এম আব্দুর রাজ্জাক, বগুড়া থেকে : বাঙালির জাতি-রাষ্ট্রের স্রষ্টা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বেঁচেছিলেন মাত্র ৫৫ বছর। তিনি পৌরাণিক কাহিনির কোনো মহাবীর বা কিংবদন্তির কোনো মহানায়ক নন। তিনি বাঙালির আধুনিক ইতিহাসের নির্মাতা ও শ্রেষ্ঠ মানুষ। কিন্তু এই সংক্ষিপ্ত জীবনে যে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন তা পৌরাণিক ও কিংবদন্তির লোকশ্রুত কাহিনি ছাপিয়ে রূপ পরিগ্রহ করেছে মহাকাব্যিক বয়ানে।
(১০ জুলাই, বৃহস্পতিবার) বিকেলে রাজধানীর এশিয়াটিক সোসাইটির মিলনায়তনে ‘বাংলা কবিতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’ শীর্ষক একক বক্তৃতায় এসব কথা বলেছেন কবি কামাল চৌধুরী। এশিয়াটিক সোসাইটি আয়োজিত এই ‘সপ্তম বিশেষ বক্তৃতা'য় সভাপতিত্ব করেন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি প্রফেসর এমেরিটাস খন্দকার বজলুল হক। বক্তৃতা অনুষ্ঠানের শুরুতে এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান খান কামাল চৌধুরীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার প্রাপ্ত কবি কামাল চৌধুরী তাঁর একক বক্তৃতা শুরু করেন নিজের লেখা ‘টুঙ্গিপাড়ায় ঘুমাও বাংলাদেশ’ শীর্ষক কবিতা আবৃত্তি দিয়ে। এরপর লিখিত প্রবন্ধের নির্বাচিত অংশ পাঠ করেন তিনি।
উনিশশো পঁচাত্তর সালে কামাল চৌধুরী ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র। ছিয়াত্তর সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার বক্তৃতার শুরুতে তিনি নিজেকে সেসময়ের ঘাতক কবলিত বাংলাদেশের সাক্ষী বলে পরিচয় দেন।
বক্তৃতার প্রারম্ভে তিনি বলেন, কবিতায় বীরবন্দনার ইতিহাস সুপ্রাচীন। সুদূর অতীতে চারণ কবিদের বীর বন্দনাগীতি এখনো ইতিহাসের সূত্র ও উপাত্ত হিসেবে গবেষকদের অনুসন্ধিত্সার উত্স। এ ক্ষেত্রে মধ্যযুগে বিভিন্ন দেশে, রাজদরবারে সভাকবিদের অবস্থানও লক্ষণীয়। কিন্তু জীবদ্দশায় যে মানুষ স্বজাতির আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারেন্ত জাতি যার ভেতরে সাহসের বহ্নিশিখা দেখে তিনি সত্যিকারের জননায়ক। কবির কলমে তিনিই উঠে আসেন চিরায়ত প্রতীক হিসেবে।রাজদরবারের কবিরা আদিষ্ট হয়ে লিখতেন। গণকবিরা লেখেন হৃদয় থেকে।
এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই লিখিত প্রবন্ধ তৈরির কাজে নিবিষ্ট ছিলেন বলে বক্তব্যে উলেস্নখ করেন কামাল চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালির ইতিহাসে যুগপত্ বিজয় ও শোকের প্রতীক। ১৯৭১ সালে বাঙালির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চূড়ান্ত রূপ পেলেও তার পূর্বেই শেখ মুজিব পরিণত হয়েছিলেন মুক্তির মহানায়কে। আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ পরিক্রমায় আমরা দেখি তরুণ বয়সেই শেখ মুজিবকে নিয়ে বাউল সুফি সাধক কবিরা গান বেঁধেছেন। ১৯৫৬ সালে পূর্ববাংলার আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে ২৬শে নভেম্বর সুনামগঞ্জ সফরে গেলে শাহ আবদুল করিম গান গেয়েছিলেন, তাতে শেখ মুজিবকে ‘জনগণের নয়নতারা’ বলে বন্দনা করেছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আব্রাহাম লিংকন, মহাত্মা গান্ধী, জন এফ কেনেডির মৃত্যুর পর লক্ষ লক্ষ মানুষ শোক প্রকাশের সুযোগ পেয়েছ্তে জাতি সুযোগ পেয়েছে শ্রদ্ধা জানাবার। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরিস্থিতি ছিল বিপরীত। শোক প্রকাশের ভাষাকে বন্দুকের নলের নীচে স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে। কেউ কথা বলতে পারছে না! বঙ্গবন্ধু তখন দেশে নির্বাসিত নাম ্ত তিনি নিষিদ্ধ্ততাঁর নাম উচ্চারণ করা যায় না! এরকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কবিদের হাতে নবজন্ম ঘটলো বঙ্গবন্ধুর। তিনি হয়ে উঠলেন পৌরাণিক ও কিংবদন্তির মহানায়কের মতো বিজয় ও শোকের চিরন্তন প্রতীক। যে শোক স্তব্ধ করে দিয়েছিল জাতিকে সেখানে স্ফুরণ ঘটতে থাকলো ক্ষোভ ও প্রতিবাদের। ঘাতককবলিত বাংলাদেশে সেই দুঃসময়ে কবিরাই যেন হয়ে উঠলেন বিবেকের কণ্ঠস্বর।’
একক বক্তৃতা শেষে উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে কেন্দ্র করে অনালোচিত ইতিহাসের উন্মোচন করেছেন কামাল চৌধুরী। এতে গবেষণার নতুন ভঙ্গী সামনে এসেছে। এসময় দর্শকসারিতে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মাহফুজা খানম, অধ্যাপক মাসুদুজ্জামান, কবি শিহাব শাহরিয়ার, লোকগবেষক সায়মন জাকারিয়া প্রমুখ। উন্মুক্ত আলোচনায় লেখক, গবেষক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেন কামাল চৌধুরী।
সভাপতির বক্তব্যে প্রফেসর এমেরিটাস খন্দকার বজলুল হক বলেন, সত্য, সুন্দর ও বীরের প্রশংসা করেন কবিরা। বঙ্গবন্ধুর মাঝে এই তিনের সমন্বয় ছিল। প্রবন্ধে বঙ্গবন্ধুর সাহসী, ত্যাগী ও সফল নেতৃত্বের কথা এসেছে। আলোচনায় দুই বাংলার কবি ও কবিতার কথা এসেছে।