এভাবেই সময় চলে যায়। কিছুতেই সময়ের রাশ টেনে ধরা যায় না। মনে হয় এইতো সেদিন কানাডা আসলাম। চোখের সামনে জ্বল জ্বল করছে প্রথম দিনের স্মৃতি, দৃশ্যপট। অথচ দেখতে দেখতে বাইশ বছর হয়ে গেছে! যেদিন পীয়ারসন এয়ারপোর্টে নামলাম সেদিন অদ্ভুত একটা ফিলিংস হয়েছিল আমার। মনে হয়েছিল কিভাবে নিজের শিকড় উপরে ফেলে মানুষ! প্লেনে বসেই আমার বরিশাল, আমার মা, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশি, আমার সংগ্রামময় জীবন যে ঢাকা শহর সব ভীড় করে আসতে লাগল। কেবলই আমাকে পিছু টানছিল। প্লেনের সুস্বাদু খাবার বিস্বাদ লেগেছিলো। টরন্টো নেমে আমরা সোজা অটোয়ার পথে রওয়ানা হলাম। ঢাকা থেকে হিথ্রো তারপর টরন্টো। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে। হিথ্রোতে তিন ঘন্টা ফ্লাইট ডিলে ছিল মনে আছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে নামলাম নতুন এক দেশে, নতুন এক পরিবেশে
। ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটি শেষ করে যখন সকাল দশটায় এয়ারপোর্ট থেকে বের হলাম তখন টরন্টোর আকাশ রৌদ্রকরোজ্জল। ফুরফুরে বাতাস। চারিদিকে সবুজের সমাহার। ২৮ জুন ছিল সেটা। কানাডায় তখন তুমুল সামার। দুটো গাড়িতে আটটা বড় লাগেজ ( প্রতিটি ৭০ পাউন্ড) এবং চারটা ক্যারিঅন ব্যাগ নিয়ে আমরা অটোয়ার পথে রওয়ানা হলাম। টৱন্টো থেকে আৱো চার ঘন্টার ড্রাইভ। সুশৃঙ্খল হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। দুপাশে সবুজ দৃশ্য দ্রুত অপশ্রিয়মান হচেছ। একশ বিশ কিলোমিটার স্পিড। হাইওয়ের নাম ৪০১। গাড়ি শহর ছাড়িয়ে পূবেৱ দিকে ছুটে চলেছে। একটার পর একটা শহর পার হচ্ছি। পোর্ট ইউনিয়ন, পিকারিং, এজাক্স, হুইটবি, অশোয়া, বোমেনভিল…। দুরেই দৃশ্যমান হচ্ছে এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। লেক অন্টারিও। দুর থেকেই দেখতে পেলাম লেকের জল রৌদ্রের আলো পড়ে চিক চিক করছে। অর্ক অরিত্রি দীর্ঘ প্লেন ভ্রমনে গাড়ির মধ্যে ঘুমে ঢুলু ঢুলু। জেসমিনের চোখে বাইরে। এক গভীর অনিশ্চয়তা সেখানে।
জেসমিন আসতে চায়নি কানাডা। অর্ক অরিত্রি সব পরিবেশেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। আর আমি কখনো কখনো আগুনে ঝাপ দিতেও দ্বিধা করি না। পূর্বাপর ভেবে সবকিছু করা যায় না। আমার পুরো জীবনটাই এমন। আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি আমি। জীবন নিয়ে আমার কোনো উচ্চাভিলাষ নাই। সারা জীবন লড়াই সংগ্রাম করেছি। বিদেশের জীবন হবে আরো বেশি প্রতিকুল সেটা জানা আছে। আমি শুধু চাই আমার সন্তানদের সুখী করতে সেটা যেকোনো জায়গায়ই হোক না কেনো।
এতো বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। ছেলে মেয়েদের নিজেদের জীবন হয়েছে, সংসার হয়েছে। আরো কত কি বদলে যাবে। আমি এসব টের পাই। আমার অবজারভেশন খুউব ভাল। আমি আগাম টের পাই বলে জীবনে আমি অনেক অঘটন থেকে রেহাই পেয়েছি। তারপরও আমি ভুল করি। সবচেয়ে বড় ভুল হয় মানুষ চিনতে। মানুষকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করি এবং প্রায়শঃই ঠকি। কষ্ট পাই। কিন্তু সেসব নিয়ে আমার কোনো অনুতাপ হয় না। দেশে বিদেশে সবজায়গায়ই আমি মানুষের কারণে আমি অনেক যন্ত্রণা পেয়েছি। কিন্তু সেসব আমি মনে রাখিনি। সবাইতো আর এক রকম হবে না। আগে বেশি এসব নিয়ে আদিখ্যেতা করতাম। মাথা ঘামাতাম। এখন করি না। এটাই জীবন। এসব নিয়েই আমাদের বাঁচতে হবে। পৃথিবীতে নিরবচ্ছিন্ন সুখ যেমন নাই দুঃখও নাই।যেমন মা চলে গেলেন। এইতো সেদিনের কথা। অথচ দেখতে দেখতে চৌদ্দটি বছর পার হয়ে গেলো।
জীবন থেকে এভাবেই সময় চলে যায়। মা চলে গেলেও তিনি আছেন হৃদয়ে, স্মরনে, মননে, স্মৃতির আয়নায়। অনেক অসাধারণ সব স্মৃতি আছে আমাদের যা সবসময় জ্বলজ্বল করে। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো সবসময় মুক্তোর মতো ঔজ্জল্য ছড়ায় প্রতিনিয়ত। একটা ঘটনা মনে আছে, তখন আমার বয়স দশ বারো বছর হবে। মামা বাড়িতে গেছি। অজ গ্রাম। এক-একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার খুব মন খারাপ লাগত। এমন এক-একটা বিকেল বেলা আছে যখন সূর্য ডুবে যাওয়ার সময়ে অন্তত একটা মায়াবী অপার্থিব আলো এসে পড়তো উঠোনে। আকাশের রং যেত পালটে। সমস্ত বাড়িটায় কেমন এক আলো আঁধারির সৃষ্টি হত। হঠাৎ হঠাৎ আমার বহুজনের মাধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমাকে অনুভব করতাম। টের পেতাম আমার আলাদা একা এক ’আমি’আছে। সেই সব বিষন্ন বিকেলে আমার মাঝে মাঝে মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে হত।
প্রায়ই পশ্চিমের ঘরে মাকে খুঁজতে গিয়ে পেতাম না। সারা বাড়ি খুঁজে মাকে হয়ত পেতাম বড় ঘরের পাটাতনের সিঁড়ির তলায় গামলায় চাল মেপে তুলছে। আমি অবোধ দুর্জ্ঞেও এক বিষন্নতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই যে মার কাছে গেছি তা মা বুঝত না। তবু একটুক্ষণের জন্য হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিত। একটুক্ষণের জন্য মাথাটা চেপে রাখত বুকে। আমি তখন মায়ের গা থেকে মা মা গন্ধটা পেতাম। মা ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করতো দুপুরে পেট ভরেছিল? আমি বুক ভরে মায়ের গায়ের সুঘ্রাণ নিতাম। আজ মা নেই। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই আনন্দ।
সেদিনের আকাশেও সপ্তর্ষি ছিল, ছায়াপথ ছিল না। মা বসে থাকেন পাশে। পিঠে হাত বোলান। কথা বলেন না। নীরবে মাতা-পুত্রের সময় পার হয়ে যায়। ধুলারাশির মতো আকীর্ণ নক্ষত্রপুঞ্জ বিপুল একটি অনির্দিষ্ট পথের মতো পড়ে থাকে, ওখানে রোজ ঝড় ওঠে, ঝড়ো হাওয়ায় নক্ষত্রের গুঁড়ো উড়ে সমস্ত আকাশে ছড়ায়। সপ্তর্ষির চেহারা শান্ত। প্রশ্নচিহ্নের মতো। ব্যক্ত ও অব্যক্ত জগতের সীমায় বসে আছেন সাতজন শান্ত-সমাহিত ঋষি। মৃত্যুর পর থাকে কি কোনো চেতনা? অথবা আর একবার কি জন্ম নেয়া যায়? মৃত্যু, মহান একটি ঘুম, তার বেশি কিছু না। ছেলেবেলায় ফাঁকা মাঠে শুয়ে আকাশ দেখা হতো। দেখতে দেখতে কোনো শূন্যতায় পৌঁছে যেতো মন। পার্থিব কোনোকিছুই আর মনে থাকতো না। তখন আকাশে থাকতেন দেবতারা, মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতেন। আজ তারা কেউ নেই- না মনে, না আকাশে। তবু আজও সপ্তর্ষির অদৃশ্য আলো শরীর আর মনে অনুভব করা যায়। আবার যদি দেখা হয় মায়ের সঙ্গে। আবার যদি! আমার মাথায় একটু হাত রাখো তো মা, একটু হাত রাখো। মা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, কেন রে? সব ভুলিয়ে দাও তো মা, ভুলিয়ে দাও তো। বুদ্ধি, স্মৃতি, অবস্থা ভুলিয়ে দাও। আবার ছোট হয়ে কোলে ফিরে যাই..।