মহিতোষ তালুকদার তাপস

৩২ বছর আগে যে পরিবারটি এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমায় আপন করে নিয়েছিলেন, সেই পরিবারের মানুষগুলোকে আমি ডাকতাম ইকবাল ভাই, মঞ্জুমাসী আর তাঁদের কন্যা সুনীতা। বছর দশেক আগেই মঞ্জুমাসী বিদায় নিয়েছিলেন কর্কট রোগে, আজ ভোরে চলে গেলেন শ্রদ্ধেয় ইকবাল ভাই।

এই পরিবার ছিল গান-বাজনার পরিবার। ওদের বন্ধুবান্ধবরা সবাই ছিল গানের মানুষজন। অসাম্প্রদায়িক পরিবার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের পরিবার। সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের পরিবার। বস্টনে প্রথম যে কজন মানুষকে আমি আপন বলে জেনেছিলাম, এরা ছিলেন আমার সেই পরিবারের মানুষ।আমি তখন ছাত্র। ৩টা কাজ করি আর সাথে পড়াশোনা। দিন আনি দিন খাই। সেই সময়ে ওরা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথম শীতে আমায় সুয়েটার কিনে দিয়েছিলেন। কারণে অকারণে আমায় উপহার দিতেন। আমি বুঝতে পারতাম, পাছে আমার কোনো কষ্ট হয়!

একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম অনেকদিন ইলিশ মাছ খাই না। ব্যাস, পরেরদিন খাবার টেবিলে ইলিশ মাছ। আমি এই দেশে প্রথম মঞ্চে উঠেছিলাম এই পরিবারের সাথে। প্রথম বাংলাদেশের জন্মকথা নিয়ে গানের অনুষ্ঠান করেছিলাম, সেখানেও এই পরিবার। একদিন বলেছিলাম, বীয়ার খাব। ব্যাস, ২৪টা হ্যানিক্যান কিনে এনে বলেছিলেন, এগুলো সব তোমার।

রাত ৩টা। প্রথম তুষারপাত দেখছি এই দেশে। বাংলাদেশকে প্রচন্ড মিস করছিলাম সেই মুহুর্তে। ইকবাল ভাইকে বললাম, একা একা খুব খারাপ লাগছে। ইকবাল মঞ্জুমাসী সেই ভোরে তুষারের মধ্যেই একঘণ্টা ড্রাইভ করে বাসায় চলে এসেছিলেন আমার আবেগের মূল্য দেয়ার জন্য। তারপর রাত ভোর করে দিয়ে আমরা শুধু গান গেয়েছিলাম সেই সকালে।ওদের প্রেম করে বিয়ে, অসম ধর্মের বিয়ে ছিল। এমন অসাম্প্রদায়িক মানুষ আজকাল দেখা যায় না। ইকবাল ভাই এম আই টি গ্র‍্যাজুয়েট ছিলেন। বাংলাদেশের বিখ্যাত ফটোগ্রাফার আনোয়ার হোসেনের ছোট ভাই ছিলেন।

মানুষ চলে যায়, মানুষের ভালো কাজগুলো থেকে যায়। মানুষের সুন্দর স্মৃতিগুলো থেকে যায়।

প্রিয় ইকবাল ভাই, আপনি ভালো থাকুন আনন্দলোকে। আপনি ভালো থাকুন সুরালোকে। আপনি ভালো থাকুন অনন্তলোকে। পরম শ্রদ্ধা জানাই।

"তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে

আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে"।