শব্দটাকে বইএর লেখায় ফিরিয়ে এনেছেন। ফেসবুকে আশীর্বাণী হিসেবে তাঁর ব্যবহৃত ‘কল্যাণ হোক’ কথাটাকেও একাধিকবার প্রয়োগ করেছেন।  সরকার কবীরূদ্দীনের ডায়েরি,ফকির সেলিম সম্পাদিত সরকার কবীরূদ্দীনের আত্মকথা। একসময়ের প্রখ্যাত ডিএক্সার,বেতার শ্রোতা সংগঠক,ভয়েস অব আমেরিকা বাংলার শুভানুধ্যায়ী,যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আকবর হায়দার কিরণ,এ ডায়েরি সংকলনে সহায়তা করেছেন। ফকির সেলিম এবং কিরণভাইকে ধন্যবাদ জানাই ভক্তক‚লের জন্য পাঠ পিপাসা মেটাতে এমন প্রকাশনায় তাঁরা উদ্যোগী হয়েছেন।

সিনেমার নায়ক,বিমানের কমকর্তা নয়, আমি বিশ্বাস করি তাঁকে পরিচিতি দিয়েছে সংবাদ পাঠক হিসেবে। সরকার কবীরূদ্দীনের লেখা পাঠককে নিয়ে যাবে অদেখা করাচীতে,কাবুল,কান্দাহার,লন্ডন কিংবা তায়েফ,টোকিও বা কায়রোতে। উন্মোচন করে দেবে ভুলে যাওয়া স্মৃতিকে। সরকার কবীরূদ্দীনের এ বই আমার ভালোলাগার আরেকটি জানালা খুলে দিয়েছে। যদিও বইতে বানান বিভ্রাট রয়েছে নেহায়েত কম নয়। ৮০ গ্রাম অফসেট কাগজে ছাপা বইটির অঙ্গ সৌষ্ঠব খুবই চমৎকার। মিডিয়াপ্রীতির,সংস্কৃতিসেবী, কিংবা দেশকাল ইতিহাসে আগ্রহী ব্যক্তি অনেকেই বইটির প্রতি আগ্রহী হবেন। বইটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। সরকার কবীরূদ্দীনের ডায়েরি,অনন্যা,ঢাকা,প্রথম প্রকাশ, ফেব্রæয়ারি,২০২৫,পৃষ্ঠা সংখ্যা ৯০,মূল্য:৩০০/- টাকা।

মো: সিরাজুল ইসলাম অধ্যাপক,রাষ্ট্রবিজ্ঞান সরকারি বিএল.কলেজ,খুলনা-৯২০২