২৩শে ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার ২০২৪- সন্ধ্যায় জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল 'সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক'র নিয়মিত আয়োজন, মাসিক সাহিত্য আসর। আসরটি পরিচালনায় ছিলেন, একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন।শুরুতেই ভাষাশহিদ ও ভাষাসৈনিকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যুত্থানে অবদান রাখা সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
এবারের আসরটি সাজানো হয়েছিল— স্বরচিত পাঠ, একুশের ওপর আলোচনা, আবৃত্তি, বই আলোচনা এবং অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৪ -এ প্রকাশিত বইয়ের পরিচিতি প্রসঙ্গ নিয়ে।প্রথমেই ভাষা আন্দোলনের প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন, লেখক এবিএম সালেহ উদ্দীন। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের জন্য শোকের মাস, চেতনার মাস, বিদ্রোহের মাস। আমরা যদি পৃথিবীর দিকে তাকাই তাহলে বুঝতে পারবো, একুশের যে চেতনা তা জাগ্রত রাখা কতটা প্রয়োজন। একুশকে ধারণ করি ঠিকই, কিন্তু একুশের চেতনাকে যথাযথ জাগিয়ে তুলতে পারি না। ভাষা আন্দোলনের সূত্র থেকেই ক্রমান্বয়ে আমরা একদিন একাত্তরে লাল সবুজ পতাকা নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়েছি। আমাদের জন্য বিষয়টি যেমন আনন্দের ও গৌরবের তেমনি বেদনারও। যে চেতনা ধারণ করে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের জাগরণ, সংস্কৃতির জাগরণ, বিশ্বব্যাপী এসবের সম্প্রসারণের যে স্বপ্ন দেখি, সে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই আজকের সাহিত্য একাডেমিতে একুশ নিয়ে কথা বলতে পারছি। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ না পেলে, নিজস্ব পতাকা না পেলে আমরা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তে পারতাম না। ওয়ার্ড এমারসনের উক্তি টেনে বলেন, একটি ভাষার জাগরণের জন্য যে সাহিত্য এবং সংস্কৃতি প্রয়োজন, সেই সাহিত্য সংস্কৃতি লালন করতে হলে সেই ভাষার চর্চা করতে হবে।
আবৃত্তিশিল্পী শুক্লা রায়ের গ্রন্থনা ও পরিকল্পনায় ছিল একুশের বিশেষ পরিবেশনা ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’। এতে অংশগ্রহণ করেন— পারভীন সুলতানা, তাহরিনা পারভীন প্রীতি, লিপি রোজারিও, শুক্লা রায়, রিচার্ড গোমেজ এবং সুমন শামসুদ্দিন।
প্রবীণ সাংবাদিক ও লেখক মনজুর আহমেদ বলেন, আমি ১৯৫২ সালের একুশের মিছিলে যোগ দিয়েছি। তখন স্কুলের ছাত্র ছিলাম। এবছরে দেখলাম- সরকারি উদ্যোগ কিছুটা আছে কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন উপজাতিরা তাদের নিজেদের ভাষায় কাজ করছে। চোখে পড়লো- হাজল ভাষায় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি। পুরোটা তাদের নিজেদের ভাষায় করে নিয়েছে এবং একই সুরে গাইছে। দেখলাম মার্মারা তাদের বাড়ির আঙিনায় বসে তাদেরই ভাষায় চর্চা করছে। এটি একটি চমৎকার উদ্যোগ, আমার খুব ভালো লেগেছে! স্বরচিত কবিতা পাঠের মধ্যদিয়ে তিনি তার বক্তব্য শেষ করেন।কবি হোসাইন কবীর বলেন, রসুল গামজাতভের একজন আভার ভাষার কবি। তিনি রুশ ভাষায় প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তার আত্মজীবনী মূলক ‘আমার জন্মভূমি দাগেস্তান’ বইটির ৫৭ ও ৫৮ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, কবি একবার ফ্রান্সে গেলেন, দেশের সবাই জানতো তিনি যে গ্রামের বাসিন্দা সেই গ্রামের একজন শিল্পী ফ্রান্সে থাকে, সে বহুদিন আগে মারা গিয়েছে, কিন্তু কবি সেখানে গিয়ে খোঁজখবর নেবার পর জানতে পারলেন, শিল্পিটি মারা যাননি। তিনি ইতালির এক নারীকে বিয়ে করেছেন এবং তার প্রায় প্রতিটি শিল্পকর্ম জুড়েই থাকে ‘আভার ভাষা’র ছাপ। গ্রামে ফিরে সবাইকে বললেন, তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল, সে জীবিত। গ্রামের লোক বিস্মিত! তখন শিল্পীটির মা জানতে চাইলেন, আচ্ছা ‘রসুল, তুমি যখন তার সাথে সাক্ষাৎ করছো তখন সে কোন ভাষায় কথা বলছিল?’ রসুল বললেন, আমাদের মাঝে একজন দোভাষী ছিল, আমি রুশ ভাষায় কথা বলেছি আর দোভাষী অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন, ফরাসি ভাষায়। তখন মা বলে উঠলেন, ‘তুমি ভুল বলছো, সে আমার ছেলে নয়। আমার ছেলে যখন আমার গর্ভে এসেছিল তখন তাকে আমি আভার ভাষায় গান, গল্প ও লোককথা শুনিয়েছি। সে বেঁচে থাকলে তো আমার আভার ভাষা, মায়ের ভাষা ভুলে যেতে পারে না!’ মাতৃভাষা এমনই শক্তিশালী! তিনি ভাষাপ্রেমী শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্তের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন এবং তার প্রতি বাঙালি জাতির কৃতজ্ঞ থাকার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
লেখক ও সাংবাদিক শামীম আল আমিন বলেন, একটা সময় ছিল একুশে ফেব্রুয়ারিকে শুধু আমাদের নিজেদের দিন ভাবতাম, শহিদদিবস হিসেবে পালন করতাম, আর এখন এটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, সারা পৃথিবীর মানুষের দিন। ভাবতে ভালো লাগছে, সারা পৃথিবীর মানুষ আমাদের সাথে দিনটি উদযাপন করছে।এবারের আসরে বই আলোচনায় অংশ নেন নীরা কাদরী। কবি শহীদ কাদরীর 'আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও' বইটি নিয়ে তিনি আলোচনা করেন। শুরুতেই উল্লেখ করেন, শহীদ কাদরীর বই নিয়ে আলোচনা করবো, এটা আমার ধৃষ্টতা বলা যায়। তবুও কবিপত্নী হিসেবে কবিকে কাছ থেকে দেখা এবং বইটি প্রকাশ হবার পর আমাদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যদিয়ে উঠে আসা বিষয়গুলোই মূলত বলবো। শহীদ কাদরী বাংলাদেশে থাকা কালীনই তার তিনটি বই প্রকাশ হয়েছিল। সম্পূর্ণভাবে তিনি বিদেশে চলে এসেছিলেন ১৯৮২ সালে। সুদীর্ঘ নীরবতার পর সপ্রতিভ ও স্বকীয়তায় শহীদ কাদরীর নতুন বই ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও' প্রকাশিত হতেই কবিতাপ্রেমীদের কাছে আগ্রহের কারণ হয়েছে। ‘অবসর প্রকাশনী’ থেকে বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালের একুশের বইমেলায়। ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিকই- কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না’ লাইনটি প্রসঙ্গে বলেন, বিরহ-বিচ্ছেদের অনেক কবিতা আমরা পড়েছি, কবি সমরেন্দু সেন একটি কবিতায় বলেছেন, পৃথিবীতে ঠিক ছেলেটির সঙ্গে ঠিক মেয়েটির বিয়ে হয় না বলেই এত প্রেমের তথা বিরহের কবিতা লেখা হয়। কিন্তু শহীদ কাদরী সম্পূর্ণ ভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলেছেন। তিনি প্রেমের সম্পূর্ণ একটি নতুন আদল ও মাত্রা নিয়ে এলেন আশ্চর্য এই পংক্তিগুলোতে। আরও একটি কবিতায় আমরা দেখতে পাই, প্লেটো, কান্ট, হেগেল, বুদ্ধ, দেকার্তে, হোয়াইটহেড, পিকাসো কিংবা বের্গস কী বলেছেন সেগুলো গ্রাহ্য নাকরে তিনি লিখলেন, ‘আমি এক নগণ্য মানুষ, আমি শুধু বলি— জলে পড়ে যাওয়া ওই পিঁপড়েটাকে ডাঙায় তুলে দিন’। অতি সামান্য কিন্তু নিঃস্বার্থ পরোপকার সাধনে কী সীমাহীন শান্তি পাওয়া যায়। এই কবিতা নতুন ফর্মে সেই ম্যাসেজই দেয়। এই বইয়ের প্রথম কবিতাটি পড়ে মনে হয়েছে, শহীদ কাদরী ‘উত্তরাধিকার’ কবিতার জনক। কয়েক দশক আগে যিনি লিখেছিলেন ‘উত্তরাধিকার’ এবং বিংশ শতাব্দীর শেষে এসে সেই কবি লিখছেন, ‘স্বতন্ত্র শতকের দিকে’। কবিতাটিতে এক বিশ্বখ্যাত রাজনৈতিক ইতিহাস গ্রন্থিত হয়েছে। আমি মনে করি, এই দুটি কবিতার তুলনামূলক আলোচনা হয়তো হবে একদিন। তিনি ‘স্বতন্ত্র শতকের দিকে’ কবিতার শেষ কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করেন। এছাড়াও ‘কক্সবাজারে এক সন্ধ্যায়’ ‘প্রজ্ঞা’ ‘বিপ্লব’ ‘স্বগতোক্তি’ ‘অন্তিম প্রজ্ঞা’ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও' ‘একেই বলতে পারো একুশের কবিতা’ প্রমুখ কবিতা নিয়ে কথা বলেন।
আসরের একপর্যায়ে লেখক রিমি রুম্মান পূর্ব ধারবাহিকতায় নিউইয়র্কে বসবাসরত এগারোজন লেখকের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ ২০২৪ -এ প্রকাশিত বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরেন।
এছাড়াও শিশুশিল্পী রাবেয়া সাবির আবৃত্তি করেন, জসিম মেহবুবের ‘একুশ’ কবিতাটি, এবং আজমাইন স্বপ্নীল আবৃত্তি করেন, কবি শামসুর রাহমানের ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি।
আবৃত্তিশিল্পী শারমিন রেজা ইভা আবৃত্তি করেন নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ‘আমাকে কী মাল্য দেবে দাও’ এম এ সাদেক আবৃত্তি করেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বঙ্গভাষা’, সুমিত্রা সেন আবৃত্তি করেন- দাউদ হায়দারের কবিতা ‘একুশ’ মুনমুন সাহা আবৃত্তি করেন, কল্যাণ দাস গুপ্তের লেখা ‘বদন মাঝির ভাষা দিবস’ এবং গোপন সাহা আবৃত্তি করেন, অচিন্ত্য কুমার সেন গুপ্তের কবিতা ‘পুব-পশ্চিম’।
স্বরচিত পাঠে অংশগ্রহণ করেন, মিনহাজ আহমেদ, স্বপন বিশ্বাস, সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায়, রওশন হাসান, ফারহানা হোসেন, লুৎফা শাহানা, ভায়লা সালিনা, তাহমিনা খান, সুলতানা ফেরদৌসী, মাহমুদ রেজা চৌধুরী, আকবর হায়দার কিরণ, জেবুন্নেছা জোৎস্না, জুঁই ইসলাম, মিয়া এম আসকির, মনিকা রায়, শাহীন ইবনে দেলোয়ার, ছহুল আহমেদ, আলম সিদ্দিকী, সবিতা দাস, বেনজির শিকদার প্রমুখ।
এছাড়াও আসরে একুশের গান পরিবেশন করেন, শিল্পী ম্যারিষ্টিলা শ্যামলী আহমেদ ও তাহমিনা শহীদ।
আসরে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন— কাজী আতীক, নিনি ওয়াহেদ, মেহফুজ আহমেদ, রাহাত কাজী শিউলি, আখতার আহমেদ রাশা, নাহার, রুনা রায়, শহীদ উদ্দিন, আহসান সাবির, সেন গোমেজ, মাসুমা রহমান, রিনা আবেদীন, উর্বি সাবিনা, আমিরুল ইসলাম, সুতপা মণ্ডল, প্যাট্রিক রোজারিও, নাসির শিকদার প্রমুখ।
যথারীতি এবারের আসরেও পাঠের জন্য বই বিতরণ করা হয়।
সবাইকে আগামী আসরের আমন্ত্রণ জানিয়ে, অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়