এম. আব্দুর রাজ্জাক, বগুড়া থেকে : সরকারি আজিজুল হক কলেজ বগুড়ায় অবস্থিত। উত্তরবঙ্গের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী কলেজ। খান বাহাদুর মোহাম্মদ আলী এম.এল.এ, মৌলভী আব্দুস সাত্তার, ডা. হাবিবুর রহমান, জমিদার পূর্ণচন্দ্র রায়, মৌলভী মো. ওসমান গণি, মৌলভী ইয়াকুব আলী, ডা. কছির উদ্দীন আহমেদ, প্রজাবন্ধু রাজীব উদ্দীন তরফদার এম.এল.এ, নলিনী চন্দ্র চক্রবর্তী, খান বাহাদুর কোরবান আলী, সৈয়দ দেলওয়ার আলী চৌধুরী, প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, শিব চাঁদ আগরওয়ালা, মৌলভী ছহির উদ্দীন আহমদ প্রমুখ বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তি এই অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারকল্পে বগুড়ায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর নামকরণ করেন বগুড়া কলেজ।কিছুদিন পরেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার এম. আজিজুল হকের নামে কলেজের নামকরণ করা হয়। ১৯৩৯ সালের ৯ জুলাই সুবিল প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনে কলেজের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে আই. এ শ্রেণি চালু করার অনুমোদন লাভ করে। আই. এ শ্রেণিতে বাংলা (সাধারণ), বাংলা (দ্বিতীয় ভাষা), ইংরেজি (আবশ্যিক), ইংরেজী (অতিরিক্ত), ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, যুক্তিবিদ্যা, পৌরনীতি, সাধারণ গণিত ও আরবি/ফার্সি বিষয়গুলো অনুমোদিত হয়। শুরুতে কলেজে ২০০ জন ছাত্র ছিল, কোনো ছাত্রী ছিল না। ১৯৪১ সালে কলেজের প্রথম ব্যাচের পরীক্ষায় ১৫২ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে প্রথম বিভাগে ৮ জন, দ্বিতীয় বিভাগে ৬৪ জন এবং তৃতীয় বিভাগে ৩৫ জন সর্বমোট ১০৭ জন পাশ করে। পাশের হার ছিল ৬৯.২%।
এরপর কলেজে অর্থনীতি এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে দু’বছর মেয়াদি সম্মান কোর্স ও বি.এ পাস কোর্স চালু হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এটিই প্রথম কলেজ যেখানে সম্মান শ্রেণি চালুর অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু শিক্ষক স্বল্পতার কারণে কলেজ পরিচালনা কমিটি শুধু ইসলামের ইতিহাস বিভাগে সম্মান এবং বি.এ পাস কোর্স চালু করে।১৯৪৩ সাল থেকে কলেজে ছাত্রী ভর্তি শুরু হয়। ১৯৪৫-৪৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে কলেজটি বাংলা এবং আরবি বিভাগে সম্মান ও আই.কম শ্রেণি চালু করার অনুমতি লাভ করে। ১৯৪৭ সালে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে কলেজে সম্মান শ্রেণি পরিত্যাগ করা হয় এবং আই.এস.সি শ্রেণি (পদার্থ, রসায়ন, গণিত) চালু করার অনুমোদন লাভ করে।১৯৪৮-৪৯ শিক্ষাবর্ষে আই.এস.সি শ্রেণিতে জীববিজ্ঞান বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ছাত্রীরা সকালের শিফটে বর্তমান ভি.এম গার্লস স্কুলে ক্লাশ করে। ১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে আরবি, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে তিন বছর মেয়াদি সম্মান শ্রেণি চালু করা হয়।১৯৬০ সালে কলেজটি সরকারের ২০ টি ডিগ্রি কলেজ উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ১৯৬১ সালে বগুড়া রেল ষ্টেশনের পশ্চিম পার্শ্বে কামারগাড়ী, নিশিন্দারা ও মালগ্রাম মৌজায় ৫৫ একর জমিতে ৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে কলেজের দ্বিতল ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৬১ সালের ৩১ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর লে. জে. আজম খান ভবনটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬২ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে কলেজের অধ্যক্ষ পদে সরকারি ডেপুটেশনে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ সময় কলেজের শিক্ষকরাও জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯৬৩-৬৪ সালে কলেজ ক্যাম্পাসে সড়ক, একটি দ্বিতল ভবন, ছাত্রাবাস (তিতুমীর হল) ও একটি ছাত্রী নিবাস (রোকেয়া হল) নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ ও পানির পাইপ সংযোগের কাজ সম্পন্ন হয়।
১৯৬৮ সালের ১৫ এপ্রিল কলেজটি সরকারিকরণ করা হয়। তখন কলেজে বাংলা, অর্থনীতি, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে সম্মান কোর্স চালুর পাশাপাশি বি.এ, বি.কম, বি.এস.সি, আই.এ, আই.কম, আই.এস.সি ক্লাস চালু করা হয়। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলা, ইতিহাস, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আরবি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত ও হিসাববিজ্ঞানে সম্মান কোর্স চালু হয়। অর্থনীতি, রাষ্ট্র বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা ও হিসাব বিজ্ঞানে মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়। ১৯৭৩-৭৪ সালে মাস্টার্স ও সম্মানে যথাক্রমে ৩১৭ ও ৬১৮ জনসহ মোট ৩,৭৮৭ জন ছাত্র-ছাত্রী ছিল। শিক্ষক ছিলেন ৯০ জন। বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ২৩ টি বিষয়ে অনার্স এবং ১৮ টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্সের পাশাপাশি ডিগ্রি পাস কোর্সে বি.এ, বি.এস.সি, বি.এস.এস ও বি.কম কোর্স চালু রয়েছে।
এ ছাড়া বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা এবং মানবিক বিষয়ে এইচ.এস. সি কোর্স এবং উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কোর্স চালু রয়েছে। কলেজে একটি আইসিটি ইন্সটিটিউট রয়েছে। এখানে আইসিটি বিষয়ের উপর ১ বছর মেয়াদী স্নাতকোত্তার ডিপ্লোমা কোর্স, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড এ্যাপ্লিকেশন্স বিষয়ে ১ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স, ৬ মাস মেয়াদি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্স এবং স্বল্প মেয়াদী কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রয়েছে।
এ ছাড়া রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এখানে ইংরেজি, আরবিসহ বিভিন্ন ভাষার উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। কলেজে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩২ হাজার, শিক্ষকের পদ ১৯৬ টি। কলেজে গবেষণাগার, গ্রন্থাগার, অফিস, ছাত্র-ছাত্রী কমনরুম, বিএনসিসি ভবন, দ্বিতল মসজিদ, শহীদ মিনার, বিজ্ঞান ভবন, অধ্যক্ষ ভবন, ছাত্র সংসদ ভবন, রোভার স্কাউট ভবন, আকতার আলীমুন হল নামে ৪ টি এবং ছাত্রীদের জন্য রোকেয়া হল নামে একটি আবাসিক হল রয়েছে।
কলেজে বিএনসিসি, রোভার স্কাউট, রেড ক্রিসেন্ট ও বাঁধন-এর কার্যক্রম রয়েছে। কলেজে ‘কলেজ থিয়েটার’ ও ‘নীলতলী’ নামে ২ টি সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য হাবিবুর রহমান মেমোরিয়াল স্কলারশিপ এবং রইস উদ্দিন খাতেমুন্নেছা বৃত্তি প্রচলিত আছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলেজে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৩ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটালিয়ানের ক্যাম্প স্থাপিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা কলেজের মূল্যবান কাগজপত্র, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র ধ্বংস করে।সৈন্যরা মো. মমতাজুর রহমান নামে কলেজের একজন কর্মচারীকে হত্যা করে। কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ড. এম. এম. মুখার্জি (১৯৩৯) এবং প্রথম উপাধ্যক্ষ ২,৫০০ আসন বিশিষ্ট অডিটোরিয়াম এবং খেলার মাঠ রয়েছে। কলেজে ছাত্রদের জন্য তিতুমীর হল, শের-এ-বাংলা হল, ফখরুদ্দিন আহমদ হল। আজ ৯ জুলাই-২০২৩ খ্রি. সরকারি আজিজুল হক কলেজের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী।