“মেলায় এক ইউনিটের স্টল নিলেও আমাদের সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। সেটা বই বিক্রি করে উঠে আসে না। এজন্য এবার মেলায় স্টল নিতে পারিনি," বললেন প্রকাশক মাইবম সাধন।
ভাষা আন্দোলনের ‘চেতনাকে’ ধারণ করে প্রতিবছর ঢাকায় যে বইমেলা হয়ে আসছে, সেখানে দেশের বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর ভাষার বই উপেক্ষিত থাকছে বলে মনে করছেন লেখক-গবেষকদের অনেকে।
তারা বলছেন, বাস্তবতার নিরিখে এ ধরনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ বিবেচনায় স্টল বরাদ্দ ও প্রণোদনা দেওয়া উচিত মেলার আয়োজক বাংলা একাডেমির।
গবেষক মফিদুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "রাঙামাটি, বান্দরবানসহ কয়েকটা জায়গায় আমি দেখেছি, বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্যিকদের অনেক প্রকাশনা আছে। কিন্তু সেগুলো একুশের বইমেলায় পাওয়া যায় না। আমি মনে করি এই ব্যাপারটি মেলার আয়োজকদের ভাবা উচিত।
“মেলায় যেমন শিশু চত্বর, লিটলম্যাগ চত্বর আছে। তেমনি করে মাঝখানে কিংবা লিটলম্যাগ চত্বরের পাশে নৃ-গোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ও লিটলম্যাগকে বিশেষ বরাদ্দ এবং প্রণোদনা দেওয়া উচিত। এতে করে ভাষার চেতনাকে ধারণ করে যে বইমেলা, সেটি আরও বেশি অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে।"
ছোটবেলা থেকেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা, আর মাতৃভাষা বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন শুভাশিস সিনহা। লেখালেখির জন্য তিনি পেয়েছেন কালি ও কলম সাহিত্য পুরস্কার, সমকাল সাহিত্য পুরস্কারসহ বেশ কয়েকটি সম্মাননা।
শুভাশিস সিনহার মতো নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্যিকদের লেখা কেবল বাংলা ভাষার কিছু বই একুশে বইমেলায় পাওয়া গেলেও তাদের মাতৃভাষায় লেখা সাহিত্যের সাথে খুব একটা পরিচয় হয় না বাংলা ভাষার পাঠকদের।
চাকমা, মারমা, গারো, মণিপুরি ভাষায় লেখা সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ প্রকাশেও খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না মূল ধারার প্রকাশকদের। ফলে দেশের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্যিকরা অচেনাই থেকে যাচ্ছেন বইমেলায়।
২০১৯ সালে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১০’ এর গেজেটে সরকার ৫০টি নৃ-গোষ্ঠীকে তালিকাভুক্ত করে। তাদের মধ্যে ৪১টি ভাষার ব্যবহার রয়েছে, এসব ভাষায় কেউ কেউ সাহিত্য চর্চাও করেন নিয়মিত।
মণিপুরি থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা কবি, নাট্যকার ও সংগঠক শুভাশিস সিনহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরিদের নিজস্ব লিপি ছিল, সেটি নানা কারণে হারিয়ে গেছে। এখন নতুন করে নিজস্ব লিপি উদ্ধারের গবেষণা চলছে। তবে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এখনো বাংলার ব্যবহারই হচ্ছে।
“আমি বাংলা এবং মণিপুরি উভয় ভাষাতেই লেখালেখি করি। মণিপুরি ভাষায় লেখা বইগুলো আমাদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিপণন হয়। বাংলায় লেখা বইগুলো পাওয়া যায় একুশে বইমেলায়।"
বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষায় লেখা শুভাশিস সিনহার কবিতার বইয়ের মধ্যে আছে- 'নুয়া করে চিনুরি মেয়েক', 'নঙমাঙ দিনর কবিতা', 'উদারি বানার দিনে'। গল্পগ্রন্থের মধ্যে আছে- ‘মানু কিদিয়া লেহাউশপাৎ লাল্লাম ইতারাতা' এবং মুক্তগদ্যের বই 'মরা মরা বেনিটিকর য়ারি'।
মেলায় বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্যিকদের লেখা বই দেখা গেল, তবে সেগুলোর ভাষা বাংলা।
মণিপুরি (বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতৈ) ভাষায় সাহিত্যের বই প্রকাশ করে এমন অন্তত তিনটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম জানিয়ে শুভাশিস সিনহা বলেন, "এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত বই আমাদের সম্প্রদায়ের মাঝেই সাধারণত বিক্রি হয়। রাসলীলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উৎসবে এসব বইয়ের স্টলও থাকে। কিন্তু তারা একুশে বইমেলায় খুব একটা অংশ নেয় না।"
'তিউড়ি' নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন মৈতৈ মণিপুরি সম্প্রদায়ের মাইবম সাধন। গত কয়েক বছর একুশে বইমেলায় স্টল নিলেও এবারের মেলায় তিনি স্টল নেননি। তার প্রতিষ্ঠান থেকে ১১৬টি বই প্রকাশ হয়েছে।
এছাড়া পৌরী নামে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে ৪০টিরও বেশি বই প্রকাশ হয়েছে। মণিপুরি থিয়েটার থেকেও বেশি কিছু বই প্রকাশ হয়েছে।
তিউড়ির প্রকাশক ও লেখক মাইবম সাধন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "২০১৬ সাল থেকে আমরা বইমেলায় স্টল নিই। আমাদের বই তো খুব বেশি বিক্রি হয় না। কিন্তু মেলায় এক ইউনিটের স্টল নিলেও আমাদের সব মিলিয়ে ৫০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। সেটি বই বিক্রি করে উঠে আসে না। এজন্য এবার মেলায় স্টল নিতে পারিনি।"
বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেওয়া হলে মেলায় তাদের অংশগ্রহণ বাড়বে বলে মনে করেন মাইবম সাধন। তার ভাষ্য, "আমরা মূলত আদিবাসী লেখকদের বই প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশ করি। বাঙালি লেখকদের বইও প্রকাশ করেছি।
“একুশে বইমেলার আয়োজকদের আমরা আগেও মৌখিকভাবে বলেছি, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্য কয়েকটি স্টল কম টাকায় ভাড়া দেওয়ার জন্য। আগামী বছর আমরা লিখিতভাবে বিষয়টি বাংলা একাডেমিকে বলব।"
আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সঞ্জিব দ্রং বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আগে বইমেলার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আদিবাসী পরিবেশনাগুলো রাখা হতো। আমি নিজেও অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ পড়ার জন্য আমন্ত্রণ পেয়েছি। গত কয়েক বছর ধরে সেটি কমে গেছে।
“মাসব্যাপী মেলায় যদি কয়েক ঘণ্টা আমাদের বরাদ্দ না দেওয়া হয়, তখন বুঝতে হবে আমাদের প্রতি অবহেলা কোন পর্যায়ে গেছে। এছাড়া মেলায় আদিবাসী সাহিত্যিকদের প্রকাশনাগুলোর জন্য একটা কর্নারও রাখা উচিত। তবেই ভাষার চেতনাকে ধারণ করে আয়োজিত বইমেলা কিছুটা অর্থপূর্ণ হবে।"
বইমেলার লিটলম্যাগ চত্বরে ‘থকবিরিম’ নামে একটি ছোটকাগজের স্টলে গিয়ে গারো ভাষার কয়েকজন সাহিত্যিকদের বই দেখা গেল।
কথা নামে আরেকটি স্টলেও রয়েছে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্যিকদের লেখা বই, যেগুলো মূলত বাংলা ভাষাতেই লেখা। যার মধ্যে আছে- লেবিসন স্কু'র লেখা 'বুকের ডালে ঝুলিয়ে নরম নদী', মাইবন সাধনের সম্পাদিত 'প্রান্তিক সুর'। এই বইটিতে অং মারমা, লেবিসন স্কু, নিও হ্যাপি চাকমা ও মাইবম সাধনের লেখা রয়েছে।
এছাড়া ফাদার শিমন হাচ্ছার 'এক জনপদ যাজকের লেখাপত্র', সোহেল ম্রং এর 'রাণীর মেয়ের কাছে খোলা চিঠি', সুমনা চিসিমের 'সাংমা অন আ হুইলচেয়ার' (আ বায়োগ্রাফি অব চিবল সাংমা), রেতা ক্লেমেট রিছিলের 'প্রবন্ধসংগ্রহ', থিওফিল নকরেকের 'আমি উদ্বাস্তু হতে চাই না' এবং 'হৃদয়ের ঢেউ' নামে দুটি বই।
রয়েছে থকবিরিমের ‘তরুণ কবি শাওম রিছিল সংখ্যা’, সুমনা চিসিমের ‘ছোটদের গারো লোককাহিনি’, মিঠুন রাকসামের ‘জাজংনি রাসং জ্যেৎস্নার দেমাক’, এল বীরমঙ্গল সিংহের 'মণিপুরি লোককাহিনি', ইয়াংঙন ম্রো’র 'ম্রো লোকগল্পের সংকলন জুম পাহাড়ের জীবন', মিঠুন রাকসামের ‘মান্দি জাতির পানীয় ও খাদ্য বৈচিত্র্য', জেমস জর্নেল চিরানের 'প্রান্তিক সমাজের কথা প্রসঙ্গ গারো ও হাজং জনসমাজ', এ কে শেরমের ‘মণিদীপ্ত মণিপুরি ও বিষ্ণুপ্রিয়া বিতর্ক ইতিহাসের দর্পণে', মাইবম সাধনের 'গ্রাফিতি', মুসলিম মণিপুরি লেখক হাজী মো. আন্দুস সামাদের 'ঘুরে এলাম মণিপুর'।
লিটলম্যাগ 'চিবিমা' সম্পাদক লেবিসন স্কু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "একুশে বইমেলায় আদিবাসী সাহিত্যকদের অংশগ্রহণ এখন একটু একটু করে বাড়ছে। লিটলম্যাগ চত্বরে কিছু বই পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার পাঠকেরাও আমাদের বইয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছেন। এটা ইতিবাচক।"
সাংস্কৃতিক সংগঠক, নাট্য নির্দেশক রামেন্দু মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "একুশের চেতনাকে ধারণ করে বইমেলা। সেখানে বাংলাদেশেরই অন্য ভাষার সাহিত্যকদের অংশগ্রহণ কম থাকাটা দুঃখজনক।
“তাদের জন্য আলাদা প্যাভিলিয়ন করে বিনা পয়সায় ভাড়া দেওয়া উচিত এবং আদিবাসী সাহিত্যিকদের বই বাংলায় অনুবাদ করে প্রতি বছরই মেলায় প্রকাশ করার দায়িত্ব নেওয়া উচিত বাংলা একাডেমির। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থেকেও বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর অনুবাদ প্রকাশ করতে পারে।"
বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম অবশ্য বলছেন, বইমেলা সবার জন্যই উন্মুক্ত।
“সেখানে বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আবেদন করলে স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়। লিটলম্যাগ চত্বরে নৃ-গোষ্ঠীর স্টলও আছে। এছাড়া বাংলা একাডেমি থেকেও নৃ-গোষ্ঠী এবং নৃ-গোষ্ঠীর সাহিত্যিকদের লেখা বইও প্রকাশ হয়েছে। বইমেলার মূল মঞ্চের সাংস্কৃতিক আয়োজনেও তাদের অংশগ্রহণ প্রতিবছরই থাকে। আমরাও চাই, তাদের অংশগ্রহণ মেলায় বাড়ুক।”