ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে ঘিরে কিছু স্মৃতি 

শ্রদ্ধাভাজন জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে প্রথম দেখি বিচিত্রা কার্যালয়ে। নীচে গণস্বাস্থ্যের জিপে বসে আছে সুঠামদেহী নারী পেশাদার গাড়িচালক। সম্ভবত তিনিই এ পেশায় প্রথম নারী।
টান টান দেহে হাস্যোজ্জল মানুষটি ঢুকছেন বন্ধু শাহাদত চৌধুরীর অপরিসর কক্ষে। সময়টা ঔষধনীতি প্রণয়নের। খানিক পরে দেখি এরশাদ সরকারের স্বাস্থ্যপ্রতিমন্ত্রী ও তিনি আনন্দবিচিত্রার টিনশেডের প্রুফরিডার আবু মাসুম ও সুজিত কুমার বসাক এর টেবিলে। দুজনে দীর্ঘ আলোচনা। এমনি একাধিক দিন। শুনলাম দেশের জন্যে লাগসই ঔষধনীতি প্রণয়নের খসড়া ঝাড়াই বাছাই চলছে। বিস্মিত হয়েছিলাম এই ভেবে, মন্ত্রণালয়ের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত কক্ষ ছেড়ে এই টিনশেডে একজন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার আহ্বানে স্বয়ং মন্ত্রীমহোদয়ের মাটিতে নেমে আসা, বিরল ঘটনা বটে। জাতিকে এক অনন্য উপহার দেবার অনুঘটক একজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

অষ্টাশির বণ্যায় ভেসে গেছে দেশ। সরকার বণ্যানিয়ন্ত্রনে বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ দেওয়ার কথা ভাবছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী আয়োজন করলেন "বাংলাদেশের বণ্যা, বাংলাদেশী মতামত" শীর্ষক সেমিনারের। দেশের ভূগোলবিদ, পানিবিশেষজ্ঞ, বোদ্ধাজন নিয়ে প্রাকসভা চলছে, তৈরি হচ্ছে পেপারওয়ার্ক। আমরা কয়েকজন সমন্বয়ের কাজে নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবী।  এরশাদ সরে এলেন সিদ্ধান্ত থেকে। সেমিনারে রাষ্ট্রপতিই প্রধান অতিথি। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অনুরোধে, শাহাদত চৌধুরীর নির্দেশে ননপেইড স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উদয়াস্ত শ্রম দেয়া দলে সামিল আরিফ রহমান শিবলী ও আমি। শামীম আপা ও জসিম মল্লিক ভিড়েছে স্যালাইন প্রজেক্টে।

সেমিনারের পর চা-চক্র। বাহুল্যবর্জিত আপ্যায়ন, এক কাপ চায়ের সঙ্গে গণস্বাস্থ্যের বেকারীতে বানানো একটুকরো কেক। সকলের জন্যে একই ব্যবস্থা।

আরো কিছু স্মৃতি আগাপাশতলা দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে ঘিরে। সারাজীবন সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলে গেছেন। উচিত কথা বলে গেছেন স্থান-ব্যক্তি-সমাবেশ নির্বিশেষে। এর জন্য নিগৃহীতও হয়েছেন। কিন্তু থামেননি।
সাদাসিধা জীবনযাপনে ছিলেন কিংবদন্তি। কতো উদ্যোগই তো জাতীয়, রাজনৈতিক প্রয়োজনে নিয়েছেন। সবার পছন্দ না হলেও তাঁর আন্তরিকতা নিয়ে শত্রুরও সন্দেহ ছিলো না। আসলে তিনিতো ছিলেন অজাতশত্রু। বাকীদের হীনস্বার্থে হয়তো তাঁর অনেক উদ্যোগ ধোপে টেকেনি। তাতে তাঁর কিছু যায়নি, আসেওনি। তিনি তার কাজ করে গেছেন, এমনকি হুইলচেয়ারে বসেও। মতদ্বৈতা ছিল অনেকের সঙ্গে। তারাও তাঁর সৎ সাহসে সাহসী উচ্চারণকে কুর্ণিশ করেছেন। কোনোকিছুই তাঁকে থামাতে পারেনি, একমাত্র মৃত্যু ছাড়া। সাথে করে মৃত্যুহীণ প্রাণ নিয়ে এসেছিলেন। মরনে তারচেয়েও বড় কিছু বেশি কিছু দান করে গেলেন।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সচল, সজীব, প্রাণবন্ত, কর্মমুখর। এমন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক, দেশের মঙ্গালাকাঙ্খীর দেখা আবার কোন প্রজন্মে মিলবে বলা মুশকিল। কথাটা অনেকের সদোদ্দেশ্যের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলছি।
শ্রদ্ধাভাজন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শতব্যস্ততায় ক্লান্ত আপনি ঘুমান চিরশান্তিতে।

মশিউর রহমান, বিচিত্রা পরিবারের একজন