সিলেটের মৌলভীবাজারের একটা গ্রামের কাগুজে নাম ছিলো গিয়াসনগর, লোকমুখে সেটা হয়ে গেলো গসনগর (বা গছনগর)। কেউ যদি শুদ্ধ উচ্চারণ করে বলতো গিয়াসনগর, মানুষ তাকে ব্যঙ্গ করতেো- কি-বা ভাগোর চাউতলী, তার উপ্রে গসনগর। এ থেকে একটা প্রবচন চালু হয়ে গেলো- কেউ যদি হঠাৎ করে নিয়মিত পোশাক না পড়ে সুন্দর কেতাদুরস্ত পোশাক পরে আসে, তখন তাকে বলা হতো- কি-বা ভাগোর চাউতলী, তার উপ্রে....। তেমন আরেকটি গ্রামের নাম পাহলোয়ানপুর, স্থানীয় লোকেরা বলতো পইলনপুর। প্রচলিত নিয়মে এলাকাভিত্তিক মানুষদের উল্লেখ করা হয় গসনগরী বা পইলনপুরী বলে। শব্দের এমন বিবর্তন ও রূপান্তর অদ্ভুত নিয়মে চলে, ব্যাকরণ পরে সেগুলোকে পরে নিয়মসিদ্ধ করে নেয়।
মৌলভীবাজার শহরে আমাদের বাসায় এক দিনমজুর থাকতেন, তাকে আমরা পইলনপুরি বলে ডাকতাম। আমাদের বাসায় থাকতেন, খেতেন, আমাদের বাসায় এবং মাঝে মাঝে বাইরে কোথাও কাজ পেলে কাজ করতেন, সেখান থেকে আয় করা অর্থ দিয়ে গ্রামে সংসার চালাতেন।
আমাদের বাসার লাগোয়া বেশ বড় একটুকরো মাঠ ছিলো। ছিলো দুএকটা বড়ই গাছ, কয়েক ঝাঁড় কলা গাছ, আর বাকিটা বিছরা। বিছরা হলো এক টুকরো জমি, যেখানে প্রধানত ধানের বিচি থেকে চারা (স্থানীয় ভাষায় 'আলি') করা হতো। এই বিছরাতে আব্বা শীতের মওশুমে পইলনপুরিকে নিয়ে রবিশস্য ফলাতেন। আলু-পটল-লেটুস-টমেটো-ঢেঁড়শ-চুকাইপাতা থেকে এমন কিছু নাই যা আব্বা ফলাতেন না। আব্বা অফিসে এবং আমাদের স্কুলে যাওয়ার আগে ভোরে উঠে আমরা আব্বার সাথে মাঠে কাজ করতাম। মাটির দলা ভাঙতাম, আগাছা পরিস্কার করতাম। বিছরার পাশেই ছিলো ধোপাদিঘী নামের বিশাল সুন্দর একটি দিঘী (সম্প্রতি পৌর কর্তৃপক্ষ সেটিকে উন্নয়ন করে শহরের দর্শনীয় স্থান বলে ঘোষণা দিয়েছেন, তবে ধোপাদিঘী নামটি রাখেননি)। সেই দিঘী থেকে বালতি ভরে জল এনে বদনা দিয়ে গাছের গোড়ায় দিতাম। বিচি থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে পাতা, ফুল, ফল ধরতো। বিছরা যখন নানান রঙের পাতায় ফলে ফসলে ভরে উঠতো, দেখতে খুব ভালো লাগতো। আমি মাঝে মাঝে সেখান থেকে কাঁচা সব্জি যেমন বরবটি, টম্যাটো, ঢেঁড়শ হাতের তালুতে মুছে না ধুয়েই খেয়ে ফেলতাম।
দীর্ঘদিন বিদেশ থাকায় সেসব অতীত দিনের কথা মনের আড়ালে পড়ে গিয়েছিল। তবে ফেসবুকে প্রবাসের আদর্শ কিষাণ-কিষাণীদের ব্যাক-ইয়ার্ডের খামারে উৎপাদিক পণ্য নিয়ে নানান অঙ্গভঙ্গীর হাসিমাখা ছবে দেখে সেই স্মৃতিগুলো উঁকি মারে মনের জানালায়। বিদেশে এসে অনেকেই খুব ভালো কিষাণ-কিষাণী সেজেছেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন কারো গাছে একটি লাউ, কারো গাছে চল্লিশটি, কারো ডালাভর্তি চেরি টম্যাটো। কেউ কেউ হা-হুতাশ করছেন, আর কেউ কেউ দাঁত কেলানো গর্বের হাসির ছবি দিচ্ছেন।
ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো পড়ে আর ছবিগুলো দেখে ভাবনার শিকলে টান পড়ে। মনে পড়ে শৈশবে পাঠ্যপুস্তকে পড়া গণি মিঞার গল্প। কৃষক গণি মিঞার কন্যার বিয়েতে কর্জ করতে হয়েছিলো। ঋণ শোধ করতে গণি মিঞাকে জমি বিক্রি করে ভূমিহীনে পরিণত হতে হয়েছিল।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম- এই প্রবাসে আসলেতো আমি নিজেই এক গণি মিঞাতে পরিণত হয়েছি। তবে সান্তনা এটা যে, গণি মিঞা হই আর যা-ই হই নিচের ছবিটির মতো মুখে প্রাণখোলা হাসিতো আছেই!