মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টা মিয়া আরেফিকে নিয়ে অন্তহীন আলোচনা-সমালোচনা চলছে। তার জন্ম, বেড়ে ওঠা, চলাফেরা নিয়ে কথা হচ্ছে দুনিয়াজুড়ে। বাইডেনের নামটি টেনে তিনি নিজেকে নিয়ে এসেছেন আলোচনার কেন্দ্রে। সময় যত গড়াচ্ছে ততোই প্রশ্ন উঠছে তার এহেন কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য নিয়ে। ২৮শে অক্টোবর ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথ পেরিয়ে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তার নাটকীয় উপস্থিতি, তার সম্পর্কে মার্কিন দূতাবাস এবং বিএনপি’র তাৎক্ষণিক বিবৃতি, সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্তব্য, হুইল চেয়ারে বসে দেশত্যাগের চেষ্টা, ইমিগ্রেশন পুলিশের বাধা, পরবর্তীতে মামলা ও গ্রেপ্তার এবং সর্বশেষ মার্কিন দূতাবাসের কনস্যুলার অ্যাকসেস চাওয়ার খবর- সব মিলিয়ে গোটা বিষয়টি রহস্যাবৃত। 

ওয়াকিবহাল সূত্র  জানিয়েছে, ২৮শে অক্টোবর সকালে বিএনপি’র শীর্ষ মহলে একটি ধারণা দেয়া হয় যে, একজন মার্কিন কূটনীতিক নাকি পল্টন এলাকায় সরজমিন উপস্থিত থাকবেন। অনভিপ্রেত ওই বার্তায় খানিকটা অবাক হয়েছিলেন নেতারা। তখনও তারা গুজবটির বিষয়ে ঠাওর করতে পারেননি। লাখো মানুষের এই মহাসমাবেশকে পণ্ড করতে যে জাল বোনা হচ্ছিলো সেটা তাদের অনুমানের বাইরে ছিল জানিয়ে এক নেতা বলেন, এটি কেবল বিএনপি’র গায়ে কালিমা লেপনের চেষ্টাই নয়, সেই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘ মেয়াদে সম্পর্ক নষ্ট করার অপচেষ্টাও বটে। ওই নেতা বলেন, আরেফির ঠিকানা এখন কারাগার, কিন্তু সেখানে পাঠানোর পথে তাকে যা বলানো হয়েছে রাজনীতি এবং কূটনীতিতে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থাকবে।    সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার মানিকদিয়ার গ্রামের মৃত রওশন মণ্ডলের ছেলে আরেফি। বাবার চাকরির সুবাদে পাবনায় বেড়ে ওঠা।  পাবনা পৌরসভার শায়েস্তা খাঁ এলাকায় জমি কিনে থিতু হয়েছে তার পরিবার। দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিত্ত-বৈভব থাকলেও স্থায়ী ঠিকানা এখন পাবনাই। তার পুরো নাম মিয়া জাহিদুল ইসলাম আরেফি। তবে বেলাল নামে তাকে চেনেন এলাকাবাসী। ছোটবেলা থেকেই চতুর স্বভাবের তিনি। অর্ধশত বছর পরও তার চতুরতার সচিত্র প্রতিবেদন দেখে হতবাক এলাকাবাসী। চার-পাঁচ মাস আগে আরেফি দু’দফা পাবনা যান। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি প্রবাস জীবনের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং জীবনের বাকিটা সময় পাবনাতে কাটানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।  আরেফির পাবনার বাসার ভাড়াটিয়া রইছ উদ্দিন এবং প্রতিবেশী হাদুল মিয়াসহ এলাকার লোকজন এই ক’দিনে একাধিক সংবাদ মাধ্যমে কথা বলেছেন। রইছ উদ্দিন জানান, আরেফি ওরফে বেলালরা ১০ ভাইবোন। একসময় পরিবারের সবাই আমেরিকা চলে যান। গত বছরের কোরবানি ঈদ এবং তিন থেকে চার মাস আগে দু’দফা পাবনার বাড়িতে গেছেন তিনি।  

 আরেফির বিয়ে-সংসার নিয়েও নানা কথা চাউর রয়েছে। ওই এলাকার বাসিন্দা পাভেল মৃধা জানান, বহু বছর আগে থেকেই আরেফি আমেরিকা থাকেন। তিন-চার মাস আগে এলাকায় গেলে পাড়ার অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। পাবনায় তার তেমন আত্মীয়-স্বজন নেই জানিয়ে মৃধা বলেন, পাবনা গেলে তিনি হোটেলে থাকতেন। পাবনার বাড়িটা ১০ তলা করে সেখানে স্থায়ী হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে তার।   আরেফি কাণ্ড নিয়ে জার্মান সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে বিস্তারিত প্রতিবেদন করেছে। সেখানে বেশকিছু তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ কেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টার আবির্ভাব? এমন প্রশ্ন রেখে তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে।  রিপোর্টের কনক্লুশনে বলা হয়, দেশের বিবদমান রাজনীতিতে  আরেফিকাণ্ড সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. তানজিম উদ্দিন খান বলেন, এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও প্রমাণ হলো বিদেশিদের উপর আমাদের ভয়ানক নির্ভরতা। তার ভাষ্য মতে, বাইডেনের উপদেষ্টা কারা? তা বিএনপি’র জানা উচিত ছিল। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. শাহেদুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, এমন একজন ব্যক্তি দেশে এলো কীভাবে- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। বিএনপি’র কেউ জানলো না যে, এই ব্যক্তি ভুয়া! তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া উচিত।   যেভাবে সামনে এলেন মিয়া  আরেফি: জার্মান সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট মতে, গত শনিবার পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর বিএনপি’র নয়াপল্টনের কার্যালয় এলাকা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়। সন্ধ্যায় হঠাৎ করে লে. জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। ব্রিফিং রুমে গিয়ে তিনি একজনকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এরপর ‘মিয়া আরেফি’ নামে ওই ব্যক্তি বক্তব্য শুরু করেন। তিনিও নিজেকে বাইডেনের উপদেষ্টা বলে পরিচয় দেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘র‌্যাবকে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে সহায়তা করেছি।

এখন পুলিশ ও আনসার বাহিনীকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনার পরামর্শ দেবো। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। মার্কিন সরকার বিএনপি’র সঙ্গে আছে।’   ১৮ মিনিট তিনি ইংরেজিতে এই বক্তব্য দেন। এ সময় তার পাশে লে. জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী এবং বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে দেখা যায়। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর প্রথম মার্কিন দূতাবাস থেকে জানানো হয়, এই ব্যক্তিকে তারা চেনেন না। তাছাড়া কোনো ব্যক্তি মার্কিন দূতাবাস থেকে বিএনপি অফিসে যাননি। এমনকি জো বাইডেনের ‘উপদেষ্টা’ বলে যে পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে, তাও সঠিক নয়। মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র স্টিফেন ইবেলি এক বার্তায় বলেন, এ ধরনের খবর পুরোপুরি অসত্য। ওই ভদ্রলোক যুক্তরাষ্ট্র সরকারের হয়ে কথা বলেননি, তিনি একজন বেসরকারি ব্যক্তি।’   এর কিছুক্ষণ পর বিএনপি’র মিডিয়া সেল প্রচারিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে এক ব্যক্তির বক্তব্য রাখার বিষয়টি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নজরে এসেছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এ বিষয়ে বিএনপি একেবারেই অবগত নয়। ওই ব্যক্তির বিষয়ে দূতাবাস থেকে বিএনপি মহাসচিবকে আগে থেকে অবহিত করা হয়নি।

এ কারণে বিএনপি তার বক্তব্যের বিষয়েও অবহিত নয়।’   আরেফির সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘আহত নেতাকর্মীদের দেখতে আমি নয়াপল্টনস্থ ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে দলীয় কার্যালয়ে যাই নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিতে। সেখানে হঠাৎ সারওয়ার্দী সাহেব একজনকে সঙ্গে নিয়ে এসে বাইডেনের উপদেষ্টা বলে পরিচয় দেন। এ সময় তাদের অনুরোধে আমি পাশে বসি। ওই ব্যক্তির সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় বা যোগাযোগ নেই। তার বক্তব্য আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হওয়ায় আমি বিষয়টি যুগ্ম মহাসচিব এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে জানাই। আমি আসলে পরিস্থিতির শিকার।’   আরেফিকাণ্ডে বিএনপি বেকায়দায় পড়ার কিছু নেই দাবি করে দলটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, সারওয়ার্দী সাহেব বিএনপি’র কোনো পদে নেই। ইশরাক আন্তর্জাতিক কমিটিতে থাকলেও তিনি ওই কমিটির সর্বোচ্চ দায়িত্বে নেই। ফলে আরেফির সংবাদ সম্মেলনের সঙ্গে বিএনপি’র কোনো সম্পর্ক নেই। তাছাড়া ২৮শে অক্টোবর সংঘর্ষের পর ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পুলিশের হাতে। সঙ্গত কারণেই তখন পার্টি অফিসে কে এসেছেন, আর কে গেছে তা বিএনপি’র শীর্ষ নেতাদের অজানা।

  আরেফিকাণ্ড সম্পর্কে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ বলেন, আরেফি আমাদের জানিয়েছেন যে, বিএনপি অফিসে লে. জেনারেল (অব.) হাসান সারওয়ার্দী, বিএনপি’র নেতা এডভোকেট বেলাল ও ইশরাক হোসেন তাকে বাইডেনের উপদেষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। তারা মিথ্যাভাবে আরেফিকে উপস্থাপন করেছেন। তারা বাসা থেকে আসার সময় শিখিয়েছেন যে, আপনি (আরেফি) বলবেন র‌্যাবকে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা দিতে সহায়তা করেছি, এখন পুলিশ, আনসার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। এই কথাগুলো বললে দেখবেন বাংলাদেশের পুলিশ অফিসাররা ডিমোরালাইজড হবে এবং বিএনপি নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হবে।  ১৯৮৬ সালে তিনি আমেরিকা চলে যাওয়ার পর একই সালে একবার এসেছিলেন। এরপর ২০২২ সালে দেশে এসে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তিনি রাজধানীর বারিধারা ডিওএইচে থাকেন। সেখানে হাঁটা-চলার মধ্যদিয়ে পরিচয় হয় হাসান সারওয়ার্দীর সঙ্গে। তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। আরেফি তখন আমেরিকা চলে যান।

হাসান সারওয়ার্দী তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ২৮শে অক্টোবর বিএনপি’র সমাবেশের আগে আসতে বলেন। ২৬শে অক্টোবর দেশে এলে হাসান সারওয়ার্দী আরেফিকে বলেন, ২৮শে অক্টোবর বিএনপি’র একটি র‌্যালি হবে, আপনাকে দেখাতে নিয়ে যাবো। এই কথা বলে তাকে নিয়ে আসা হয়। আরেফি আমাদের বলেন, আমার এটা ভুল হয়েছে। আমি জানতাম না এত বড় অন্যায় হবে।  আরেফিকে হস্তান্তর করার পর পল্টন থানার ওসি মো. সালাহউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের থানায় একটি মামলা হয়েছে। সেই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আমরা তাকে রিমান্ডে নিতে চাইনি, কারাগারে আটকে রাখার আবেদন করেছি। আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।