সাকিব আল হাসান! বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টার বয়। অথচ বরাবরই তিনি কেবল ক্রিকেটেই আটকে থাকতে নারাজ। অর্থ উপার্জনের যেকোনো মাধ্যমেই তিনি অনায়েসে হাজির হয়ে যান। আজ কাঁকড়ার ব্যবসা করছেন, কাল ব্যাংক করছেন, পরশু রেস্টুরেন্ট। শেয়ার বাজারে নামছেন, সোনার ব্যবসা করছেন, মোনার্ক মার্ট, ই-কমার্স করছেন। আর অলরাউন্ডার থেকে এমপি লক্ষ্যে এখন তিনি রাজনীতিতে ক্রিকেটার থেকে রাজনীতির মঞ্চে এসেছেন অনেকেই। শ্রীলঙ্কায় সনাৎ জয়সুরিয়া থেকে পাকিস্তানের ইমরান খান, নাইমুর রহমান দুর্জয় থেকে মাশরাফি বিন মর্তুজারা ক্রিকেটের পাশাপাশি হয়েছেন জনপ্রতিনিধিও। সেই তালিকায় নতুন সংযোজন সাকিব আল হাসান। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন টাইগার অধিনায়ক। নিজের জন্মস্থান মাগুরা-১ আসনে নির্বাচনে লড়বেন তিনি। আলোচিত ও সমালোচিত এই ক্রিকেট তারকা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে কোনো অন্যায় করেননি, কিন্তু তিনি ঠিক কতটা রাজনীতির যোগ্য তা নিয়েই আলোচনা এখন তুঙ্গে। এত দিন ক্রিকেট-চর্চার পাশাপাশি ভেতরে-ভেতরে তিনি কতটা ‘রাজনীতি’ করেছেন, তা অবশ্য কেউ জানে না। অতিসম্প্রতি তাঁর একটি পুরোনো পোস্ট ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছিলেন, কখনো রাজনীতি করবেন না। সেটা অবশ্য ২০১৩ সালের কথা। এ নিয়ে বিতর্ক করা অনর্থক। আমাদের দেশের বিশিষ্টজনেরা হরহামেশা এ রকম কথা বলে আবার ভুলে যান। তবে যেকোনো কাজের একটি প্রক্রিয়া থাকে। যেমন, আগে জমি তৈরি করতে হয়। এরপর বীজ বপন, সার-ওষুধ প্রয়োগ। চারা গাছের বড় হওয়া, এরপর গাছটিতে ফল ধরে এবং পাকলে সেই ফল খাওয়া হয়। রাজনীতিতেও প্রক্রিয়াগুলোও এমন হওয়াই কাম্য। কিন্তু সাকিব আল হাসান তা করলেন না। তিনি সরাসরি তৈরি থাকা ফলদ গাছ থেকে ফলটি পেড়ে খেতে চান। অথবা তিনি আশা করছেন, ফলটি তাঁর সামনে এসে হাজির হবে, তিনি কেবল কাঁটাচামচ দিয়ে মুখে পুরবেন।
সাকিব তারকা ক্রিকেটার হলেও রাজনীতিতে তার অভিজ্ঞতা নেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তার জন্মস্থান মাগুরার আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সাকিবকে তারা কখনো স্থানীয় রাজনীতিতে দেখেননি; সাধারণ মানুষের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ নেই। মাগুরা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান ৩৪ বছর ধরে রাজনীতি করছেন। তিনি বলেন, ‘সাকিব মনোনয়ন ফরম কিনছেন এটা আমি বা উপজেলা আওয়ামী লীগের কেউ জানতেন না। গণমাধ্যম মারফত জেনেছি। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সাকিব বা তার পরিবারের কাউকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করতে দেখিনি।’ এমনিতেই ক্রিকেট, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা; এই তিনটাতে তার শিডিউল মেলানো প্রায় অসম্ভব। এত ব্যস্ততার মাঝে জনগণের সেবা করার শিডিউল কীভাবে মেলাবেন তা চিন্তার বিষয়। তার উপর তিনি এখন প্রায় প্রবাসী। সাকিবের পরিবার প্রায় স্থায়ীভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে। স্ত্রী, সন্তানরা সেখানেই থাকেন। ফলে তাঁকে নিয়ম করে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটতে হয়। সেখানে একটু হলেও থাকতে হয়। নিজেই বলেছেন, আমেরিকাতে যাতায়াতেই তার বড় একটা সময় নিয়ে নেয়। এখন কথা হচ্ছে, মানুষের বছরে দিন তো সীমিত; মাত্র ৩৬৫টি দিন। এই সামান্য ক’টা দিন দিয়ে কী সাকিবের পোষাবে? গত ৬ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজারে আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের ইফতারের জন্য বিশ হাজার টাকা অনুদান দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা বলেছিলেন, 'সাকিবের টাকায় থু মারি, থু। তিনি ইফতারির জন্য ২০ হাজার টাকা দেবে, ৫ পয়সা কইরাও তো কেউ পাইব না। অর যদি লাগে আমরা ২০ হাজার টাকা অরো দিমু, অয় ৪০ হাজার টাকা দিয়া ইফতার করুক।' এই যদি হয় তার মানুষের সেবার নমুনা তাহলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তিনি কতটা সফল হবেন তা কিন্তু ভাবার বিষয়।
সাকিব আল হাসানের সংসদ সদস্য হতে চাওয়ার বিষয়টি আরেকটু বিশ্লেষণ করা যাক। এখন তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার গোধূলিলগ্নে। তবু জনপ্রিয়তা যথেষ্ট রয়েছে তাঁর। জনপ্রিয়তা থাকতে থাকতে একটা পেশা থেকে আরেকটি পেশায় যাওয়া, সাকিবের মনে হয়তো এমন চিন্তা কাজ করেছে। তিনি খ্যাতি ও ক্ষমতার মধ্যেই থাকতে চেয়েছেন। বেশির ভাগ মানুষই তো ক্ষমতার কাঙাল! সাকিবও তাই। তাই তিনি মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন একটি নয়, তিনটি। যেকোনো একটি তিনি পাবেন বলেই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। পাশাপাশি এটাও বলতে হবে, সাকিব আল হাসান অন্য কোনো দলে যোগও দেননি। ক্ষমতাসীন দলে যোগ দিয়েছেন, যেখানে এবার দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হলেই তাঁর সংসদ সদস্য হওয়া অনেকটা নিশ্চিত। বিভিন্ন সময়ে টুর্নামেন্ট চলাকালে দলের সঙ্গ ত্যাগ করে শোরুম উদ্বোধনের জন্য দেশে আসা, চলতি বছরেই তার দুবাইয়ে পুলিশ হত্যা মামলার আসামির শোরুম উদ্বোধন ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। গত তিন বছরে বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার কারসাজিতে সন্দেহজনক লেনদেনকারীদের তালিকায় বেশ কয়েকবার তার নাম এসেছে।
সাকিব আল হাসান গত বছর বেটউইনার নিউজ নামে একটি অনলাইন বেটিং সাইটের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনী পণ্যদূত হওয়ার চুক্তি করেছিলেন। এ ঘটনার পর সিআইডি অনুসন্ধানে উঠে আসে, বেটিং সাইটটির মাধ্যমে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারও হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়। এ বিতর্কের পর সাকিব আল হাসানকে নিজের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দূত সাকিব আল হাসান। এর আগে ২০১৯ সালে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের প্রস্তাব গোপন করায় তাকে দুই বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। যদিও আইসিসির এ শাস্তি তাকে অর্থনৈতিক অপরাধের প্রলোভন থেকে দূরে সরাতে পারেনি।
হতে পারে, নিজের এই ক্রমাগত অর্থনৈতিক অপরাধ ঢাকতেই তিনি রাজনৈতিক জীবনে পা দিয়েছেন। মাঠের ক্রিকেটে বা ড্রেসিংরুমে সাকিব আল হাসানের প্রভাব বেশ আগে থেকেই সবার কাছে পরিচিত। দেশের তরুণ ক্রিকেটারদের মধ্যে সাকিবের প্রভাব নিয়ে আলোচনা বহুবারই ঘুরেফিরে এসেছে। খেলার মাঠে আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে স্ট্যাম্পে লাথি মারা বা নিদহাস ট্রফিতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে মাঠ থেকে উঠে আসার নির্দেশ দিয়ে বারবার নায়ক হয়েছেন সাকিব। আবার সাংবাদিকদের অশালীন অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে বা কখনো ভক্তদের প্রতি আগ্রাসী হয়ে নেতিবাচক খবরেও শিরোনাম হয়েছেন তিনি। এবার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সাকিব আল হাসান ঠিক কী কারণে শিরোনাম হয়ে ওঠেন, সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে।