এম আব্দুর রাজ্জাক,ছাতিয়ানগ্রাম, বগুড়া থেকে : বাংলাদেশের বিখ্যাত নাটোরের মহারানী ভবানীর জন্মস্থান বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার ১ নং ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের পিছনে। রানী ভবানীর বাবার নাম ছিল জমিদার আত্তারাম চৌধুরী। জন্ম সম্পর্কে অনেক ইতিহাস আছে।হযরত দেওয়ানতুল্লাহ খোন্দাকার ( রহঃ) মোঘল আমলের শেষ দিকে রংপুর অঞ্চল থেকে বগুড়া জেলার আদমদিঘী থানায় ছাতিয়ানগ্রামের নিমাইদিঘী গ্রামে আগমন করেন। তার আদি নিবাস কোথায় তা কেউ বলতে পারেন না। নিমাইদিঘী গ্রামে তার আস্তানা ছিল এবং বতর্মানে তার নামে দেওয়াতুল্লাহ একটি পুকুর আছে এবং এখানেই (নিমাইদিঘী দিঘির পাড়ে) তার মাজার বিদ্যামান। তার মাজারের পাশে আরও কতক গুলো মাজার লক্ষ্য করা যায়।
হযরত দেওয়ানতুল্লাহ ছিলেন একজন কামিল পীর। তার অসংখ্য কেরামতের কথা লোকের মুখে মুখে শোনা যায়। তেমনি একটি কেরামতের ঘটনা, রানী ভবানীর জন্ম সম্পর্কে। জমিদার আত্তারাম চৌধুরী রানী ভবানীর পিতা। দীর্ঘ দিন কোন সন্তান হয় না আত্তারাম চৌধুরীর। তার ভবন থেকে সামান্য পূর্বে নিমাইদিঘী নামক স্হানে এক বিশাল দিঘীর পাড়ে পীরের আস্তানায় যান। জমিদার আত্তারাম চৌধুরী তার মনের আকাংখার কথা জানান, পীর সাহেব হযরত দেওয়ানতুল্লাহ (রহঃ) কাছে। পীর সাহেব তখন তাকে একটি তদবির দেন এবং বলেন যে, যাও তোমার একটি সন্তান হবে তবে তা হবে কন্যা সন্তান এবং কাল যে ইতিহাসে স্বরনীয় হয়ে থাকবে। তার পর যথা সময়ে আত্তারাম চৌধুরীর স্ত্রী শ্রী তমা দেবী চৌধুরীনীর একটি কন্যা সন্তান প্রসব করেন। যার নাম রানী ভবানী। সন্তান লাভের পর আত্তারাম চৌধুরী পীর সাহেকে ৮০ বিঘা রাজ জমি লিখে দান করেন। আত্তারাম চৌধুরী একটি তামার পাত্রে উক্ত ৮০ বিঘা সম্পত্তি দলিল করে দিয়েছিলেন।রানী ভবানীর জন্মঃ ১৭১৬ সালে, ছাতিয়ানগ্রাম, আদমদিঘী, বগুড়া, ( সুবাহ বাংলা)।পিতাঃ জমিদার আত্তারাম চৌধুরী মাতাঃ তমা দেবী চৌধুরীনী।রানী ভবানীর মৃত্যুঃ ৫ ই সেপ্টেম্বর ১৮০২ সালে নাটোর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত ( বতর্মান বাংলাদেশ )। নিমাইদিঘী গ্রামের সাংবাদিক এম আব্দুর রাজ্জাকের পরিবারের পূর্ব পূরষ জমিদার মানিক উদ্দিন সরদার গং প্রায় ৩৫০ বিঘা জমি প্রজাসত্ব হিসেবে গ্রহন করে সেই সময়ে। নিজের বিয়েতে তিনটে শর্ত রেখেছিলেন রানি ভবানী? ঠিক যেন দুষ্মন্ত আর শকুন্তলার গল্প। নাটোরের জমিদার জঙ্গলে শিকার করতে গিয়ে দেখতে পেলেন অপরূপ সুন্দরী এক মেয়েকে। সেই মেয়ে অবশ্য কোনো আশ্রমকন্যা ছিলেন না। তিনিও ছিলেন জমিদারের মেয়ে। তবে তাঁর বাবা আত্মারাম চৌধুরীর জমিদারি নাটোরের থেকে অনেকই ছোটো। সে যাই হোক, রামকান্ত সেই মেয়েকেই বিয়ে করবেন বলে পণ করে বসেছেন। এত বড়ো জমিদারের কথায় না কীভাবে বলেন আত্মারাম? আর সুবর্ণ সুযোগ যখন সোজা বাড়ির দরজায় হাজির। কিন্তু মেয়ে বড্ড জেদি। তিনি বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য তিন তিনখানা শর্ত রেখে বসলেন। এক, বিয়ের পর এক বছর তাঁকে বাপের বাড়িতে থাকতে দিতে হবে। দুই, এলাকার দরিদ্র মানুষকে দান করতে হবে জমি। আর তিন নম্বর শর্তটা আরো অদ্ভুত। বাবার জমিদারি বগুড়ার আদমদিঘীর ছাতিয়ানগ্রাম থেকে নাটোর পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে সেটা লাল শালু দিয়ে ঢেকে দিতে হবে, যার ওপর দিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবেন তিনি ( যেমন বতর্মান লাল গালিচা)। রামকান্ত অবশ্য প্রত্যেকটা শর্তই মেনে নিলেন। আর বিয়ের পর সেই মেয়ে হয়ে উঠলেন নাটোরের জমিদারগিন্নি, রানি ভবানী।
রানি ভবানীর বিয়ে নিয়ে প্রচলিত আছে এমনই গল্প। তবে, জমিদারগিন্নি থেকে তাঁর রানি হয়ে ওঠার পথটা অবশ্য অনেকটাই দীর্ঘ। তাঁর এবং রামকান্তের তিন সন্তানের মধ্যে শুধু মেয়ে তারাসুন্দরী বাদে দুই ছেলে খুব ছোটোবেলাতেই মারা যান। এই তারাসুন্দরীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা। পরে রামকৃষ্ণ নামের একটি ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলেন রানি ভবানী। রামকান্তও অকালে চলে যান পৃথিবী ছেড়ে। তখন অবশ্য বাংলার নবাব ছিলেন সিরাজের দাদু আলিবর্দি খাঁ। নাটোরের জমিদার মারা যাওয়াতে নবাব আলিবর্দি নাটোরের জমিদারি পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেন রানি ভবানীর হাতে। এই রানি ভবানীর জমিদারি বিস্তৃত ছিল এখনকার রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোর, রংপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ছাড়িয়ে মালদা পর্যন্ত যা ১২,০০০ হাজার বর্গ মাইলের বেশি ভূ-সম্পত্তির মালিক হন তিনি। হল ওয়েলের বর্নণা মতে, প্রায় ৩০ দিনের একটানা পথ রানী ভবানীর রাজ্য ছিল এবং রানী ভবানী নামে অধিকার ভুক্ত বিপুল জমিদারী। ১৭৪৮ থেকে ১৮০২ সাল পর্যন্ত ৫৪ বছর ধরে এত বিশাল জমিদারি সামলিয়ে তিনি পরিচিত হলেন ‘অর্ধবঙ্গেশ্বরী’ নামে। জমিদারির তরফ দেখে নবাবকে রাজস্ব দিতেন বছরে প্রায় সত্তর লক্ষ টাকা। অর্থাৎ তখনকার দিনে খুব বড়ো একটা অংক। হলওয়েল সাহেব লিখে গেছেন, নবাব এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি – দু’পক্ষই রানিকে বেশ সমীহ করে চলতেন। তবে, পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পক্ষ নিয়ে লড়ার জন্য সৈন্যবাহিনী পাঠিয়েছিলেন রানি ভবানী।
এত কিছুর পরও প্রজাদের জন্য যা কিছু করে গেছেন তা প্রবাদপ্রতীম। জল খাওয়ার জন্য অসংখ্য জলাশয়, পথিকদের জন্য পান্থশালার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভবানী জাঙ্গাল’ নামের সেতু আর রাস্তাও তৈরি করিয়েছিলেন। হাওড়া থেকে কাশী পর্যন্ত রাস্তার ব্যবস্থা করেছিলেন, কাশীতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভবানীশ্বর শিব মন্দির। ব্রাহ্মণদেরও দান করতেন প্রচুর টাকা। আরও কত যে মন্দির তিনি স্থাপন করেছিলেন তা বলে শেষ করা যাবে না। শোনা যায়, বিয়ের আগে বাবার জমিদারি অঞ্চলে তিনি ৩৬০টা পুকুর খুঁড়িয়েছিলেন আর প্রত্যেকদিন আলাদা আলাদা পুকুরে স্নান করতেন। ঐ পুকুর গুলো প্রধানত তদানিন্ত ছাতিয়ানগ্রাম মৌজার ৪ টি পাড়া - ছাতিয়ানগ্রাম, নিমাইদিঘী, চৌধুরী পাড়া এবং বৃন্দাবনের মধ্য সীমাবদ্ধ ছিল। ৭৬ এর দূর্ভিক্ষ এর সময়ে রানী ভবানী নিজের রাজ কোষ শুন্য করে লক্ষ লক্ষ প্রজার অন্ন কষ্ট দুর করেন।দান, ধ্যান, শিক্ষা, পানীয় জলের ব্যবস্হা, উন্নয়ন, চিকিৎসা ও ধর্মীয় কাজের সূচক হিসেবে তার প্রজারা তাকে "মহারানী " নামে আখ্যায়িত করে।
নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার বিরুদ্ধে কাশিম বাজার কুঠিতে ইংরেজদের বিরোধীতা জানিয়েছিলেন যে, খাল কেটে কুমির - না আনার জন্য দেশিয় রাজা - জমিদারদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন।মুলত তিনি বেনিয়া ইংরেজদের বিতারনের জন্য অগ্রনী ভূমিকা পালন করে এবং ইংরেজ বিরোধিতা আন্দোলনের মহামান্য নেতৃবৃন্দ যেমন, সিরাজ উদদৌল্লাহ, ফকির মজনু শাহ, সম্রাট শাহ আলমের সাথে তার সু সম্পর্ক ছিল। রানী ভবানীর জমিদার ভুক্ত এলাকাগুলোতে ফকির মজনু শাহ যথেষ্ট সহোযোগীতা পেয়েছিলেন।
জমিদারির কাজে তাঁকে সাহায্য করতেন দেওয়ান দয়ারাম। তাঁর মতো সৎ, বিশ্বস্ত আর কর্মঠ অনুচর খুবই দুর্লভ। এদিকে ইংরেজ রাজত্ব শুরু হলে রানির দেবোত্তর ও ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তির ওপর কর বসতে থাকে। পাঁচশালা বন্দোবস্তে কোম্পানির রাজস্বও ছিল খুব চড়া। জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁইয়া হয়ে পড়েছিল। তারপর গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে তিনি বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত পালিত ছেলে রামকৃষ্ণের হাতে জমিদারি তুলে দিয়ে রানি ভবানী চলে যান স্বেচ্ছায় গঙ্গাবাসে। ছাতিয়ানগ্রামে রানী ভবানীর জন্ম স্হান সামান্য দক্ষিণে রয়েছে গাজী পাতলা পীর ( রহঃ) এর মাজার শরীফ।
মহারানী ভবানীর জন্ম স্হান বাড়ী নিজ সরেজমিনে পরিদর্শন করলাম। কালের সাক্ষী হয়ে আছে আত্তারাম চৌধুরীর বাড়ি। কালের বিবতৃনে রানী ভবানীর বাড়িটি অনেকেই জায়গা জমি বেদখল করেছেন। এলাকা বাসির প্রানের দাবি সরকারের প্রতি অতিদূত সাংস্কৃতি পূরাকির্তী নিদর্শন বিভাগ থেকে সংরক্ষণ করা জরুরি এ জন্য বগুড়া জেলা প্রশাসক সহ সরকারের উদ্ধতন কর্মকর্তা সহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ও সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী এবং মাননীয় সচিবের নিকট বিশেষ দৃষ্টি আবতর্মানে জায়গাটি চারিদিকে সংরক্ষণ করার পর যদি বিভিন্ন তথ্য যুক্ত সাইন বোর্ড দিয়ে রানী ভবানীর স্মৃতি বিজড়িত তথ্য দেওয়া হয় তাহলে আগামী প্রজন্মেরা অনেক কিছু ইতিহাস জানতে পারবে সেই সঙ্গে মিনি পযর্টন কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে আর এই অবহেলিত জায়গায় টি বাংলাদেশের সকলের নিকট পরিচিত মহারানী ভবানীর জন্মস্হান বাবার বলে পরিচিত লাভ করবে।