দীপংকর চক্রবর্তী দাদা- আবার হবেতো দেখা !
আকবর হায়দার কিরন
ডিসেম্বর ৬ শুক্রবার ছিলো আমার সাম্প্রতিক জীবনের বিশেষ দিন। সেই চল্লিশ বছরের অনেক চেনা, অনেক আপনজন দীপংকর দাদার সাথে অবশেষে সরাসরি দেখা হলো জ্যাকসন হাইটসের ডাইভার্সিটি প্লাজার ইত্যাদি রেস্তোরায়। ভয়েস অব আমেরিকায় যখন ছিলেন তখন তাঁর যে কন্যাটির জন্ম ওর সাথে কিন্তু বছর দু’য়েক আগে দেখা হয়েছে এখানেই। মেয়েটি তার একেবারেই অদেখা কিরন কাকুকে একেবারেই চিনতে পেরেছিলো। প্রচন্ড ঠান্ডার ভেতর অনেক দুর ব্রকলীন থেকে এসে, অনেক কস্ট করে আমার আন্তরিক আমন্ত্রনে এলেন। আমার যেন মনে হলো আশা পুর্ন হলো অনেকদিন পর। রোকেয়া হায়দার আপা মাঝে মাঝে আমায় বকা দিয়ে বলছিলেন ‘ কিরে তাঁর সাথে কেন এখনো দেখা হলোনা কেন?
নভেম্বরে দীপংকর দাদা ও বৌদি ওয়াশিংটন ডিসি বহু বছর পর আবার গেলেন এবং ঐতিহাসিক সময় কাটালেন । বিব্বু আপু ( শেগোফতা নাসরিন কুইন) তাঁর বাসায় যেন অত্যন্ত স্মৃতিময় প্রীতি সম্মিলন আয়োজন করেছিলেন। দীপংকর দাদা বিব্বু আপুর বাবা খন্দকার রফিক একই সময়ে ভিওএতে কাজ করেছেন । ইকবাল বাহার ভাই, সরকার কবীর ভাই, রোকেয়া আপা সহ অনেকে মিলে যেন সত্যিকার ঐতিহাসিক সময়। অসুস্থতার কারনে যোগ দিতে পারেননি মাসুমা খাতুন আপা। আমাদের ফকির সেলিম ঠিক সেদিন ঢাকায় গিয়েছিলেন বলে খুব মিস করেছেন । আমিতো সেদিনের সন্ধ্যায় ছিলামনা কিন্তু দারুন সব ছবি দেখে কমেন্ট করেছিলাম ‘নস্টালজিক ও অনুপস্থিত’!
দীপংকর দাদা প্রায়ই বলতেন ‘তোমার সাথে নিশ্চয়ই দেখা হয়েছে কোথাও, হয়তো মনের জগতে’ ! আমি তাঁর অপেক্ষায় ছিলাম ইত্যাদি রেঁস্তোরায়, অত্যন্ত টেনশান নিয়ে। এই অসম্ভব ঠান্ডার দিন এতো দুর থেকে এতো কস্ট করে আসবেন। ট্রেন থেকে বেরিয়ে উপরে উঠে আমাকে নাকি বেশ ক’বার কল করেছেন । অথচ আমি কোন কল পাইনি। টেক্স্ট ম্যাসেজ দিলাম ‘ইত্যাদিতে আছি’। দেখেই তিনি এলেন এবং বুঝতেই পারছিলাম এতো কনকনে ঠান্ডায় দাঁড়িয়েছিলেন ডাইভার্সিটি প্লাজার খোলা জায়গায়। আমি কিযে লজ্জিত হয়েছিলাম এবং খারাপ অপরাধবোধ করছিলাম। অথচ ফোন লাইনের অসহযোগিতার কারনে তাঁকে এতো কস্ট দিতে হলো। আমি অনেক অনেক দুঃখিত।
দীপংকর দাদা যখন ডয়েচে ভেলে বাংলায় ছিলেন তখন আমি অনেক শ্রোতা এবং তরুন সাংবাদিক ও বেতার উপস্থাপক ছিলাম। এই বাংলা বিভাগের খবর পেরেছিলাম ডয়েচে ভেলে ইংরেজী বিভাগের চিঠি থেকে। তখন থেকে তাঁকে চেনা। পাশাপাশি একই বিভাগের সবাইকেই চেনা, বিশেষ করে রফিক ভাই, ফারুক ভাই, নাজমুন আপা, শুভ্রাদি, সোহেল ভাই ও সুমনদা। কোলন থেকে ঢাকায় এলে আমার ফজলুল হক হলের রুমে ভিজিট করেছিলেন প্রিয় সোহেল ভাই ও নাজমুন আপা। ফারুক ভাই ও তাঁর ছোট-ভাই ডায়মন্ড সহ আমাদের বরদইন, কুমিল্লার বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিলেন।
বহু বছর আগে এই জ্যাকসন হাইটসের আলাদিন রেস্তোরায় প্রথম দেখা। তখন তারিক মাহবুবের একটি বিশেষ অনুস্ঠানে অতিথি ছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন ও রোকেয়া হায়দার আপা। সেদিন সুমনদাকে হাত বাড়িয়ে বললাম আমি কিরন। তিনি তখন বললেন ‘ তুমি কি সেই আকবর হায়দার কিরন?’ ডয়েচে ভেলেতে কাজ করার পর ভয়েস অব আমেরিকায় কয়েক বছর কাজ করেছিলেন দীপংকর দাদা, ফারুক ভাই ও সুমনদা। আমি বেশ কিছুটা সময় ডয়েচে ভেলে বাংলা বিভাগের এনালিস্ট হিসেবে কাজ করেছি। বিশেষ কাজটি ছিলো কনফিডেন্টশিয়াল বিষয়ক অর্থ্যাৎ বাংলা বিভাগের কাজ নিয়ে এনালাইসিস। একই সময় আমি আবার বিবিসি বাংলা ও ইংরেজী সার্ভিসের জন্য ঢাকায় স্ট্রিংগার ছিলেম বহু বছর।
দীপংকর দাদা কয়েক বছর ভিওএতে কাজ করার পর আবার কোলকাতায় ফিরেছিলেন। বাংলা বিভাগে হায়ার করেছিলেন বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ইশতিয়াক আহমেদ । কিন্তু যখন কাজ করেছিলেন তখন বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ইকবাল আহমেদ। যে সময়টা তিনি বাংলা বিভাগে ছিলেন তখন বলা যায় স্বর্ণযুগ । ভিওএ অনেক উর্ধতন কর্মকর্তা দাউদ খান মজলিশ , কাফি খান, রমেন পাইন, অসীম চক্রবর্তী , শরফুল আলম , সৈয়দ জিয়াউর রহমান, দিলারা হাসেম , রোকেয়া হায়দার, সরকার কবীর সহ অনেকে। প্রায় তিনযুগ পর আবার ভিওএতে ফিরে এসেছিলেন দীপংকর দাদা তবে কোলকাতা প্রতিনিধি হয়ে।
ঘটনাক্রমে আমিও ততক্ষনে কাজ করছিলাম ভিওএ নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি হিসেবে। কোলকাতায় ও নিউ ইয়র্কে ভৌগলিক দুরত্ব থাকলেও হৃদয়ের ব্যাপারটি সবসময় কাছাকাছি ছিলো। এই ঐতিহাসিক ভিওএ বাংলা বিভাগে একটানা চল্লিশ বছর কাজ করে, বাংলা বিভাগের প্রধান রোকেয়া হায়দার আপা অবশেষে অবসর নিলেন এবং পরপরই সরকার কবীর ভাই ও অবসর নিলেন ৩৮ বছর কাজ করার পর। বাংলা বিভাগ প্রধান ও ম্যানেজিং এডিটর তাঁরা দু’জন চলে যাবার পর কিছুদিন পর বাংলা বিভাগের বহু যুগের বেতার অনুস্ঠান চিরতরে বন্ধ হয়ে গেলো। কয়েক যুগের অসংখ শ্রোতা অনেক মর্মাহত হলেন। ফ্যান ক্লাব শীর্ষস্থানীয় নেতা ও উদ্দোক্তা যুবরাজ চৌধুরী, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, মোখলেসুর রহমান, সিদ্ধার্থ, নাজিম সহ সবাই দুঃখ ভারাক্রানত হলেন।
কিছুদিন এই নামকা ওয়াস্তে ভিওএ বাংলা হয়ে গেলো হাজার হাজার নিউজ পোর্টালের একজন। এই তথাকথিত বাংলা বিভাগের সাথে ত্যাগ করলাম আমি, দীপংকর দাদা, আবু নাসের সহ আরো অনেকে। এতক্ষন যেন অন্যজগতে ছিলাম , এখন আবার বাস্তবে ফিরে আসা। ইত্যাদি রেঁস্তোরা যেন আমাদের অনেকদিনের আপন জায়গা। এখানে গেলেই যেন চারদিকে আপনজনের মিলনমেলা। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই রেঁস্তোরার মালিক সাকিল ভাই, অসীমদা, খোকা ভাই, মেহেদী ভাই এবং অন্য সবাই আমাকে যেন বেশী আপন মনে করে যত্ন করেন। দীপংকর দাদাকে নিয়ে বসে যেন তারপর শুরু হলো বিশেষ আনন্দ ও উৎসব।
দীপংকর দাদার বিশেষ পছন্দ ইলিশ ভাজা কিন্তু তাঁর ইচ্ছে কিংবা অনিচ্ছায় আমাদের ডাইনিং টেবিল প্রায় ভরে গেলো এবং থাকলো নানান রকম ভর্তা। আমিতো নামকরা একজন স্বল্পাহারী কিন্তু দাদার খাওয়া দাওয়া দেখে মনে হলো তিনি অতি স্বল্পাহারী। অবশেষে নিহার সিদ্দিকী ভাই ও যোগ দিলেন এবং তাঁর বিশেষ পছন্দ চিংড়ির ঝাল কারি। ইত্যাদির মালিক সাকিল ভাই অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে বসলেন আমাদের টেবিলে। খেতে খেতে অনেক গল্প গুজব। তাঁর সৌজন্যে বিশেষ জিলাপী, তিনি নিজেই নিয়ে এলেন। এখানে আমি যখনই অতিথি নিয়ে ভালোমন্দ খাই তখন বিশেষ ছোট্ট মাটির দই খেতেই হয়। লম্বা মধ্যান্হ ভোজনের শেষে বৌদির জন্য বিশেষ খাবার নেয়া হলো। তিনি এই মহাশীতের দিনে আসেননি কিন্তু তাঁকে মিস করতে চাইনা সামান্য খাবার পাঠিয়ে ।
ভোজন পর্ব শেষে দাদাকে নিয়ে আমি ও নিহার ভাই নিয়ে এলাম আমার বাসায়। জ্যাকসন হাইটস থেকে উডসাইডের বাসায় হেঁটে এলে মাত্র সাত আট মিনিট। অবশ্য নিহার ভাইয়ের গাড়ীতে এলাম। মহাব্যস্ত নিহার ভাই আগেভাগেই সময় বের করেছিলেন দাদাকে আমার বিশেষ পরিকল্পনা। ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগের ৫০তম বর্ষপুর্তি অনুস্ঠানে আমি ও নিহার ভাই যোগ দেয়া সেই বিশেষ এলবাম তিনি মনোযোগ দিয়ে দেখলেন।









আরেক কিছু ছবি দেখা হলো ভিওএ’র ৭৫ বর্ষপুর্তি অনুস্ঠানে। রোকেয়া আপার বিশেষ আয়োজনে যোগ দিয়েছিলেন কাফি খান, দিলারা হাসেম, ইকবাল আহমেদ, ইকবাল বাহার, সৈয়দ জিয়াউর রহমান, মাসুমা খাতুন সহ অনেকে। ইতিমধ্যে স্মৃতির জগতে স্থান নিয়েছেন দিলারা আপা, ইকবাল আহমেদ ভাই, জিয়াউর রহমান ভাই ও কাফি খান ভাই। এই মহাসম্মিলনে এই অত্যন্ত স্মৃতিময় তুলেছিলেন এবং ভিডিও ডকুমেন্ট করেছিলেন প্রিয় নিহার ভাই, ভিওএ ডিরেক্টর আমান্দা বেনেট থেকে শুরু করে সবার সাথে আমার ও আমাদের ছবি।
ফেসবুক লাইভ করলাম দীপংকর দাদার সাথে। তাঁর সাথে জীবনের গল্প। নিহার ভাই সহযোগিতা করলেন । নিউ ইয়র্কের বিকেল বেলা হলো ঢাকা ও কোলকাতায় গভীর রাত। সকালে উঠে হয়তো আমাদের প্রিয় শ্রোতা ও বন্ধুরা দেখবেন সরাসরি দেখে এবং কমেন্ট করে ধন্য করলেন পরম শ্রদ্ধেয় রোকেয়া আপা। লাইভ অনুস্ঠানে একটি কল এসেছিলো । দাদাকে বললাম এই ফোন কল এটাও হলো পার্ট অব লাইফ।
এই শীতকালে পাঁচটার পর সুর্যের আলো চলে যায়। দাদাকে নিয়ে আবার জ্যাকসন হাইটস ফিরে যাওয়া, বাংলাদেশ স্ট্রিট ৭৩ এ তাঁকে দাঁড়িয়ে কিছু বিশেষ ছবি তোলা। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাংলাদেশ প্লাজা, নবান্ন , খামার বাড়ী , হাটবাজার ইত্যাদি। তারপর পছন্দের সেই সিগারেট কিনে উপহার দেয়া এবং সাবওয়েতে পৌছে দিয়ে আপাততঃ বিদায়। প্রিয় দীপংকর দাদা, আবার হবেতো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো’ ! ডিসেম্বর ১০, ২০২৪

