লুইজা নন্দিনী
আমরা মানুষ প্রকৃতির একটি অমূল্য সম্পদ। প্রকৃতিতে গাছ পালা, লতা পাতা, খাল বিল, পাহাড় পর্বত যা কিছুই দেখি না কেন সবকিছুই প্রকৃতির সম্পদ। আর এই সম্পদ গুলো ব্যবহার হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ জীব মানুষের জন্য। কেননা মানুষ এমন একটি প্রাণী যার মধ্যে রয়েছে বিবেক, বুদ্ধি, জ্ঞান, দুঃখ, কষ্ট বোঝার উপলব্ধি, ভালো মন্দকে চেনার ক্ষমতা। সব কিছুই রয়েছে এই মানুষের মধ্যে। মানুষের মনটা একটা বিচিত্র ধরনের অনুভূতি।এই মনের মধ্যে কত ধরনের খেলা চলে, কত রং বেরঙের ভাবনা ভাবে, সেভাবে মানুষটা বুঝতে পারে না। সত্যিকার অর্থে সে কি চায় আর কি পায় না এই দ্বন্দ্বের কারণে তার মধ্যে চলে একটা যুদ্ধ । এই যুদ্ধে জয়ী হতে না পারলে সে দিনে দিনে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। যেটা কিনা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর হয় কম।
শারীরিক অসুস্থতা যেহেতু দেখা যায় ওষুধ খেয়ে তাকে নিবারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। কিন্তু মনের মধ্যে যে অসুস্থতা তৈরি হয় তা অনেক সময় সাধারণ মানুষ দৃষ্টিগোচর করতে পারেনা। তোর আচার-আচরণ বিধি চলাফেরা কোনটাতেই বুঝতে পারে না যে সে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। তাই মানসিক বিষয়কে যদি বুঝতে হয় তাহলে একটা মানুষকে নিয়ে অনেক গবেষণা করতে হয়। তার অনেক ইতিহাস ঘাটতে হয়। অনেক কথা বলতে হয়।সময় দিতে হয়। যে কারণে একটা মানুষের মানসিক অবস্থা কি, সে কি অবস্থায় চলছে তা অনেক সময় সেই মানুষটার ভেতরে পৌঁছাতে পারেনা,ততক্ষণ পর্যন্ত যত অভিজ্ঞ মানুষই হোক না কেন? তার মনের অবস্থা পারিপার্শ্বিকতা এবং সে কি বলতে চায় তার কোনটার কাছেই সে যেতে পারে না। তাই আমরা সবার আগে যে কাজটি করব সেটা হল একজন মানুষের মনের অবস্থা বোঝা। জন্ম থেকেই একটা শিশু একটা মানসিকতা নিয়ে বড় হতে থাকে।
যদিও শিশুটি কথা বলতে পারেনা একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। আচরণ দিয়ে অভিব্যক্তি প্রকাশ করে শুধুমাত্র। যেহেতু মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করে, মায়ের সঙ্গে নাড়ির সম্পর্ক আর এ কারণেই মা তার যেকোনো আকার ইঙ্গিত সহজে বাবার চেয়ে দ্রুত বুঝতে পারেন। এ কারণেই তো মাকে বলা হয় একজন আদর্শ ব্যক্তি। তাই তো এম এ পাস মায়ের কোন প্রয়োজন নেই, দরকার জ্ঞান বুদ্ধিওয়ালা সৃজনশীল মা। কেননা নেপোলিয়ন বলেছিলেন- "আমাকে একটি স্বশিক্ষায় শিক্ষিত মা দাও আমি জাতি দেবো"। তাহলে বুঝতেই পারছি একজন নারী, জাতির কত বড় ভূমিকা রেখেছে। আমরা নারীরা যদি সঠিকভাবে নারী জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারি, গঠন করতে পারি তাহলে অবশ্যই পৃথিবী, সমাজ সব পাল্টে যায়। সে কারণেই নারীকে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে সবদিক থেকে সবার আগে।
সেক্ষেত্রে প্রতিটা নারীকে সুন্দর মন মানসিকতায় এবং প্রগতশীল চেতনায়, সৃজনশীল ভাবনায় মানুষ করা প্রত্যেকটা পরিবারের একান্ত কর্তব্য। যদিও আমরা দেখছি বর্তমানে নারীরা অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। হয়তো লেখাপড়ার দিক থেকে এগিয়ে এসেছে কিন্তু মন মানসিকতা এবং পারিপার্শ্বিকতা তাকে অতটা ছুঁয়ে যায়নি। এতে করে যে বিশেষটা হচ্ছে নারী নিজেকে মূল্যায়ন না করে পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিযোগী করে নিজেকে তৈরি করছে। এখানে পুরুষের সাথে প্রতিযোগিতা বড় কথা নয় সবকিছু সমন্বয় করে নিজের যোগ্যতা, মেধা, মরণশীলতাকে সঠিক জায়গায় পরিমাপ করাটাই কিন্তু মূল কাজ। সে ক্ষেত্রে নারীকে তার সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা মরণশীলতাকে কাজে লাগিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নিজের অবস্থানকে জানান দিয়ে যদি ধৈর্য্য সহকারে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারে তাহলে নারী কয়েক ধাপ এগিয়ে সম্মানিত হয়। নারী থেকে যেহেতু নতুন জীবের জন্ম হয় সে ক্ষেত্রে নারী সঠিক নেতৃত্ব,ভালোবাসা,স্নেহ, প্রেম এবং যোগ্য সম্মান পেলে একটি পরিবার, সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র, এমনকি পৃথিবীটা স্বর্গ তৈরি হবে।
সে ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের চারপাশে বর্তমানে যে হারে মানুষের মানসিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে এর পেছনে কয়টা কারণ অনুসন্ধান করতে পেরেছি, তা আমরা জানিনা। তবে আমরা বেশিরভাগ মানুষ বর্তমানে চিল কান নিয়ে গেছে, চিলের পিছে দৌড়াচ্ছি কানে হাত দিচ্ছি না। এই যে নিজেকে বিশ্লেষণ না করা এটা ভুল, নিজের অক্ষমতা, নিজের প্রাপ্তি সম্বন্ধে সঠিকভাবে না জেনে অন্যের উপর দায় চাপিয়ে দেওয়া, অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা, সময় নষ্ট করা এটা যে মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায়, এটা বুঝতেই চাচ্ছি না।
এক্ষেত্রে সবার আগে পরিবারের ভূমিকাই প্রথম। কেননা পরিবারের যে কজন সদস্য বাস করেন তাদের মধ্যে যদি খোলামেলা আলোচনা, একে অপরকে চেনা হয় এই প্রভাবগুলো আস্তে আস্তে প্রতিবেশী, পাড়া, মহল্লায় এমনকি কর্মক্ষেত্রে প্রকাশ পায়।যেমন যদি বলি একটা শিক্ষক ক্লাসের পঞ্চাশ জন বাচ্চাকে পড়ায়। সে প্রত্যেকটা ছাত্রের অবস্থা দেখে পঞ্চাশটা পরিবারের চালচিত্র দেখতে পায়। তাকে পঞ্চাশটা পরিবারে যেতে হয় না। তাই পরিবারকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। পরিবারের সদস্যরা যদি একে অপরের প্রতি ধৈর্য্য সহ্য, সহনশীলতা নিয়ে পাশাপাশি দাঁড়ায় এবং খোলামেলা সত্যের প্রকাশ ঘটায়, বিশুদ্ধতার চর্চা করে তাহলে মানসিক বিকাশ লাভ করে, তেমন সৃজনশীল বিকাশ ঘটে। সমাজের প্রত্যেকটি পরিবারে একটা সুস্থ ধারার প্রবাহ চলতে থাকে। এতে করে প্রত্যেকটা মানুষের মানসিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়। মানসিক তৃপ্তি আসে এবং অবসাদগ্রস্ত থেকে মুক্তি পায়। তাই বারবার উচ্চারণ করছি আসুন আমরা পরিবারকে সঠিকভাবে, সঠিক নেতৃত্বে সদস্যদের গড়ে তুলি। পরিবারের সদস্যরা যদি সুস্থ চিন্তায়, সুস্থ মানসিকতায় বড় হয় তাহলে তারাও সর্বক্ষেত্রেই তাদের এই চর্চাটা অব্যাহত রাখবে। নন্দিনী
নন্দিনী লুইজা লেখক, কলামিস্ট ও প্রকাশক বর্ণপ্রকাশ লিমিটেড