বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সময় অন্যতম জনপ্রিয় রেডিও ম্যাগাজিন ছিলো ‘উত্তরন’। উপস্থাপন করতেন বাংলা ভাষার একজন অসাধারন কন্ঠ জনাব শফি কামাল। তখন ঢাকার শাহবাগে বাংলাদেশ বেতারের প্রায়ই সবকিছুই ছিলো এবং একমাত্র বানিজ্যিক কার্যক্রম ও কৃষি বিষয়ক অন্য জায়গায় ছিলো। ঊত্তরন রেডিও ম্যাগাজিনের আয়োজনে অন্যতম ছিলেন আলফাজ তরফদার ও আবু নওশের। লাইভ সেই অনুস্ঠানের টেকনিক্যাল দায়িত্ব পালন করতেন রইস উদ্দিন । সহকারি আন্চলিক পরিচালক ও বিশিস্ট কবি মুস্তফা আনোয়ার আমাকে চিঠি দিয়ে আনুস্ঠানিক আমন্ত্রন জানালেন বিশেষ সাক্ষাতকার দেয়ার জন্য। বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব রেডিও ক্লাব্স এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিশেষ সাক্ষাতকারের জন্য। 

খুব সম্ভবতঃ ১৯৭৯ সালে রেডিও বাংলাদেশ ( তখনো বাংলাদেশ বেতার নাম হয়নি) এ আমার প্রথম বিশেষ সাক্ষাতকার । শফি কামাল ভাইয়ের মাইক্রোফোনে মুখোমুখি- কি অসাধারন অনুভুতি। আমি মোটামুটি যেন পোলাপাইন ছিলাম। প্রথম সেই সাক্ষতকার জীবনের ইতিহাসে স্মরনীয় হয়ে আছে। জীবনে প্রথম সম্মানী পেলাম ১০০ টাকার চেক। বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েলাইনে দাঁড়িয়ে চেক ক্যাশ করলাম। তারপর একদিন সন্ধ্যায় শাহবাগে এসে উত্তরন পরিবারের সবাইকে নিয়ে সেই টাকা দিয়ে  আবুল ভাইয়ের দোকানের চা সিংগাড়া খাওয়ার যে আনন্দ । তখন উত্তরন পরিবার যে কতো সম্বৃদ্ধ ছিলো। শফি কামাল ছিলেন বিখ্যাত উপস্থাপক। স্ক্রিপ্ট লিখতেন আনিস আহমেদ ও মাহমুদুল হাসান কামাল। কাজী আরিফ, প্রজ্ঞা লাবনী, শরফুল ইসলাম মুকুল, সৈকত রুশদী,  মাহবুবা চৌধুরী, শামিমা নাসরিন, মনোয়ারা বেগম থেকে অনেকে। এতোদিন পর সবার নাম কিন্তু মনে পড়ছেনা। 

কবি মুস্তফা আনোয়ার ভাই ও তাঁর স্ত্রী এবং খ্যাতনামা অভিনেত্রী নাজমা আনোয়ার আমাকে অনেক স্নেহ করতেন। তখন রেডিও বাংলাদেশের মহাপরিচালক ম. ন. মুস্তফা আমার ঘনিস্ঠ আত্মীয় হলেও কেন জানি ঘনিস্ঠতা ছিলোনা। বহির্বিশ্বকার্যক্রমের পরিচালক মোবারক হোসেন খান ভাইজানের সাথে আমার অত্যন্ত আন্তরিকতার ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখতেন নাজনাব ডিজি সাহেব । শফি কামাল ভাইয়ের সখ্যতা জীবনের জন্য হয়ে গেলো। মুস্তফা আনোয়ার ভাইয়ের প্রস্তাবে শুরু করলামবিশেষ অনুস্ঠান ‘ডিএক্স ম্যাগাজিন’ উত্তরন থেকেই । আমার প্রথম অনুস্ঠানে অংশগ্রহন করলেন ভয়েস অব আমেরিকার ইকবাল বাহার চৌধুরী, বাসস’র গিয়াস কামাল চৌধুরী, তখনকার আমাদের ফেডারেশন অব ভিওএ ফ্যান ক্লবের সম্পাদক ওআমার বন্ধু ওয়ালিয়া মরিয়ম লাকী ও আকাশবানী শ্রোতা সংঘের সম্পাদক ও আমার বোন আইভি রহমান। একটি অনুস্ঠানেএমন ক’জন বিখ্যাত মানুষকে পাওয়া কতো বড় ঘটনা ছিলো। 

মোবারক হোসেন খান ভাইজানের অফিসে গিয়ে যেন প্রায়ই ঐতিহাসিক মিটিং হতো। কখনো বিবিসির ওয়ার্ল্ড সার্ভিস প্রধান , ভয়েস অব আমেরিকার অতিথি , ডয়েচে ভেলে, রেডি অস্ট্রেলিয়া সহ কতোজনকে নিয়ে মোবারক ভাইয়ের দরবারে। প্রায়ই থাকতেন আমার পরম শ্রদ্ধেয় গিয়াস কামাল ভাই। পাশেই বসতেন আমার আরেক পরম প্রিয়জন স্বাধীন বাংলা বেতারের বেলাল মোহাম্মদ ভাই। রেডিওতে গেলে তাঁর সাথে চা ও সিংগাড়াখাওয়া যেন ফরজ ছিলো। তাছাড়া আন্চলিক পরিচালক আশফাকুর রহমান খান, মোহাম্মদ আবদুল হালিম, আবু তাহের, গোলাম রাব্বানী খান , কাজী রফিক সহ আরও অনেকের সাথেই আড্ডা ও চা খাওয়া। কিন্তু এর মাঝেও প্রিয় শফি কামাল ভাইকে গিয়ে দেখে ও কিছু সময় কাটানো। 

বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের ইংরেজী অনুস্ঠান প্রায় ৫ দিন উপস্থাপন , নিউজ কমেন্ট্রি পড়া ছিলো  মধ্যরাতে। রেডিওর গাড়ী আমার রাজাবাজার বাসা থেকে পিকআপ করে এবং ড্রপ করতো। আমার বন্ধু সিনহা এম এ সাঈদ ও ফজলে হায়দার ভাই নিউজ পড়তেন । মাঝে মাঝে ফজলে ভাই লাইভ অনুস্ঠান শুরু হওয়ার পর পৌঁছাতেন। আমি নিউজ শুরু করি এবং তিনি স্চুডিওতে ঢুকে বাকীটা আমার হাত থেকে নিয়ে পড়তেন। ফজলে হায়দার ভাই মাঝে মাঝে লাইভ অনুস্ঠানে শব্দ করে মশা মারতেন। 

প্রবাসে থাকলেও আমি কোনদিন প্রিয় শফি কামাল ভাইকে ভুলিনি। আমার অত্যন্ত কাছের বন্ধু ও খ্যাতনামা নিউজ কাস্টার রেহানা পারভীনের কাছ থেকে তাঁর খোঁজখবর নিতাম। মোবারক হোসেন খান ভাইজান যখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন তখন গেলে শফি কামাল ভাইয়ের সাথে দেখা হতো। মোবারক ভাই ও চলে গেছেন বছর দু’য়েক আগে।শফি কামাল ভাই ও চলে গেলেন অন্য জগতে। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। তাঁর মৃত্যু সংবাদটি জেনেছি আমার আরেকপ্রিয় ভাইজান, বিশিস্ট সাংবাদিক কাজী রফিক ভাইয়ের পোস্টিং দেখে। তারপর বন্ধু সৈকত রুশদীর হার্দিক প্রতিক্রিয়া।