গত ২৬ মার্চ (২০২৩) দুপুরে চ্যানেল আই-এ গিয়েছিলাম ‘তারকা কথন’ অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানশেষে গেলাম এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাগর ভাইয়ের (ফরিদুর রেজা সাগর) সাথে দেখা করতে। কামরায় ঢুকেই দেখি চেয়ার খালি! তখনো এসে পৌঁছাননি সাগর ভাই।
সাগর ভাইয়ের চেয়ারের উল্টোদিকে মাথা নিচু করে সমানে কী যেন লিখে যাচ্ছেন আমীরুল। আমীরুল ইসলাম এই চ্যানেলের অনুষ্ঠান অধ্যক্ষ (হেড অব প্রোগ্রামস) বলেই জানি। সেই আশির দশকের শেষভাগ থেকেই ওঁর সাথে পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা আর বন্ধুত্ব। প্রয়াত শিশু সাহিত্যিক, টিভি ব্যক্তিত্ব আলী ইমাম আমীরুলকে বলতেন- ‘বাংলাদেশে ছড়ার রাজপুত্র’। ‘বীর বাঙালির ছড়া’ নামে একটি গ্রন্থ আমাকে উৎসর্গ করেছিল আমীরুল- সেই নব্বই-এর দশকে! ছড়ার সেই বইটি আমি রেখে দিয়েছি ওঁর স্মৃতি হিসেবে!
আমীরুলের কাছেই জানলাম- কিছুক্ষণের মধ্যেই সাগর ভাই এসে পড়বেন। এই ফাঁকে দু’জনের কাজ-কর্ম-সংসার সবকিছু নিয়ে ঝড়ের গতিতে আলাপ হয়ে গেলো এক পশলা। সম্প্রতি আমার ‘জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার’ নিয়ে অভিনন্দন জানাতেও ভুল করলো না সে!
আমাদের কথার মাঝখানেই সাগর ভাই এসে ঢুকলেন কামরায়। আমি দাঁড়িয়ে সালাম দেই। কেমন আছো কাওসার- সাগর ভাইয়ের প্রশ্ন। আমি বলি- খুব ভালো আছি। আপনাকে সালাম দিতে এলাম। মুচকি হেসে সাগর ভাই বললেন- তুমি এসেছিলে ‘তারকা কথনে’- আমাকে দেখতে আসো নি !
এখানে একটা কথা বলে রাখি। কথায় বলে- ‘সৃষ্টিকর্তার হুকুম ছাড়া গাছের একটি পাতাও নাকি নড়েনা’। ওই একই কথাটি এই চ্যানেলটির বেলাতেও বলা যায় ভিন্নভাবে! আমি তো প্রায়ই বলি- সাগর ভাইকে না জানিয়ে চ্যানেল আই’তে বাতাসও চলাচল করে না! লক্ষ্যনীয়- ২৬ মার্চ, মহান স্বাধীনতা দিবসের ‘তারকা কথনের’ মতো লাইভ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে কে আসবে না আসবে- সেটা সাগর ভাইয়ের নজরে থাকবেনা- এটা হতেই পারেনা! ফলে চ্যানেলে আমার আগমনের হেতু সাগর ভাই জানবেন না- সেটা খুব বোকার মতো ভাবনা হয়ে যাবে
!
সাগর ভাইয়ের সাথে পরিচয় আর হৃদ্যতা সেই ’৭৮ সাল থেকে- বিটিভিতে অনুষ্ঠান উপস্থাপনার সুবাদে। এর অনেক পরে- সাগর ভাইদের ‘ইমপ্রেস টেলিফিল্মের’ সাথে কাজ করেছি (প্রাইভেট টিভি চ্যানেল তখোনও শুরু হয়নি)। শান্তি নগরে তখোন উনাদের অফিস। সেই সময় থেকেই সাগর ভাই এবং শাইখ সিরাজের সাথে সখ্যতা! পরে সাগর ভাইয়ের মাতা রাবেয়া খালাম্মার (রাবেয়া খাতুন) সাথেও ঘনিষ্টতা হয়ে যায় সময়ের বাঁকে। প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনকে পাঠকের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টা করাটি ধৃষ্টতা, সে জন্য ওপথে গেলাম না।নব্বই দশকের শুরুতে- প্রয়াত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের জীবন এবং কর্ম নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ‘গণ উন্নয়ন গ্রন্থাগার’। ওটার পরিচালক ছিলেন সালাম ভাই (আব্দুস সালাম) এবং তার ক্যামেরায় ছিলাম আমি। সেই প্রামাণ্যচিত্রে সাক্ষাতকার নেবার জন্য গিয়েছলাম রাবেয়া খালাম্মার কাছে। রাবেয়া খালাম্মা ছিলেন জহির রায়হানের সম-কালের লেখক, বন্ধু। রাবেয়া খালার সাথে ঘনিষ্ঠতা তখন থেকেই শুরু। ** বলে রাখি- জহির রায়হানকে নিয়ে সেই প্রামাণ্যচিত্রটি অসমাপ্তই রয়ে গেছে। এর ফুটেজগুলো কোথায় আছে সেটা পরিচালক সালাম ভাই-ই বলতে পারবেন ভালো!
একটা মজার গল্প বলি।
সময়টা সম্ভবত ’৯৭ সালের দিকে হবে। আমরা তখোন ‘ইমপ্রেস টেলিফিল্ম’ থেকে একটা অনুসন্ধানি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান (ঘটনার আড়ালে) নির্মাণ করতাম বিটিভি’র জন্য। সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিলেন আবেদ খান, প্রযোজক ছিলেন খ ম হারূন আর গবেষণায় ছিলেন সুপন রায়। এর সহযোগি ছিলেন ফাইজুল ইসলাম। সুপন তখোন ভোরের কাগজে কাজ করেন। বছরখানেক এই অনুষ্ঠান প্রচারিত হওয়ার পরে আমরা একটা উদ্যোগ নেই- পাবনার ‘মানসিক হাসপাতালে’র নানান কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি সিরিজ অনুষ্ঠান করার।
বিষয়টি রাবেয়া খালাম্মা জানার পরে উনিও আমাদের টিমের সাথে পাবনায় যাবার প্রস্তুতি নেন। উদ্দেশ্য, মানসিক হাসপাতালের ভেতর-বা’র নিয়ে একটি উপন্যাস লেখা। যেই কথা সেই কাজ। খালাম্মা যথারীতি একদিন চললেন আমাদের সাথে- পাবনায়। যাবার আগে সাগর ভাই খালাম্মার সেবা শুশ্রুষার সকল দায়িত্ব দিলেন আমার ওপর। বললেন- আম্মার সকল দায়িত্ব এখন তোমার। উনার যেখানে যাকিছু লাগবে- সব তুমিই দেখবে। আমি বুক ফুলিয়ে বলি- খালাম্মার জন্য ‘জুতা বুরুশ থেকে খুন খারাবি’ এখন আমার এখতিয়ার! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ......সৈয়দ মুজতবা আলীর আব্দুর রহমান চরিত্রটির (প্রবাস বন্ধু) কথা আপনাদের মনে আছে নিশ্চই! কথাটি (জুতা বুরুশ থেকে খুন খারাবি) ওখান থেকেই নিয়েছি!
পাবনায় আমরা তিন দিন ছিলাম। খালাম্মার এতটুকু অসুবিধা কোনদিন হতে দেই নি। শুধু সাগর ভাইয়ের মা বলে নয়; আমি আসলে মাতৃসম কাওকে কাছে পেলে গলে যাই ভীষণ! খুব ন্যাওটা হয়ে পড়ি তাঁর। সেই বাহাত্তর চুয়াত্তরে বাবা-মা দু’জনকে হারিয়েছি। মায়ের বদলে মায়ের মত কাওকে কাছে পেলে তাঁকে বুঝতে না দিয়েই গোপনে ভালোবাসতে থাকি, প্রচণ্ড মায়া করতে থাকি তাঁকে। রাবেয়া খালাম্মার ব্যাপারেও হয়েছিল সেটাই। উনার প্রয়ানে দীর্ঘদিন চোখ মুছেছি গোপনে।
পাবনায় অবস্থানকালে চিত্রধারণের কাজ সব ঠিকমতোই চলছিল। কিন্তু এরমাঝে একদিন গোল বাধালো সুপন রায়! আমি নিজেই অবশ্য সেই ‘ঘটনার’ মূল উদগাতা! সুপনকে দোষ দিয়ে লাভ নেই! ওঁকে বলেছিলাম- হাসপাতালের ভেতরের ‘প্রতিবন্ধীদের’ কথা তো অনেক হলো। একেবারে ‘ফ্রেশ’ কোন প্রতিবন্ধী যদি পাওয়া যায়- তাহলে আমাকে খবর দিও, চট করে একটা সাক্ষাতকার নিয়ে নেবো আবেদ ভাইকে দিয়ে।
বলে রাখি, আবেদ ভাই কিন্তু এই ধরণের কিছু স্বাধীনতা আমাকে দিয়েই রেখেছিলেন ‘প্রোডাকশনের’ ক্ষেত্রে। সেই আশকারাতেই আমি সুপন রায়কে দিয়ে একটা সুযোগের ‘ফাঁদ’ পেতেছিলাম। কিন্তু বিধি বাম! ঘটনা ঘটলো উল্টো। খুলে বলি কাহিনীটা।
লোকেশনঃ পাবনা মানসিক হাসপাতালের মূল ভবনের গাড়ি বারান্দা। বেলা প্রায় ১২টা। আমি পাশের ভবনের কাছাকাছি একটা কীসের যেনো শট নিচ্ছিলাম। এরমাঝে সুপন রায় দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলে- তাড়াতাড়ি চলেন কাওসার ভাই, ফ্রেশ একজনরে পাইসি। মেইন গেটের সামনে আছে। দেরি করলে ঢুকে যাবে হাসপাতালে।
পড়িমরি করে আমি ছুটলাম মেইন গেটের দিকে। গিয়ে দেখি- ১৬/১৭ বছরের একটি কিশোরি মেয়ে, একটা রিকশা ভ্যানের উপরে ব্যেঁকাতেড়া হয়ে বসে আছে; পাশে তার এক ছোট বোন (পরে জেনেছি)। তাদের দু’জনের মাঝখানে ছোট্ট একটি ব্যাগ। ব্যাস, আর যায় কোথা! আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম এদের যে কোন একজন কিংবা দু’জনই প্রতিবন্ধী; হাসপাতালে ভর্তি হতে এসেছে। তাদের অভিভাবক হয়তো কোথাও গেছেন- এখানে ওদের রিকশা ভ্যানে বসিয়ে রেখে!
ক্যামেরার লেন্স কাভারটি এক টানে খুলেই আমি ওদের শট নিতে থাকি সোৎসাহে। সুপনকে বলি- তাড়াতাড়ি আবেদ ভাইকে নিয়ে আসতে। কিন্তু মেয়েটি চিৎকার করে দু’হাতে মুখ ঢাকে। বলে- “আমি পাগল নই, পাগল নই! আমি হাসপাতাল দেখতে এসেছি। প্লিজ, আমার ছবি তুলবেন না; না না......! কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমি আরো বেশী করে শট নিতে থাকি। কারন, হাসপাতালে যতজন প্রতিবন্ধীর সাথে কথা বলেছি এ ক’দিনে- সবাই বলেছে- ‘আমি পাগল নই’! বরঞ্চ অন্য একজন কাওকে দেখিয়ে ফিশ ফিশ করে বলেছে- ‘আমি নই, ও-ই হচ্ছে আসল পাগল’! ......এই হাসপাতালে কোনজন ডাক্তার আর কোনজন প্রতিবন্ধী সেটা অনুমান করাই জটিল বিষয়! যদিও কোন কোন ডাক্তারের ‘এ্যাপ্রন’ আছে; কিন্তু প্রতিবন্ধীরা চান্স পেলেই ডাক্তারদের ‘এ্যাপ্রন’ নিজেরা পরেই ‘ভাব নিয়ে’ ঘুরে বেড়ায় ! এ এক অদ্ভূত জায়গা!
সুতরাং আমি ধরে নেই- এই মেয়েটিও প্রতিবন্ধী! নইলে খোলা একটা রিকসা ভ্যানে করে হাসপাতালে আসবে কেনো এভাবে? এরমাঝে মেয়েটি রিকশা চালককে হুকুম দেয়- জোরে রিকশা চালিয়ে এখান থেকে চলে যেতে। ওঁর কথা শুনে আমি এক পা দিয়ে রিকশার চাকা আটকে দিয়ে দ্রুত শট নিতে থাকি। ...... ঠিক এই সময়েই ঘটলো আসল ঘটনাটি। হাসপাতালের সামনের বাগানের দিক থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এলো দু’জন যুবক। তারমধ্যে একজন প্রায় ছ’ফুট তিন ইঞ্চির মতো লম্বা। পেটানো শরির, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, হাতে একটা গাছের ডাল।
ওঁদের দেখেই মেয়েটির শোক আরো উতলে উঠলো। প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে সে অভিযোগ করলো আমাদের বিরুদ্ধে। ব্যাস, ‘শুয়রের.........’ বলে সে তেড়ে এলো আমার দিকে। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি ক্যামেরা নিয়ে দিলাম দৌড়। সুপন কিছু একটা বলে যুবকটাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কীসের কি! সে পেটাবেই আমাদের (অন্তত আমাকে)!
আমি এক দৌড়ে চলে গেলাম পাশের ভবনের তিন তলায়। যাবার আগে নিচে কলাপসিবল গেটটা বন্ধ করার জন্য বলে এলাম গেটম্যানকে। তিন তলার বারান্দায় এসে দেখি- ঘটনাটি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন খালাম্মা আর আবেদ ভাই। ওঁরা দু’জনেই ওই যুবক দু’টিকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন- কিন্তু লম্বা যুবকটি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না তখনো!
আমি যথারীতি ‘উদ্ভূত পরিস্থিতি’ ধারণ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি তখোন! জানি, এই ঘটনাটিই আমাদের অনুষ্ঠান ‘ঘটনার আড়ালে’র একটা ‘সাইড স্টোরি’ হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে! যাই হোক, অল্পের জন্য সেদিন গাছের ডালের পিটুনি থেকে বেঁচে এসেছিলাম খালাম্মা আর আবেদ ভাইয়ের মধ্যস্ততায়!
সে যাত্রায় অনেক মজার মজার ঘটনার সন্মুখিন হয়েছিলাম আমরা। মহিলাদের ওয়ার্ডে গিয়ে এক ভিন্ন রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলাম সেদিন। ওখানকার ‘ওয়ার্ড’গুলোও কিন্তু দেখতে আমাদের জেনারেল হাসপাতালের ‘ওয়ার্ডের’ মতোই অনেকটা। একটি বিশাল কামরা। প্রশস্ত সেই কামরার দু’পাশে সারি সারি বিছানা। প্রতিটি বিছানায় একজন করে প্রতিবন্ধী অবস্থান করছেন। ওয়ার্ডের প্রবেশ-মুখে প্রসস্থ কলাপসিবল গেট। গেট বিশাল এক তালা দিয়ে বন্ধ।
গেট খোলার আগেই আমি এপার থেকে কয়েকটি শট নিয়ে নেই। কামরার প্রায় মাঝখান থেকে এক যুবতী হঠাৎ লাফ দিয়ে চলে আসে আমার ক্যামেরার একদম সামনে। গেটের ওপার থেকে বলে উঠলো- “কায়সার হামিদ..., আই লাভ ইউ......”! ক্যামেরা চালিয়ে রেখে- আমি ওঁকে শুধরে দিয়ে বলি- আমি কায়সার হামিদ নই, আমি কাওসার চৌধুরী! মেয়েটি বলে- “ওসবে আমার কিছুই আসে যায়না, তুমি আমার কায়সার, ব্যাস! ওটাই যথেষ্ট। ......তুমি আমাকে ভুলে গিয়েছো কায়সার, কার্জন হ’লে কতবার তোমার সাথে দেখা হলো......! দাও, তোমার হাতটা দাও, একটু ধরবো, কতোদিন তোমার হাত ধরি না”!
আমি আড় চোখে আবেদ ভাই আর খালাম্মার দিকে তাকাই- নির্দেশনার আশায়। উনারা দু’জনই সম্মতিসূচক ইশারা দিলেন- ‘হাত বাড়িয়ে’ দেবার জন্য। সম্মতি পেয়ে আমি মেয়েটির ওপরে ক্যামেরা (শোল্ডারে) চালিয়ে রেখেই- কলাপসিবল গেটের এপার থেকে বাঁ হাতটি এগিয়ে দেই ওঁর দিকে।
ভেবেছিলাম হয়তো অনেক পাগলামি করবে হাতটি নিয়ে! কিন্তু না, খুব স্বাভাবিকভাবে হাতটি ওঁর গালে ছোঁয়ালো আলতো করে। দু’হাতে আমার হাতটি ধরে রাখলো কয়েক সেকেণ্ড। এরপর ছলছল চোখে বললো- “জানো কায়সার, আমাকে তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য ওরা আমাকে পাগল বানিয়ে এখানে রেখে গেছে......!” এবারে আমারই চোখ ভিজে উঠার পালা! আমি উৎসূক হয়ে উঠি আসল ঘটনাটি জানার জন্য।
পরে ডাক্তারদের কাছে জানা গেলো- মেয়েটি আসলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানি’র ছাত্রী। প্রেমে ব্যর্থতাই ওঁকে নিয়ে এসেছে এই হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন- ‘কোন না কোনভাবে মেয়েটি আপনাকে ওর প্রেমিকের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। সে আপনাকে আসলে টেলিভিশন নাটকেই দেখেছে। কিন্তু আপনার নামটি আবার গুলিয়ে ফেলেছে- ফুটবলার ‘কায়সার হামিদের’ সাথে! ‘এই ধরণের অবস্থায়’ এগুলো হয়েই থাকে! ......আপনার কোন বৈশিষ্ট হয়তো ওর প্রেমিকের সাথে মিলে যায়! ওটার প্রভাবেই সে এই ‘বিহেভ’টা করেছে- একদম ঘোরের ভেতরেই।’
সব শুনে বুকের ভেতরে এক ধরণের কষ্ট অনুভূত হতে থাকলো ওঁর জন্য! কেমন যেনো একটা ব্যাথা সঞ্চারিত হলো সারা হৃদয়ে! ......মেয়েটার জন্য এটা কি আসলে এক ধরণের মায়া, নাকি স্নেহ? নাকি ভালোবাসা? নাকি শুধুই ‘মানবিক অনুভূতি’র অংশ মাত্র! তার উত্তর সেদিনও যেমন পাইনি; আজ এত বছর পরে, এই পরিণত বয়সে এসেও উত্তরটি মিলছে না কিছুতেই! মানুষ বড়োই বিচিত্র! তার চেয়ে বিচিত্র তার হৃদয়! সবচেয়ে বিচিত্র সেই হৃদয়ের অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতিগুলো! আহা রে মানব হৃদয়, মানব জীবন......! বড়ো অসহায় সে তার হৃদয়ের কাছে!
এর কাছাকাছি আরেকটি ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমরা একদিন- ঢাকা সেন্ট্রাল জেলখানায়। ওখানে মহিলাদের ওয়ার্ডে বেশ সুন্দরী এক মহিলা আবেদ ভাইকে জব্দ করেছিলেন ‘পূর্ব পরিচিত’ মনে করে। অবশ্য তিনিও মানসিক ভারসাম্য হারানোদের একজন ছিলেন। ওই চ্যাপ্টার নিয়ে লিখবো আরেক দিন।
ফিরে আসি পাবনায়! সেদিন ওই একই ওয়ার্ডে রাবেয়া খালাম্মা আবিষ্কার করলেন আরো একটি মেয়েকে- যিনি আসলে সম্পূর্ণটাই সুস্থ! মেয়েটির বয়স ২৫ থেকে ৩০ মধ্যেই হবে হয়তো। নিজের বিছানায় বসেছিলেন একদম চুপচাপ। কেমন করে জানি মেয়েটি খালাম্মার নজরে পড়ে যায়। খালাম্মা মেয়েটিকে ধরে বসেন ‘তার কাহিনী’ জানার জন্য। ‘প্রচার না করার শর্তে’ মেয়েটি খালাম্মাকে সব কথা খুলে বলেন।
জানা যায়- মেয়েটির নিজেদের বাড়ি ঢাকার বনানীতে। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের কারনে নানান ষড়যন্ত্র আর অন্যায়-অনিয়মের ভেতর দিয়ে মেয়েটিকে যেতে হয় পাবনা মানসিক হাসপালে। জেনে আপনারা আনন্দিত হবেন- পাবনা থেকে ফিরে এসে রাবেয়া খালাম্মা কিন্তু নিজের চেষ্টায় মেয়েটিকে ওই হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করে পরিবারে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। সাথে ব্যবস্থা করেছিলেন ‘আইনী নিরাপাত্তার’। পাবনার পুরো ঘটনাগুলো নিয়ে খালাম্মা ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন তখোনকার ‘ভোরের কাগজে’। পরে সে লেখাগুলো জড়ো করে একটা উপন্যাসে রূপ দেন তিনি। উপন্যাসের নামটি একটু পরেই জানাচ্ছি আপনাদের।
সেবারে ওই হাসপাতালে সুপন রায় আবিষ্কার করেছিলেন এক ডাক্তা্রকে- যিনি অসাধারণ সুন্দর গান করতেন। কিন্তু উনি ছিলেন ‘ড্রাগের থাবায় আক্রান্ত’! গানসহ উনার বিষয়টি আমরা ‘অন এয়ার’ করেছিলাম। পরে কিছুদিনের মধ্যেই উনি ড্রাগের থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছিলেন। সেটাও আমরা অন্য একটি পর্বে প্রচার করিয়েছিলাম বিটিভি থেকে।
পাবনাসহ এত এত ঘটনার কথা এলো কিন্তু সাগর ভাইয়ের কল্যাণে। সেদিন যখন উনার কামরায় গেলাম দেখা করতে; এ কথা সে কথার পরে সাগর ভাই খালাম্মার একটি এবং উনার নিজের লেখা একটা বই আমাকে উপহার দেন।
সাগর ভাইয়ের লেখা বইটির শিরোণাম- ‘অনেক রঙের লেখা’। আর রাবেয়া খালাম্মার বইটির শিরোণাম- ‘রাবেয়া খাতুন, স্বপ্নের সংগ্রামী’। এটা একটি সংকলন গ্রন্থ। সম্পাদনা করেছেন শিশু সাহিত্যিক আহমাদ মাযহার। এতে- শামসুর রাহমান, গাফফার চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, রাহাত খান, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর, শাইখ সিরাজ, লুৎফর রহমান রিটন, আমীরুল ইসলাম এবং আহমাদ মাযহার নিজেও লিখেছেন রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে।
আর, সাগর ভাইয়ের বইটিতে আসলেই ‘অনেক রঙের লেখা’ সন্নিবেশিত হয়েছে। এই গ্রন্থের সূচি’টি দেখলেই বিষয়ের বৈচিত্র নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না। সূচিতে উল্লেখ আছে- জ্যাকসন হাইটসে লাল-সবুজ পতাকা, বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে, বিশ্বময় বাংলা গান, মুক্তিযুদ্ধের বাড়ি, আম্মা- আপনার জন্মদিনে, স্বপ্নের সেতু, বাংলাদেশ টেলিভিশনের জন্মদিনসহ- আরো অনেক বিষয়!
সাগর ভাইয়ের লেখা নিয়ে কথা বলার মতো ধৃষ্টতা আমার কোনদিনই হবে না! ‘একুশে পদক’ অর্জন করা লেখক ফরিদূর রেজা সাগর- লিখতে শুরু করেছিলেন সেই ষাটের দশক থেকেই। উনার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা কতটি- তার সঠিক সংখ্যাটি আমার জানা নেই! দুঃখিত। তবে এইটুকু অনুমান করতে পারি- সে সংখ্যা অবশ্যই শতাধিক।
সাগর ভাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ- আমাকে ‘উষ্কে’ দেবার জন্য। রাবেয়া খালাম্মার বইটি সেদিন সাগর ভাইয়ের হাত থেকে না পেলে- পাবনা মানসিক হাসপাতালের কাহিনীগুলো হয়তো এত তাড়াতাড়ি লেখা হতো না! কিন্তু আমার প্রতি সাগর ভাইয়ের স্নেহ-ভালোবাসা সেগুলোকে উষ্কে দিয়েছে- প্রকাশ করতে।
রাবেয়া খালাম্মার আত্মা চিরশান্তিতে থাকুক। খালাম্মা জান্নাতে আছেন- আমার স্থির বিশ্বাস! সাগর ভাই সুস্বাস্থ্য নিয়ে শতায়ূ হোন। ভালো থাকুন আমীরুল, মাযহার, সুপন রায়, ফাইজুল, আবেদ ভাইসহ উল্লেখিত অন্যান্য শ্রদ্ধাভাজনেরা।
আপনাদের কল্যাণ হোক বন্ধুগণ।
অনেক ভালো থাকুন।