ইয়াসমিন, তনু, ফেলানী, আছিয়ার—এই নামগুলো বাংলাদেশের নারী নির্যাতনের নির্মম ইতিহাসে একেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়। প্রতিটি ঘটনা শুধু একটি মৃত্যু নয়, বরং একটি ব্যবস্থার ব্যর্থতা, একটি সমাজের নৈতিক পতন এবং রাষ্ট্রের অপরাধীদের প্রতি নিষ্ক্রিয়তার প্রতীক। ইয়াসমিন হত্যাকাণ্ড যেমন ছিল এক ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক মোড়-বদলের সম্ভাবনা, ঠিক তেমনই তনু, ফেলানী কিংবা আছিয়ার ঘটনা আজকের রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা, বিচারের অযোগ্যতা এবং বিচারহীনতার ধারাবাহিকতা বোঝায়। ১৯৯৫ সালের এক আগস্টের রাতে দিনাজপুরের অন্ধকারে রাষ্ট্রের পোশাকধারী রক্ষকেরাই ধর্ষক ও খুনি হয়ে উঠেছিল। ১৪ বছর বয়সী কিশোরী ইয়াসমিন আকতারকে রাজধানীগামী বাসে উঠিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তিন পুলিশ সদস্য তাকে নিয়ে যায় শহর থেকে কিছু দূরে। এরপর ঘটে পৈশাচিক ধর্ষণ, এবং তাকে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া হয়।
এই ঘটনায় পুলিশ নিজেই ছিল এই বর্বর অপরাধের মূল হোতা। এরপর জনগণের উত্তাল বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায় আরও ৭ জন। যদি তখন সরকার দৃষ্টান্তমূলক ও নির্ভেজাল বিচার নিশ্চিত করত, তবে আজ হয়তো আমাদের সমাজ এতটা পচে যেত না। কিন্তু তা হয়নিহয়তোবা। রাষ্ট্র তখন চেয়েছিল ঘটনা ধামাচাপা দিতে, পুলিশ প্রশাসন আত্মগোপনে যায়, আর স্থানীয় প্রশাসন নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকায় থাকে। কিন্তু দিনাজপুরবাসী সেই রাত বিচারহীনতার প্রতিরোধে এমন আত্মদান বিরল। যদি তখনই সরকার দৃঢ়, নিরপেক্ষ ও দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নিত, তাহলে হয়তো এই জাতিকে বারবার তনু, ফেলানী, আছিয়ার নাম মুখস্থ করে চলতে হতো না।এই বিচারহীনতার ধারায় আমরা দেখতে পাই আরও কিছু নারকীয় ঘটনা—তনু, ফেলানী, আছিয়া—যাদের অপমৃত্যু একেকটি সামাজিক ব্যাধির আয়না হয়ে রয়ে গেছে। কাঁটাতারের গলায় ঝুলে থাকা এক গোটা জাতির লজ্জা আমরা আড়াল করব কি দিয়ে তা ভাবার সময় এসেছে।
২০১১ সালে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর সীমান্তে ভারতের BSF-এর গুলিতে নিহত হয় ১৫ বছর বয়সী ফেলানী খাতুন। সে তার বাবার সঙ্গে বাংলাদেশে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হয় এবং তার দেহ ঝুলে থাকে সীমান্তের কাঁটাতারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেই ছবি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের বিরুদ্ধে নিন্দা জানানো হয় বটে, কিন্তু কোনো বাস্তব বিচার হয়নি। ভারতের পক্ষ থেকে অপরাধীকে ‘নিষ্পাপ’ বলে ছাড় দেওয়া হয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক যদি এমনভাবে অন্য রাষ্ট্রের বাহিনীর হাতে নিহত হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও নৈতিক অবস্থান হওয়া উচিত কঠিন ও জিরো-টলারেন্সে বিশ্বাসী। কিন্তু ফেলানীর মৃত্যুর পর আমরা দেখেছি নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, দায়িত্বহীন প্রতিবাদ, এবং একদম নিস্তব্ধ বিচারব্যবস্থা। ফেলানী হয়ে উঠেছে সেই অনামী নারী প্রতীকের প্রতিচ্ছবি, যার মৃত্যুকে রাষ্ট্র "সংবেদনশীলভাবে উপেক্ষা" করে। ন্যায়বিচার অমীমাংসিত।তনুর স্বপ্ন নিরব কান্নায় শূন্যতায় ভাসে।
২০১৬ সালে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হন। সে নাট্যকর্মী ছিল, স্বপ্ন দেখত শিক্ষক হবার। কিন্তু সেই স্বপ্ন রয়ে গেলো থেমে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মতো একটি উচ্চ নিরাপত্তাবলয়ে সংঘটিত এই নৃশংসতা রাষ্ট্রের এক ভিন্ন রূপ তুলে ধরে। এই ঘটনায় এখনো পর্যন্ত কোনো চার্জশিট হয়নি, নেই কোন দায় স্বীকার, বরং তদন্তের নামে ঘটনার গতিপথ বদলে দেওয়া হয়েছে বারবার। কিন্তু এত বছরেও কোনো বিচার হয়নি, কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয়ে সত্য চাপা পড়ে গেছে। ইয়াসমিনের ঘটনায় যেমন পুলিশ অপরাধী হয়েও প্রাথমিকভাবে রক্ষা পেয়েছিল, তেমনই তনুর ঘটনায় সেনাবাহিনীর আবরণে তদন্ত থমকে যায়। তনুর মৃত্যুর পর তুমুল প্রতিবাদ গড়ে উঠেছিল শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের মধ্য থেকে। কিন্তু রাষ্ট্র? সে ছিল নিশ্চুপ, নির্বিকার। তনু যেন এক ‘অস্বস্তিকর সত্য’, যাকে দেখে না দেখার ভান করাই শ্রেয় মনে করেছিল রাষ্ট্রযন্ত্র।
২০২৫ সালের ৬ মার্চ, আছিয়া তার বড় বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে গেলে ধর্ষণের শিকার হয়। পরবর্তীতে, ১৩ মার্চ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় আছিয়ার মা চারজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন: হিটু শেখ (বোনের শ্বশুর), সজিব শেখ (দুলাভাই), রাতুল শেখ (সজিবের ভাই), এবং জাহেদা বেগম (সজিবের মা)। হিটু শেখ আদালতে ১৬৪ ধারায় ধর্ষণ ও হত্যার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। তার ডিএনএ পরীক্ষার ফলও ধর্ষণের সঙ্গে মিল পায়। মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে—১৭ মে ২০২৫ সালে—মাগুরা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এই মামলার রায় ঘোষণা করে। হিটু শেখকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি তিন আসামি সন্দেহের উপরে অপরাধ প্রমাণ না হওয়ায় খালাস পায়।
এই দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া অনেকের কাছেই ইতিবাচক নজির হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ অধিকাংশ ধর্ষণ মামলায় বিচার দীর্ঘসূত্রতা ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ঘাটতির কারণে দীর্ঘমেয়াদি হয় অথবা শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার ব্যর্থ হয়। রাষ্ট্র কি সত্যিই ব্যর্থ, না ইচ্ছাকৃত উদাসীন- বিচারহীনতা কেবল একটি ত্রুটি নয়, এটি একটি সাংগঠনিক ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক দুর্নীতির প্রকাশ। এই দেশে নারী ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় যখন ক্ষমতাবানদের সংশ্লিষ্টতা থাকে, তখন দেখা যায় তদন্ত থেমে যায়, প্রমাণ ‘হারিয়ে’ যায়, এবং পরিবারগুলো দিশেহারা হয়ে পড়ে। একটি সভ্য রাষ্ট্রে এমনটি হবার কথা নয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটি চলতে পারে না। ইয়াসমিনের ঘটনায় যেভাবে জনগণ আন্দোলন করে বিচার আদায় করেছিল, তেমনটি এখন আর হয় না, কারণ রাষ্ট্র জনগণকে ভীত করে রেখেছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচার ব্যবস্থা, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা একই ছাতার নিচে মিশে গিয়ে এক প্রকার আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে—যার মধ্যে নারী নিপীড়নের জন্য কোনো জায়গা নেই।
একবার যদি রাষ্ট্র কোনো ভয়াবহ অপরাধকে ক্ষমা করে দেয় বা চেপে যায়, তাহলে সেই নৈতিক পতনের শুরু হয়। ইয়াসমিনের ঘটনার সময় যদি সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নিত, তাহলে হয়তো তনু বা ফেলানীকে আর প্রাণ দিতে হতো না। প্রতিটি ঘটনার পেছনে ক্ষমতার বলয় দাঁড়িয়ে আছে। আইনি কাঠামো থাকলেও, প্রয়োগ নেই। যার ফলে মানুষ অপরাধ করেও জানে, সে রক্ষা পাবে। এই ঘটনাগুলোর মূল ভিত্তি সমাজের ভেতরকার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা। আইন শুধু শাস্তি দিতে পারে, কিন্তু মূল্যবোধ না পাল্টালে এই ব্যাধি থেকে মুক্তি নেই। কাঠামোগত কারণ,পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো,নারীদেহকে "নিয়ন্ত্রণের"বিষয় হিসেবে দেখা।অপরাধী-মিত্রতা,পুলিশ,প্রশাসন,রাজনীতিবিদদের সাথে অপরাধীদের আঁতাত,ধর্ম ও নৈতিকতার অপব্যবহার ঢাল হিসেবে ব্যবহার।
“ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট অকার্যকর” ২০১২ সালে নারী নির্যাতন দমন আইন শক্তিশালী করা হলেও বাস্তবে মামলাগুলো বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। সীমান্ত নির্যাতনের শিকার ফেলানীর ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা (ভারত-বাংলাদেশ) এড়িয়ে যাওয়া। গণতন্ত্রে যদি নারীর নিরাপদ না হয়, তবে সে কেবলই এক অলঙ্কার ছাড়া কিছু নয়।একটি রাষ্ট্র কতটা সভ্য—তা বোঝা যায়, সেই রাষ্ট্র তার নারীদের কতটা সুরক্ষা দিতে পারে তা দিয়ে। যখন প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনায় পরিবার ও সমাজ চুপ থাকে, যখন রাষ্ট্র প্রতিক্রিয়া জানায় না, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্র তার মৌলিক দায়িত্ব পালনে অপারগ বা অনিচ্ছুক। ইয়াসমিন হত্যাকাণ্ড আমাদের ইতিহাসে একটি সম্ভাবনার চিহ্ন রেখে গিয়েছিল—যেখান থেকে একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারত। কিন্তু সে পথ আর ধরা হয়নি। বরং সেই ব্যর্থতার ধারা বয়ে চলেছে—তনু, ফেলানী, আছিয়া হয়ে আজকের দিনে পৌঁছে গেছে। '
তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ,স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন, ধর্ষণ ও নারী হত্যার মামলার জন্য আলাদা আদালত, সময়সীমা ৬ মাস। রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত তদন্ত,তনু, আছিয়ার মামলায় উচ্চ আদালতের মনিটরিং,দীর্ঘমেয়াদি সমাধান,শিক্ষা ব্যবস্থা, স্কুল-মাদ্রাসায় লিঙ্গ সমতা ও সম্মতি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। সামাজিক আন্দোলন, "ব্লেম দ্য ভিক্টিম" সংস্কৃতি বন্ধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি,আন্তর্জাতিক চাপ,ফেলানীর মতো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ফোরামে বিষয়গুলো তোলা। মিডিয়া ও গণমাধ্যমের ভূমিকা,নাম প্রকাশে সাহস, অপরাধীদের পরিচয় গোপন না করা (যেমন: তনুর আসামিদের নাম মিডিয়ায় কম দেখা যায়),নিরন্তর কভারেজ,বিচার প্রক্রিয়াকে জনসমক্ষে রাখা। এই প্রক্রিয়া গুলি শতভাগ না হলেও অর্ধেক হলেও দেশের মানুষ সুরক্ষিত থাকবে।
"The arc of the moral universe is long, but it bends toward justice." —Dr. Martin Luther King Jr. কিন্তু সেই ন্যায়বিচারকে বাঁকিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন আমাদের সম্মিলিত উচ্চারণ,রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং আইনের শাসনের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধা। নইলে আমরা শুধু নাম মনে রাখব—ইয়াসমিন, তনু, ফেলানী, আছিয়া—আর রাষ্ট্র তাদের রক্তের দায় এড়িয়ে যাবে ইতিহাসের ধূসর অধ্যায়। সময় এখনও ফুরিয়ে যায়নি ২০২৫। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে নারী নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন চাই, তবে ইয়াসমিন হত্যার সময়কার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তনু, ফেলানী, আছিয়ার আত্মাহুতির যথার্থ মর্যাদা দিতে হলে রাষ্ট্রকে এবার জেগে উঠতেই হবে। দ্রুত বিচার, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সমাজের এই ব্যাধি থামবে না। নতুবা আমরা শুধু আরও নতুন ইয়াসমিন, তনু, ফেলানী, আছিয়ার নাম মুখস্থ করেই শোক পালন করে যাবো, কোনো প্রতিকার ছাড়াই। রক্তের দাগ মোছার উপায় বের করে সমাধান করতে হবে। এই মৃত্যুগুলো শুধু সংখ্যা নয়—এগুলো আমাদের বিবেকের মাপকাঠি। থেকে আছিয়ার পর্যন্ত রক্তপাত বন্ধ করতে তিনটি স্তরে লড়াই জরুরি- আইনি- কঠোর শাস্তি ও দ্রুত বিচার, সামাজিক-নারীকে "সম্মান" না দেখে "মানুষ" হিসেবে দেখার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক-ক্ষমতার দুর্বৃত্তায়ন বন্ধ করা। যতদিন না এই ব্যবস্থা পরিবর্তন হচ্ছে, ততদিন তনু, ফেলানী, আছিয়ার নাম আমাদের লজ্জার প্রতীক হয়ে থাকবে। তাদের মৃত্যু বৃথা যাবে না—এই অঙ্গীকারই এখন একমাত্র পথ।