অনুশোচনাহীন শেখ হাসিনার ফেরা না ফেরা , ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া, শেখ হাসিনার কি রাজনীতিতে আর ফিরে আসার সুযোগ আছে? শেখ হাসিনা কি তার ভাষায় ‘চট করে’ দেশে ঢুকতে পারবেন? মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে নিজ থেকে তার দেশে আসার সম্ভাবনা কতখানি? শেখ হাসিনার ফাঁস হওয়া ফোনকলের বক্তব্য, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ইত্যাদি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কি চাঙ্গা করে তুলছে? ইদানীং রাজনীতির ময়দানে মাঝেমধ্যেই এমন প্রশ্ন উঠছে। কখনো কখনো তা উত্তাপও ছড়াচ্ছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভার্চুয়াল সভায় শেখ হাসিনা নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দেন। এ বক্তৃতায় তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, ছাত্র সমন্বয়ক বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের তীব্র সমালোচনা করেন। এক্ষেত্রে তার ভাষা ছিল চিরাচরিতভাবে শালীনতাবর্জিত এবং কোনো কোনো জায়গায় বেশ আক্রমণাত্মক। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে দলের চার থেকে পাঁচ হাজার নেতাকর্মী নিহত ও আহত হওয়া, দেশের শেয়ারবাজার থেকে লক্ষ কোটি টাকা পাচার, ব্যাংক লুটপাট, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ করেন। তার অভিযোগের মধ্যে আরও ছিল যে, দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৩০ হাজার মামলা দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা ‘উন্নয়নের’ ফিরিস্তির বর্ণনা দিয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরে ‘সোনার বাংলা’ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনার বক্তব্যে গত দেড় দশকে বিশেষ করে শেষ ১০ বছরে দেশকে সবদিক থেকে যে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার জন্য অনুশোচনা তো দূরের বিষয়, দুঃখ প্রকাশ করে সামান্য দু-চারটি কথাও ছিল না। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টে যে বিরাট সংখ্যক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, সেজন্য তার কণ্ঠে সমবেদনার কথাও উচ্চারিত হয়নি। উল্টো তিনি এ সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রফেসর ইউনূস এবং সমন্বয়কদের দায়ী করেছেন। শেখ হাসিনা জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানকে চক্রান্ত হিসেবেই দেখছেন। অথচ কর্তৃত্ববাদী শাসনের কারণে তিনি যে চোরাবালিতে পা ঢুকিয়েছিলেন, তা তিনি বুঝতে পারেননি অথবা বুঝতে চাননি। শেখ হাসিনা
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভার্চুয়াল সভায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, এর বিপরীতে তার শাসন আমলের বাস্তব অবস্থার কিছু পুনরুল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে হয়। পৌনে এক শতাব্দীর পুরোনো রাজনৈতিক দল যার নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছিল, সেই দলের সভানেত্রী তিন-তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করেছেন। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদও একপর্যায়ে নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সে সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংকে দিল্লি থেকে উড়িয়ে এনে নির্বাচনে যেতে এরশাদকে চাপ দেওয়া হয়। এরশাদ মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। পরে গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) কর্মকর্তাদের দিয়ে এরশাদকে অসুস্থ সাজিয়ে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। এভাবেই নির্বাচনে যেতে বাধ্য করা হয় এরশাদকে।
নির্বাচনের আগে তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপিসহ বিরোধী দলকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে, নিয়ম রক্ষার জন্য এই নির্বাচন (২০১৪) করতে হচ্ছে। পরে সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। সেই প্রতিশ্রুতি আর রক্ষা করা হয়নি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। সে সময় শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার ‘অঙ্গীকার’ করেন। তিনি সেদিন বিরোধী দলের নেতাদের বলেছিলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন।’ তার সেই অঙ্গীকার পুলিশ বাহিনী ‘রাতের ভোট’ করে বাস্তবায়ন করেছিল। আর ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচন তো ‘আমি-ডামি’র নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পায়। নির্বাচনের ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই নগণ্য। ভোটাররা পর্যায়ক্রমে নির্বাচনবিমুখ হয়েছে। এভাবে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। এ তো গেল নির্বাচন প্রসঙ্গ। এবার মানবাধিকার, আইনের শাসন প্রসঙ্গে কিছু বলতে হয়।
গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং আয়নাঘর করে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকার দেশে ভয়ের সংস্কৃতি চালু করে। তার পতনের পর এসব ঘটনা একের পর এক বেরিয়ে আসছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশে অসংখ্য গুমের ঘটনায় পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিকের সম্পৃক্ততা মিলেছে। ১৪ ডিসেম্বর গুমের ঘটনা তদন্তে সরকারের কমিশন তাদের প্রথম তদন্ত প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়। যেখানে এই তথ্য প্রকাশ পায়। পুলিশ বাহিনীকে ‘পেটোয়া বাহিনীতে’ পরিণত করা হয়। প্রশাসনকে রাষ্ট্রের প্রশাসন হিসেবে চলতে না দিয়ে দলীয় প্রশাসনে পরিণত করা হয়। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত সরকারের হস্তক্ষেপ ছিল স্পষ্ট। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। নিজস্ব বলয়ের ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দিয়ে ব্যাংক দখল, লুটপাট, অর্থ পাচার নিয়মে পরিণত হয়। মন্ত্রী-এমপি, প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা, দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা দুর্নীতিতে মেতে ওঠেন।
দুর্নীতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে, গণতন্ত্র নয় যেন দুর্নীতিকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্যই দুর্নীতির ভয়াবহতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। তিনি ওই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমার বাসার কাজের লোক ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ করেছে। হেলিকপ্টার ছাড়া সে চলে না। জানার পর আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। কার্ড ‘সিজ’ করে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে।” সাতটি ব্যাংকের দখল নেয় এস আলম গ্রুপ। কোনো কোনো ব্যাংক দখলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (ডিজিএফআই) সহযোগিতা করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর অক্টোবর মাসে বিদেশি এক গণমাধ্যমকে জানান যে, ‘শেখ হাসিনার শাসন আমলে তার ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা (১৭ বিলিয়ন ডলার) সরিয়েছেন।’ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটেছে। এই চুরির ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের আজও চিহ্নিত করা হয়নি। রিজার্ভ চুরির ঘটনা তদানীন্তন গভর্নর ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
৬ থেকে ৭টি ব্যাংকে এমন পর্যায়ে লুটপাট হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই ব্যাংকগুলো গ্রাহকের ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে পারেনি। এ নিয়ে গ্রাহক ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে অসংখ্য অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ওই ব্যাংকগুলোকে সরবরাহ করেছে। আওয়ামী আমলের ১৫ বছরে ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে প্রাক্কলন করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। শ্বেতপত্র কমিটি দুর্নীতির প্রধান খাত হিসেবে ব্যাংক, ভৌত অবকাঠামো, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ এবং তথ্যপ্রযুক্তিকে চিহ্নিত করেছে। শ্বেতপত্র কমিটির তথ্যমতে, এক দশকে বিদেশে লোক পাঠানোর নামে দুর্নীতি হয়েছে ১৩ লাখ কোটি টাকা। বড় প্রকল্পের দুর্নীতির কারণে ১ লাখ ৬১ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অপশাসনের কারণ গণতান্ত্রিক জবাবদিহির অভাব, যার পেছনে রয়েছে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রতারণার নির্বাচন। এর পরের একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার গড়ে ওঠে, যা রক্ষায় ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ, আমলাদের একটি অংশ এবং এলিট ব্যবসায়ীদের মধ্যে আঁতাত গড়ে ওঠে। উন্নয়নবিরোধী এই আঁতাত দেশের আইন, বিচার এবং নির্বাহী বিভাগকে ক্ষয়িষ্ণু করার পেছনে ভূমিকা রাখে।
বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ ও আন্দোলন উপেক্ষা করে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। ‘শ্বেতহস্তী’ এই প্রকল্প সুন্দরবনের সর্বনাশের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ভারতকে খুশি করতেই এই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিশেষ বিশেষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়। তাদের জন্য আইন করে ‘দায়মুক্তি’র ব্যবস্থা করা হয়। এসব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতা হত্যাকাণ্ড। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা গণঅভ্যুত্থান দমন করতে ছাত্রসহ দেড় সহস্রাধিক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ৬০ শিশু। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে আহত হয়েছে ২০ সহস্রাধিক। এদের মধ্যে চোখ হারিয়েছে কয়েকশ মানুষ। হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে অনেকের। যারা এখনো ‘ট্রমা’র মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, দেশের অর্থনীতিকে খাদের কিনারে নিয়ে যাওয়া, পুলিশকে পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত করা, দুর্নীতির বিষ বৃক্ষরোপণ, সর্বোপরি জুলাই-আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রধান দায় সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার ওপরই বর্তায়।
দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের দায় তিনি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেন না। এসব কিছুর জন্য তার ভেতর বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বা দুঃখবোধ নেই। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভার্চুয়াল সভায় দেওয়া শেখ হাসিনার বক্তব্য বরং প্রমাণ করে যে, ৫ আগস্ট পতনের পর ভারতের আশ্রয় নেওয়ার সাড়ে চার মাস অতিবাহিত হলেও তিনি আত্মসমালোচনা দূরে থাক, সম্ভবত আত্মজিজ্ঞাসারও মুখোমুখি হননি। এদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ১৭ অক্টোবর ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী’ অপরাধের দুই অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর প্রবাসে অবস্থান করা শেখ হাসিনা দিল্লিতে আশ্রয় নেন। একপর্যায়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে তিনি দেশে ফিরে আসেন। সে সময় বিমানবন্দরে দলের নেতাকর্মীরা তাকে বিপুলভাবে অভ্যর্থনা জানান; কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিদ্যমান বাস্তবতায় শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আবারও ফিরে আসার সুযোগ কোথায়? লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক