বিজয় দিবসে কিংবা স্বাধীনতা দিবসে নির্জনে একলা একা আমি প্রিয় কিছু দেশের গান শুনি আর প্লাবিত হই আনন্দ-বেদনার সম্মিলিত অশ্রুর বন্যায়। সেই গানগুলোর একটি--সব ক'টা জানালা খুলে দাও না। এই গানটা আমাকে একই সঙ্গে প্রাপ্তির আনন্দ আর স্বজন হারানোর বেদনায় সিক্ত করে। বাংলাদেশ থেকে সাড়ে বারো হাজার দূরের দেশে বসে ২০২২ সালের বিজয় দিবসেও গানটা শুনতে শুনতে একই রকম অনুভূতিতে আক্রান্ত হলাম। এই গানটিকে কেন্দ্র করে একটা স্মৃতিগদ্য লিখেছিলাম। গানটি--এমন খুশির দিনে কাঁদতে নেই বললেও আমি কাঁদছি! কেনো কাঁদছি জানি না। কিন্তু লেখাটা পড়তে পড়তে ফের আমি কাঁদছিই তো!......
'এমন খুশির দিনে কাদঁতে নেই'......
লুৎফর রহমান রিটন
আমি চিরকাল গানে পাওয়া মানুষ। ক্লান্তিহীন গান শুনি বলেই ডিপ্রেশন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে পারে না। গেলো নয় মাসের করোনাবন্দী জীবন এখনো আমার কাছে তাই একঘেয়ে নয়। যদিও সব গান আনন্দের নয়। কোনো কোনো গান কান্নারও অধিক কিছু। গানই আমাকে সজিব সচল আর প্রাণবন্ত রেখেছে।
কোনো কোনো গান শোকার্তই করে না শুধু, ভাসিয়ে নেয় অশ্রুর প্লাবনেও। জাগতিক পরিবেশ পরিস্থিতি আর শব্দময় পৃথিবীর সমস্ত শব্দকে স্তব্ধ বা মিউট করে দেয় কোনো কোনো গান। তখন পৃথিবীকে দখল করে রাখে সেই গানের কথা শিল্পীর কণ্ঠনিঃসৃত সুর আর যন্ত্রানুষঙ্গের তরঙ্গপ্রবাহ। তার বাইরে আর কোনো শব্দই তখন প্রবেশ করে না কর্ণকুহরে। 'সব ক'টা জানালা' তেমন একটি গান।
আশির দশকের শুরুতে, ১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে বিটিভির একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যে নির্মিত হয়েছিলো গানটি। লিখেছিলেন নজরুল ইসলাম বাবু। সুর সংযোজন করেছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। এবং গেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমিন।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ২নম্বর সেক্টরের একজন সাহসী কিশোর যোদ্ধা ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। বুলবুলের বয়েস তখন চৌদ্দ বা পনেরো। ঢাকার আজিমপুরে ওয়েস্টটেন্ট হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন।
আরো কয়েকজন সহযোদ্ধার সঙ্গে ধরাও পড়েছিলেন তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনির হাতে। নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন সকলেই। সহযোদ্ধারা কেউ বেঁচে না ফিরলেও তিনি ফিরেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একাধিকবার ধরা পড়েছেন তিনি পাকিস্তানি বাহিনি ও রাজাকারদের হাতে। প্রতিবারই পাকিস্তানিসেনাদের এবং রাজাকারদের নিষ্ঠুর বর্বরতায় রক্তাক্ত হয়েছেন। কিন্তু প্রতিবারই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন কিশোর বয়েসী অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল।
পাকিস্তানি হানাদারদের টর্চার সেল থেকে বারবার তাঁর সেই ফিরে আসাটা আমার কাছে অলৌকিক ঘটনা মনে হয়েছে। মনে হয়েছে বুলবুলের ফিরে আসবার পেছনে ছিলো প্রকৃতির বা সৃষ্টিকর্তার বা ইতিহাসের কোনো আকাঙ্খা বা ইচ্ছা বা পরিকল্পনা। এবং ইতিহাসের দায় পুরনের জন্যেই বারবার তিনি ফিরে এসেছেন জল্লাদের দরবার থেকে।
আমার মনে হয়েছে ইতিহাসের কাছে তাঁর প্রধান দায় ছিলো দু'টি--
এক-- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রমে তাঁর সাক্ষী হওয়া। (একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৪তম সাক্ষী ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।)
দুই--আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনকে কিছু কালজয়ী গান উপহার দেয়া। যার ভেতরে থাকবে কিছু দেশাত্ববোধক গানও। ('সব ক'টা জানালা খুলে দাও না'সহ অন্তত তিরিশ-চল্লিশটি দেশাত্ববোধক গানের তিনি সুরস্রষ্টা।)
বাঙালির মতো একটি বিস্মরণপ্রিয় জাতিকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার দিনগুলোয় ফিরিয়ে নিতে বুলবুলের সুর করা অবিস্মরণীয় গানগুলো মহৌষধের কাজ করে। তাঁর গান বারবার আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় একাত্তরের সামনে। মুক্তিযুদ্ধের সামনে। তিরিশ লক্ষ শহিদের সামনে। শহিদ পরিবারের সামনে। শহিদ জননীর সামনে। এবং শেষমেশ--ইতিহাসের সামনে। যা আমরা প্রায়শঃ ভুলে যেতে ভালোবাসি।
০২
নজরুল ইসলাম বাবুর কথায় আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সুরে সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গীত 'সব ক'টা জানালা খুলে দাও না' শীর্ষক কালজয়ী গানটির কয়েকটি চরণ টানা আট-নয় বছর বিটিভির খবরের আগে বাজানো হয়েছে সিগনেচার টিউন হিশেবে। এতে করে গীতিকার এবং শিল্পী মাস শেষে মোটামুটি সম্মানজনক একটা এমাউন্টের চেক পেতেন। সাবিনা ইয়াসমিনের কথা জানি না কিন্তু বাবুর তাতে ভীষণ উপকারই হয়েছিলো। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত ছিলেন বাবু। গানটি বিটিভির সংবাদের সিগনেচার টিউন হিশেবে প্রতিদিন একাধিকবার প্রচারের ফলে নতুন একটা অর্থনৈতিক ছন্দ এসেছিলো বাবুর পরিবারে। কিন্তু বিটিভির একাউন্টস সেকশনের কতিপয় ঈর্ষাকাতর কর্মকর্তা কর্মচারীর চোখে ব্যাপারটা 'সব ট্যাকা তো গীতিকার লইয়া গ্যালো' টাইপের অপরাধ বলে গণ্য হলো। সেই সময় এক দুপুরে দৈনিক বাংলার প্রবেশ পথের পত্রিকা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে নজরুল ইসলাম বাবুই আমাকে বলেছিলেন তাঁর ক্ষোভের কথাটি। বলেছিলেন--''আমি প্রতিমাসে মোটামুটি ভালো অংকের একটা এমাউন্ট পাচ্ছি দেখে বিটিভির একাউন্টসের কয়েকজন ঈর্ষাকাতর কর্মকর্তার আঁতে খুব ঘাঁ লেগেছিলো রিটন ভাই। তারা জিএম-ডিজিসহ প্রশাসনের বড় কর্তাদের কানে তুললেন ব্যাপারটা। বিটিভির প্রশাসনের বড় কর্তারাও ছিলেন একই রকম ঈর্ষাকাতর। খবরের সিগনেচার টিউন হিশেবে গানটা ততোদিনে প্রতিষ্টিত হয়ে গেছে। সুতরাং গানটাকে তারা বাদও দিতে পারছিলেন না। কিন্তু গীতিকারকে তো বঞ্চিত করতেই হবে। শেষে আমাকে কোনো রকম সম্মানী বা পারিশ্রমিক যাতে না দিতে হয় সেই বুদ্ধি তারা বের করলেন। গানের সুরটা তারা রাখলেন কিন্তু কথা প্রচার করলেন না। অর্থাৎ গানটাকে শুধুই ইন্সট্রুমেন্টাল করে ফেলা হলো। টানা অনেক বছর বাণীসহ প্রচার হলেও এক পর্যায়ে আমাকে বঞ্চিত করতেই শুধু ইন্সট্রুমেন্টাল সিগনেচার টিউন হয়ে গেলো সব ক'টা জানালা।''
আহারে ঈর্ষা। একাত্তরের রণাঙ্গণে অস্ত্র হাতে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বাবুর শেষ জীবনটা কেটেছিলো কঠিন দারিদ্র্যে। অর্থকষ্টে জর্জরিত মানুষটা মারা গিয়েছিলেন চরম চারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতেই! অথচ বিটিভি কোনো দরিদ্র প্রতিষ্ঠান ছিলো না। বিটিভির লক্ষ লক্ষ টাকা লুট করে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছেন লোভী এবং অসাধু অনেক প্রযোজক-কর্মকর্তা।
ফিরে আসি গানের প্রসঙ্গে। --
০৩
নজরুল ইসলাম বাবু, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এবং সাবিনা ইয়াসমিন ত্রয়ীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মিলিত কীর্তি--'সব ক'টা জানালা খুলে দাও না'।
১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ বিটিভিতে প্রথম যখন গানটি শুনি, তখনই এক বিস্ময়কর শিহরণ অনুভব করেছি দেহ-মনে। স্টুডিওতে গানটির চিত্রায়নও ছিলো চমৎকার।
গানের শুরুতেই যন্ত্রানুষঙ্গের দুর্দান্ত প্রয়োগে বুলবুল তাঁর অপরূপ দক্ষতায় গভীর রাতের কান্নাকাতর নির্জনতাকে মূর্ত করে তুলেছেন। তারপর নির্মাণ করেছেন প্রিয়জন হারানোর শোকাচ্ছন্ন পরিবেশে সহসা জানলা গলে আসা বেদনাক্রান্ত বাতাসের তুমুল আলোড়নের চিত্রকল্প।
এরপর শহিদ পরিবারের সদস্যদের অপেক্ষারঅশ্রুসিক্ত বুক ভাঙা হাহাকার এবং প্রিয়জনের ফিরে আসার স্বপ্নকাতর আকাঙ্খার দীর্ঘশ্বাসকে ধারণ করেছেন পরম মমতায়।
অতঃপর নিঃসীম অন্ধকারে অনন্ত প্রতীক্ষার ঘাতক প্রহরকে চিত্রিত করতে কথা এবং সুরের সিম্ফনিতে আনন্দ-বেদনার যে উপাখ্যান তিনি নির্মাণ করেছেন তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য।
সমাপ্তিতে--নিকটজনের কাছে শহিদ-আত্মার নিঃশব্দ আগমনের মাহেন্দ্রক্ষণে যেনো বা আতরের গন্ধ আর গোলাপের সৌরভ মাখা ঘ্রাণ এসে হামলে পড়ে শ্রোতার করোটির ভেতরে।
গানটি এমনিতেই সারা বছর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংশ্লিষ্ট 'পাঠ-শ্রুতি আর দর্শন' শেষে মন খারাপ হলে শুনি আমি। বিশেষ করে ডিসেম্বরের বিজয় দিবসের ক্ষণে বারবার শুনি। গত দু'দিন ধরে অজস্রবার শোনা হলো। প্রতিবারই গানটা আমায় অশ্রুসিক্ত করে। এই গানের শক্তি অসীম।
এবারের বিজয় দিবসে আমার অনন্ত শ্রদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের প্রতি। নজরুল ইসলাম বাবুর প্রতি। সাবিনা ইয়াসমিনের প্রতি। এবং--তিরিশ লক্ষ শহিদের প্রতি। যাঁরা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ।
ও বাংলাদেশ, ও বাঙালি, 'চোখ থেকে মুছে ফেলো অশ্রুটুকু, এমন খুশির দিনে কাদঁতে নেই'......
অটোয়া ১৫ ডিসেম্বর ২০২০