ছোটবেলায় যখন পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রান্তি সময় আসত কেমন জানি একটা অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হতো।  সারাদিন কড়া রৌদ্র বাহিরে বের হওয়া যেমন কষ্ট ঘরে টেকাও দায়। তখন তো আর ঘরে ঘরে ফ্যান অথবা এ সি ছিল না তাল পাখাই ছিল একমাত্র ভরসা। হঠাৎ করে বিকালে ঠান্ডা বাতাস সাথে সাথে এমন ঝড় শুরু হয় ধুলো উড়িয়ে গাছের পাতা ঝড়ে পড়ে,ঝপটা দিয়ে বৃষ্টি। অন্যরকম পরিবেশ সৃষ্টি হতো। ওই সময় আম গাছে ছোট ছোট কাঁচা আম। মাঝখানে ঝড়ো হাওয়া, এই ঝড়ের মধ্যে আম কুঁড়ানো। সেই আমগুলো যত্ন সহকারে আচার,চাটনি  বানানোর সেই প্রস্তুতি। কাঁচা আম কাসুন্দি, শুকনো মরিচ লবণ দিয়ে মাখিয়ে খাওয়া ,ইস্  জিহ্বায় পানি এসে যায়।আহা পাড়ার ছেলেমেয়ে একসঙ্গে দল বেঁধে বৈশাখী মেলায় যাওয়া, মেলায় গিয়ে মাটির পুতুল, টেপা পুতুল,মাটির ঘোড়া, টমটম গাড়ি, মাটির হাঁড়ি পাতিল, বাতাসা,চিনির কদম কিনে খাওয়া ভুলতে পারি না। সবাই সেজে গুজে আনন্দ করা বলে বোঝানো ভার। সেদিনগুলি এখনো হাতড়িয়ে বেড়াই।   খুব মনে পড়ে ফেলে আসা দিনের কথা। ছোটবেলায় নানা বাড়িতে বেশি যাওয়া হতো। সমবয়সী খালা মামা থাকার কারণে। শহরে বিশাল বাড়ি, পাকা উঠান,শান বাঁধা ঘাট, গোলা ভরা ধান চালে ভরপুর। একেবারেই শহরের মধ্যে গ্রাম্য আদল। আরও ছিল ঢেঁকি,ধান সিদ্ধ এর আয়োজন,মুড়ি,খই,চিড়া বানানোর উপকরণ- সবকিছু নানা বাড়িতে ছিল। তাই গ্রামের অভাব বুঝতে পারিনি।

আমাদের সব ধরনের বাঙালি আচার অনুষ্ঠান, নতুন বর্ষবরণ খই, মুড়ি, মোয়া, দেশীয় পিঠা পায়েস,নারিকল নাড়ুর সঙ্গে আত্মীয়তা। সেহেতু নানা ভাই বড় ব্যবসায়ী ছিলেন আর আমি ছিলাম একমাত্র নাতনি ফলে আদরের মাত্রা ভালোবাসা, আহ্লাদ, খুব বেশি মাত্রায় পেয়েছি। বিশেষ করে পহেলা বৈশাখে আসলে খুব রাজকীয়ভাবে হালখাতা করা হতো। আমার ছোট খালা  আর আমি বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হরেকরকম মিষ্টি, কত আপ্যায়ন পেয়েছি। যখন দেখতো আমার নানার নাতনি গিয়েছি আমাদেরকে একটা আলাদাভাবে দেখভাল করতো। এমনও হয়েছে নানা বাড়িতে পহেলা বৈশাখে হালখাতার আগের দিন বাবুর্চি নিয়ে এসে মন্ডা, মিঠাই ,পোলাও রান্না হচ্ছে। এগুলো দেখে দেখে আমাদের বড় হওয়া।   তাই পরবর্তী জীবনেও আমি এটাকে ধরে রেখেছি। যখন স্কুল, কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম পয়লা বৈশাখ এলেই নিজের হাতে তৈরি করা পোশাক পড়ে নতুন বছরকে বরণ করতাম। বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাওয়া । এ যেন একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। দল মত নির্বিশেষে সবাই যেন আমরা আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছি।বৈশাখের এই আনন্দটা ঈদের  আনন্দের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। কিন্তু এখন সবকিছুই কৃত্রিমতা। যদিও চেষ্টা করা হয় অনেক পরিবারের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই প্রচলনটা বাঙালিয়ানাটা ধরে রাখার তারপরও কেন জানি বর্তমানে আমরা আসলটা ফেলে নকল নিয়ে বেশি মাতামাতি করছি। এমনটা  আমরা চাইনা। আমরা চাই আমাদের প্রজন্মরা আমাদের এই বাঙালিয়ানাটা চর্চায় ধরে রাখুক।   যারা বিদেশে বাঙালিরা থাকে তাদের মধ্যে বাঙালিয়ানার  আকুতিটা দেখেছি। তারা বাংলাদেশের আদলে এই দিনগুলো উদযাপন করার জন্য কত আগে থেকেই প্রস্তুতির আয়োজন করে চলেছে। আসলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা আমরা বুঝি না। তাইতো যারা আমরা বাংলাদেশে বাস করি আমরা তাৎপর্য যেমন বুঝতে চাই না তেমন আমাদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, চুল ছেড়াছেড়ি, কথার ঘায়েল করা -কেমন জানি একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ।  

এখনো পহেলা বৈশাখ আসলে একেবারেই শিশুর মতো, সেই শৈশবের মতো আচরণ করি। এখনো পরিবারের  সবাইকে নিয়ে বের হই। রাস্তায় যাই আর যেখানে যাই সেই শৈশবের মতো টেপা পুতুল, রঙিন হাঁড়ি পাতিল, চড়কি, নাগরদোলায় চড়ি আনন্দে মেতে উঠি।   বর্ষ বরণে আমি গামছার শাড়ি পরে, লাল টিপ পড়ি, খোপায় তাজা ফুল গুজে নববর্ষ উদযাপন করি। পারিবারিকভাবে বাচ্চাদের কেউও দেশীয় পোশাক পরাই। নিজ হাতে তৈরি করি রাত জেগে। কি যে আনন্দ এই আনন্দের অনুভূতি কাকে বোঝাই। তাই কালির অক্ষরে একটুখানি না হয় ভালোবাসার অনুভূতির কথা বলে যাই।   বারবার আমি হারিয়ে যাই আমার সেই শৈশবে। আমার ফেলে আসা দিনগুলিতে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি আশেপাশে যারা আমার সঙ্গে বাস করে তাদের মধ্যে বাঙালিয়ানা আচার, ভালোবাসা থাক। মাটির সুধা গন্ধে পান্তা ভাতে কাঁচামরিচের সেই ঘ্রাণ,সেই মঙ্গল শোভাযাত্রা যেন ভুলে না যাই। বাংলা নববর্ষ মনে রাখার জন্য এবং এটা যেন একটা নতুন মাত্রা পায় সে কারণেই বড় মেয়েকে পহেলা বৈশাখেই বিয়ে দিয়েছি। যেন আধুনিকতার ছোঁয়াতে আলোক ঝলমল পৃথিবীতে পবিত্র পহেলা বৈশাখটা ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে করে পালন করবে বর্ষ বরণ বৈশাখী আর বিবাহ বার্ষিকী।  

 নন্দিনী লুইজা লেখক ও প্রকাশক বর্ণপ্রকাশ লিমিটেড