মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিরা লাখ লাখ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সে সব গৃহহীনের অনেককেই কাদামাটি ও কাঁচা ইট দিয়ে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ীতে এখনো সেরকম দুয়েকটি ঘর রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ক্ষতিগ্রস্তদের গৃহনির্মাণ শেষ করার আগেই খুন হয়েছিলেন। গৃহহীনদের বেদনা বঙ্গবন্ধু যেমন বুঝেছিলেন, তেমনি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনাও অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ছাদহীন জীবনের কষ্টগুলোকে উপলব্ধি করেছিলেন। তাদের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা তাঁর রাজনীতির হাল ধরার সময় থেকেই।   পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু শুধু খুন হননি, একই সঙ্গে খুন হয়েছিল সরকার বদলের সংস্কৃতির। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বদলের একমাত্র পথ হয়ে ওঠে খুন ও বন্দুকের নল। সামরিক শাসকরা রাষ্ট্র পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বাতিল করেছিলেন। সংবিধানের মৌল নীতি তারা বদলিয়েছেন। ভিন্নমতাবলম্বীদের বিনা বিচারে খুন করাকে প্রথা হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। এ রকম নরকসম পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা পরিবার-পরিজনহীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন।  সংগত কারণে, তাঁকে লড়তে হয়েছে বাংলাদেশবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির বিরুদ্ধে। দুর্নীতির অতলে তলিয়ে থাকা দেশটাকে টেনে তুলে প্রান্তসীমা পর্যন্ত প্রসপারেটিকে পৌঁছে দেয়ার কঠিন লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন। বারবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুভয় তাঁকে স্পর্শ করেনি। বাধা পেয়েছেন, যে বাধা উপড়ে ফেলে সামনে এগিয়েছেন। তিনি নিরন্তর ছুটে চলছেন দেশ ও জনগণের জন্য। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও তাঁর আলস্য নেই, বিরাম নেই।তিনি সরকার বা বিরোধী দল যে অবস্থানেই থাকুন সর্বত্রই পিপলস অফিস ও পিপলস হেড হিসেবে কাজে ব্যাপৃত থাকেন। তাঁর মাথায় সর্বক্ষণ দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণ।   একজন সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার বড় অর্জন অনেক। যেমন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার বদল পদ্ধতির স্থায়ীকরণ, সমুদ্র বিজয়, পাহাড়ে শান্তি ফিরিয়ে আনা, ছিটমহলের ৫১ হাজার মানুষের মুক্তি, ১০ হাজার একর বাড়তি জমি লাভ করা, নিম্ন আয় থেকে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, পদ্মা ব্রিজ, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেল, উড়াল সড়ক, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, রেলপথ, সড়কসহ হাজারও নজরকাড়া কাজ। কিন্তু সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও হৃদয়কাড়া কাজটি হচ্ছে লাখ লাখ গৃহহীন মানুষের আধাপাকা ঘরে স্বপ্নসমবাস। এটি এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। অভাবনীয় কল্যাণকর কাজ। আসলে কাজের স্তর বিবেচনা করাও একজন নেতার বড় দক্ষতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রথম নিশ্চিত করেছেন নাগরিকের খাদ্য চাহিদার সমাধান। তারপর তাদের মাথার ওপর একটা নিরাপদ ছাদ দিয়েছেন। আমরা কি একবারও চিন্তা করতে পেরেছিলাম, পলিথিনে মোড়ানো ঝুপড়িঘরের স্থলে মাথার ওপরে লাল সবুজের ছাদ? ১৯৭৪ সালে ইত্তেফাকে ব্যবহৃত ষড়যন্ত্রের সেই ছবির বাসন্তিও ইটের প্রাচীরবেষ্টিত লাল সবুজের ঘরের বাসিন্দা। আসলে শেখ হাসিনা একজন স্বপ্নবাজ মানুষ।

তিনি শুধু স্বপ্ন দেখেন না, পিতার মতো সে স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতেও সক্ষমতা দেখিয়েছেন। অর্থনীতিবিদরা যখন পদ্মা ব্রিজ করার সামর্থ্যের প্রশ্নে কুচকিয়ে ছিলেন, কূটনীতিবিদরা যখন বিশ্ব মোড়লদের চোখ রাঙানির পারদের পরিমাপে তটস্থ, তখন অসম সাহস আর দৃঢ়তায় সুদারু বুদারু পণ্ডিতদের পিছনে ফেলে তিনি সফলতার গল্প বুনেছেন।  সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪১ লাখ ৪৮ হাজার গৃহহীন মানুষকে শেখ হাসিনার সরকার পাকা ও আধাপাকা নতুন বাড়ি দিয়েছেন। যেখানে বিভিন্ন ধরনের একক ঘরের মাধ্যমে ৩,৯৫,০৪৪টি পরিবার, ব্যারাক হাউসের মাধ্যমে ১,৬০,৫৭৩টি পরিবার, ৯,১৩৮টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার, গুচ্ছগ্রামে ১,১৮,৪৩৯টি পরিবার বসবাস করছে। এর বাইরে দুর্যোগ সহনীয় ঘর পেয়েছে ১০০,০০৬টি পরিবার। অসহায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ১৭,৭৩৮টি বীর নিবাস করেছেন।   ২০১৩-২০২৩ এই ১০ বছরে ১৯,৭৫,২২০ জন গৃহহীনকে আধাপাকা ঘরে জায়গা দিতে সক্ষম হয়েছে সরকার। সব মিলিয়ে ৮,২৯,৬০৭টি বাড়ি এবং ৪১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫ জন মানুষকে মাথা গোঁজার পাকা ঠাঁই করে দিয়েছেন। এ জন্য সরকার ২৪ হাজার একর জমি ভূমিহীন ও গৃহহীনদের কাছে সারা জীবনের জন্য হস্তান্তর করেছেন। এলাকা বিবেচনা করলে ২৫ হাজার স্থানে এমন ঘর তৈরি হয়েছে। দেশের সব জেলার ৪৯৪টি উপজেলায় এ প্রকল্প। তন্মধ্যে ২১টি জেলা ও ৩৩৪টি উপজেলা শতভাগ ভূমিহীন ও গৃহহীনমুক্ত হয়েছে। ৯/৮/২০২৩ তারিখে নতুন করে ২২ হাজার ১০১টি ঘর গৃহহীনদের মাঝে প্রধানমন্ত্রী হস্তান্তর করবেন।এই বিশাল কর্মযজ্ঞ যেমন রাষ্ট্রের সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিন্তা ও নকশার বাস্তবায়নও। যেটিকে আমরা বলছি ‘আশ্রয়ণ: অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’। নিশ্চয়ই একদিন এই মডেল পৃথিবীর বহু দেশ, বহু প্রতিষ্ঠান অনুসরণ করবে। যথার্থভাবে তাঁর এ মেধাকর্মটিকে ১০ এপ্রিল ২০২৩ কপি রাইটের আওতায় আনা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের এ কাজটি মেধার মূল্যায়নের উদহারণ হয়েও থাকবে।  শেখ হাসিনার করা এই বাসস্থানগুলো শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই নয়, এগুলো মানুষ হিসেবে অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদার প্রতীক। এখন বেঁচে থাকার প্রাণশক্তিরও উৎস। বিশেষত যারা ‘ক’ তালিকাভুক্ত অতিদরিদ্র। যাদের দুই শতক জমি ও বাড়ি দেয়া হয়েছে তাদের জন্য স্বর্গসম।  বাড়িগুলো দেয়ার মধ্যে অনেক ইতিবাচক বিষয় লক্ষণীয় হচ্ছে। আশ্রয়ণে জমির মালিকানা ও ঘরের ব্যবহারে নারী ও পুরুষকে সমানাধিকার দেয়া হয়েছে। এই প্রথম, রাষ্ট্র নারী ও পুরুষের ভূমিতে সমানাধিকার দিয়েছে, যা আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের (অনুচ্ছেদ ২৮(২) নারী-পুরুষের সমঅধিকারের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।  এই গৃহনির্মাণে স্থানীয় পরিবেশ ও মাটির প্রকৃতিকে বিবেচনা করা হয়েছে। চরের ও মূল ভূখণ্ডের জন্য পৃথক ডিজাইন ও দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে। চরের ঘরগুলো অবস্থাভেদে স্থানান্তরের সুবিধা রাখা হয়েছে। নদী ও সমুদ্র তীরবর্তী নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় জমি হস্তান্তরে স্থানীয় প্রশাসন, প্রকৌশল সংস্থা এবং জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ফলে জবাবদিহির সুযোগ থেকেছে। এখানে শুধু রাষ্ট্রই অবদান রাখছে তা নয়, এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট প্রথম পাঁচ কোটি টাকা অনুদান নিয়ে শামিল হয়। পরে এর সঙ্গে দেশের বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী ‘হাউস কনস্ট্রাকশন ফান্ড বাই প্রাইভেট ফাইন্যান্স’ নামে একটি ব্যাংক হিসাব চালু করেন। যেখান থেকে জমি ক্রয়ে অনুদান সংগ্রহ করা হয়েছে। ভূমিহীনদের শুধু জমি ও ঘর দেয়া হয়েছে তা নয়, তাদের বিনা মূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। বিশুদ্ধ জল ও পাকা ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও বস্তিবাসীর জন্য বহুতল আবাসন নির্মিত হয়েছে।  কলেবর বৃদ্ধি পেলেও প্রাসঙ্গিকভাবে শেখ হাসিনা তদানীন্তন কুড়িগ্রাম জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ওয়াদুদ হোসেন মুকুলের কাছে লেখা চিঠির উত্তর উদ্ধৃতি করি।

১৯৮১ সালের ১৭ ডিসেম্বর লিখিত চিঠিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা জনাব মুকুলকে লিখেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি ক্ষমতাসীনদের হুমকি মোকাবিলা করে জয়ী হতে হবে এবং দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আদায় করে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে। অকুতোভয়চিত্তে কাজ করে যাও। কোনো ভয় নেই। আমি আছি।’ (সূত্র: উত্তরবঙ্গ জাদুঘর)। এ চিঠি দেশ নিয়ে শেখ হাসিনার সেদিনের ভাবনাকে স্পষ্ট করেছে। যেখানে দরিদ্র মানুষের মুক্তির কথাকে তিনি পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যার প্রতিফলন অন্নহীনকে অন্ন দান এবং গৃহহীনকে গৃহ দানের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি। তিনি গরিবি হটাও আদর্শ থেকে একচুল সরে আসেননি।  পাঠক যদি আশ্রয়ণের ঘরগুলো দূর থেকেও দেখেন তাহলে দেখতে পাবেন যেন লাল সবুজের বাংলাদেশ। আর একটু কষ্ট করে যদি ঘরগুলোতে থাকা মানুষগুলোর কাছে যান নিশ্চিত সেখানে দেখতে পাবেন মানুষগুলোর কৃতজ্ঞতায় ভরা হাসিমাখা অবয়ব।  লেখক: রাজনীতিক