বাঙালির গর্ব বাংলা-ভাষা
- জাকিয়া রহমান
মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার্থে ভাষা আন্দোলনের সূচনা ঘটে। এই আন্দোলন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাংলাভাষী মানুষের কাছে বড়ই বিভ্রান্তকারী ছিল। প্রায় দুইশত বছর ব্রিটিশদের অধীনস্ত থাকার পর স্বাধীনতার আস্বাদে পুনরায় বিষ মিশ্রিত করার কথা কেউ চিন্তা করেনি। আশা ছিল, আলোচনা ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে মাতৃভাষা বাংলাকে আবার গৌরবান্বিত স্থানে উত্তোলন করা যাবে। এই প্রচেষ্টা চলেছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত। বলা যেতে পারে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশে) এই আন্দোলন ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, যার বিস্ফোরণ ঘটে ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ সালে। এই দিনে ‘ভাষা আন্দোলন’ বা ‘শহিদ দিবস’ এর জন্ম হয়।
শহিদের স্মরণ করে ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস’ বা ‘ভাষা দিবস’ নামে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পরিচিত ছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারী জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃতি দেবার পর বর্তমানে ভাষা দিবস বা ‘শহিদ দিবস’ কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দুই হাজার সাল থেকে পৃথিবীর ১৮৮টি দেশে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে। এই উত্তরণের কাহিনি বড় রক্তক্ষয়ী! এই বিষয়ে প্রচুর বই পুস্তক বাংলাদেশে বিরাজিত। আমি আজ এই স্বল্প পরিসরের নিবন্ধে সে কথার পুনরাবৃত্তি করতে চাইনা।
আজ শহিদের আমি সালাম দিতে এসেছি…
একুশের যোদ্ধা তোমাদের মনে করে...
অনেক শোকেও গর্ব করি,
এদিনে রাঙা পলাশের স্বপ্ন দিক্ষার
সুবাসে আমরা হৃদয় ভরি।
ভুলবনা তোমাদের বরকত, শফিউর,
রফিক, জব্বার ও সালাম!
হে! মহাবীর সব ভাষা সৈনিক
তোমাদের লক্ষ সালাম!
ভাষা মানব জীবনের চালক স্বরূপ। কথা বলে বা লিখে মনের অনুভূতি, যুক্তি-তর্ক, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, কর্ম পরিচালনা, স্বপ্ন, আশা, দুঃখ, বিরহ, উল্লাস যা কিছু প্রকাশ করার দরকার তা সম্পন্ন করতে পারি। ভাষা দিয়েই মানব সমাজ, শিক্ষা, সরকারি অফিস, কর্মপ্রতিষ্ঠান, রাজনীতি, অর্থনীতি সঠিকভাবে চালনা করা হয়।
একটি ভাষা, সাহিত্যের মাধ্যমে পরিণত হবার পর্যায়ে বিকাশ ঘটতে প্রায় হাজার বছর সময় লেগে যায়। ভাষার গভীরতা থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতি একটি জাতীর বিশ্ব পরিচয় ঘটায়। আমাদেরকে মানুষ হিসাবে সুন্দর ও সুনিপুণভাবে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করার অবলম্বন ভাষা। জীবন আর ভাষা একে অপরের ব্যতিরিকে অচিন্তনীয়। ভাষা না জানলে এবং ভাষার গভীরতা না থাকলে কিছুই সঠিকভাবে উত্থাপন করা যায়না।
সহসা কেউ যদি কখনো এসে বলে, তোমাদের রাষ্ট্রভাষা বদলে যাবে। সর্ব প্রকার কার্যকলাপ সমাপন করতে হবে অন্য আরেক বিদেশী ভাষায়, মাতৃভাষায় নয়। শিক্ষার মাধ্যমে আর সাহিত্য সংস্কৃতিতে সেই নতুন আমদানিকৃত ভাষার উপর জোড় দিতে হবে বা তোমাদের মাতৃভাষায় বিদ্যালয়ে শিক্ষা দেয়া হবেনা এবং কথোপকথন চলবে না। তাহলে, কেমন হবে? তাই ঘটেছিল বাংলাভাষীদের ভাগ্যে…
অন্তরে অন্তরে গ্রথিত সবার,
প্রিয় যে বাংলা ভাষা।
তোমাকে বিদায় দেব কি করে?
এতো বিনাশ সর্বনাশা!
এ ধরণের আরোপিত কূটনৈতিক অথবা রাজনৈতিক বিধিনিষেধ এক পর্যায়ে, অত্যাচারিত জাতীর সাহিত্য ও সংস্কৃতি সবোপরি, জীবনের মান ও আত্নসম্মানকে চিরতরে বিলুপ্ত করতে পারে।
যদিও সমগ্র পাকিস্তানে বাংলা ভাষাভাষীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তৎসত্ত্বেও তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের উর্দুভাষী কর্মকর্তারা মুষ্টিমেয় উচ্চাভিলাষী বাঙালি নেতার সাথে সামান্য আলোচনা করে এক সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, বাংলা ভাষাকে চিরতরে বাকরুদ্ধ করা।
বাঙালি জাতি দাঁড়িয়েছিল রুখে... ।
আমাদের বাংলা-বলা জিব্বাকে-
ওরা চেয়েছিল উপড়ে ফেলতে!
চেয়েছিল আমাদেরকে-
বাংলা কবিতা ও গান ভুলে যেতে।
দেখো না! দেখো এখন এসে!
ডাকি জিন্নাহ তোমাকে,
শহীদ মিনার চত্বরে বইমেলায়-
আমাদের বর্ণাঢ্য ভাষাকে।
দেখ বাংলার বর্ণমালা সারিতে সারিতে,
সাজানো আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলাতে,
সজ্জিত মাল্য জ্বলজ্বলে মলাটের অন্দরে-
অর্ঘ্য নিয়ে এসেছে দেখ শহীদদের তরে!