মোহাম্মদ আলী খান বাবুল

ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার কলাকোপায় খেলারাম দাতার ঐতিহাসিক পুকুর।  স্থাপনাটি দূর্গ, মন্দির, বিগ্রহ মন্দির, আখড়া বা আবাসিক ভবন যেটিই হোক না কেন, খেলারাম যে ডাকাতি করতেন এবং প্রাপ্ত সম্পদ দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দাতা হিসেবে সম্মানিত ছিলেন, এই স্বীকৃতি প্রায় সব তথ্যেই মেলে। তবে এর চাইতে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। এবার আসি স্থানীয়দের গল্পে। তাদের মতে ঘটনাটি প্রায় ২০০ বছর আগেকার। খেলারাম দাতার ভবনটির কাছেই রয়েছে একটি পুকুর। এই পুকুরে সাধারণ মানুষ এসে কিছু চাইলে তা নাকি পূরণ হতো। স্নান করতে গিয়ে ডুব দিলেই হাতে উঠে আসতো মূল্যবান কিছু। তা হতে পারে স্বর্ণ, রৌপ্য বা হীরে-জহরত। কিন্তু দিনে যতবারই ডুব দিক না কেন, একবারের বেশি কেউ কিছু পেত না। যে কারণে পুকুরটিতে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হতো।খেলারাম যত দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দারই হয়ে থাকুন না কেন, তিনি ছিলের ভীষণ রকমের মাতৃভক্ত। মা যা কিছু চাইতেন, বা যা কিছু আদেশ করতেন, অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন খেলারাম। তার মা প্রায়ই চাইতেন সবার সঙ্গে পুকুরে গিয়ে স্নান করতে। কিন্তু মায়ের এই একটি মাত্র বিষয়ে খেলারামের ঘোর আপত্তি ছিল। খেলারাম চাইতেন না সবার মাঝখানে তার মা পুকুরে নামুন আর ভেজা কাপড়ে বাসায় ফিরুন। এজন্য উপরের একটি ঘরে একটি চৌবাচ্চা বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই পুকুর থেকেই লোক দিয়ে কলস বা হাঁড়িতে করে প্রতিদিন নতুন করে পানি আনা হতো মায়ের স্নানের জন্য। মা এতে ভেসে ভেসে স্নান করতে পারতেন। একদিন নাকি মা বলেছিলেন একটু বেশি করে দুধ আর পাকা কলা নিয়ে আসার জন্য। খেলারাম দুধ এনে স্নানঘরের চৌবাচ্চা ভরে ফেলেছিলেন।

পাশে রেখে দিয়েছিলেন এক কাঁদি পাকা কলা, যেন মা দুধে ভেসে ভেসে স্নান করতে করতে কলা খেতে পারেন। মা একদিন টের পেলেন খেলারাম এলাকায় নতুন আসা এক ধনী লোকের বাসায় ডাকাতি করার পরিকল্পনা করেছেন। মা চাইলেন না প্রতিবেশীর বাড়িতে ছেলে ডাকাতি করুক। নিষেধ করে দিলেন তিনি এই ব্যাপারে। কিন্তু খেলারামের তর সইল না। ডাকাতি করতে গেলেন এক রাতে। বাড়ির লোকজন টের পেয়ে চেঁচামেচি আরম্ভ করায় একজনকে আঘাত করেন খেলারাম। সঙ্গে সঙ্গে ওই লোক মারা যান। সকালে ঘুম থেকে উঠে খবর পেয়ে যান মা। খেলারামকে ডেকে ভীষণ বকাঝকা করেন। খেলারাম কথা দেন সমস্ত ডাকাতি করা মাল ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন।কিন্তু যে লোকের প্রাণ গেল, তার পরিবারের কী হবে? খেলারাম বললেন তাদের অনেক ধন সম্পদ দিয়ে দেবেন। কিন্তু মা জানালেন, ধন সম্পদ দিলেও লোকটির প্রাণ তো ফেরানো যাবে না। অবাধ্য ছেলের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, পুকুরে যাবেন বলে। এই যে পুকুরে নেমে ডুব দিলেন, আর উঠে আসলেন না। খেলারাম খবর পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিলেন পুকুরে। সমস্ত লোক লাগিয়ে দিলেন। ডুব দিয়ে, জাল ফেলেও মাকে পাওয়া গেল না। শত চেষ্টা স্বত্ত্বেও বিফল হয়ে খেলারাম যখন বাড়ি ফিরছেন, তাকিয়ে দেখলেন বাড়িটি ধীরে ধীরে দেবে যাচ্ছে মাটির নিচে। উল্টোমুখে ঘুরে দৌড় দিলেন খেলারাম। আর তাকে কোনোদিন কেউ ফিরতে দেখেনি। কেউ কেউ বিশ্বাস করে খেলারাম মায়ের মতোই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে ডুবে গেছেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করে বাড়ির ভেতরের নিচের কোনো তলায় চাপা পড়ে গেছেন তিনি। এরপর বেশ কিছুদিন খালি পড়ে ছিল বাড়িটি। তারপর স্থানীয় লোকজন এসে লুটপাট করে বাড়ি খালি করে ফেলে। এই গল্পটি স্থানীয়দের মুখে মুখেই শোনা যায়।