খবর প্রকাশিত: ০১ মে, ২০২৫, ০৯:৪১ এএম
সম্পর্ক-৩৫
মাহমুদ রেজা চৌধুরী
জানুয়ারি, ১৫,২০২৩
কিছু কিছু সম্পর্কের শেষটা বেশ দুঃখজনক। এটাকে, কি সম্পর্ক বলব জানিনা। ফলাফল মাঝে, মাঝে হতাশা জনক হয়। মনে পড়ে আব্বা অনেক আগে আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। তখন আমি রাজনীতিতে সক্রিয় হবো বলে এক ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আব্বা বললেন, এই জগতটায় তুমি ঢুকোনা। তুমি এটাকে সামাল দিতে পারবা না। আমি তো দেখেছি তোমার দাদার জীবন, তোমার চাচার জীবনটাও খুব ভালো যাবে বলেও মনে হয় না। কথাগুলি আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে আব্বা বলেছিলেন আমাকে।
আমার দাদা এক সময়ে রাজনীতির সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। অভিভক্ত ভারতে দাদা কংগ্রেসের বরিশাল জেলার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জহরলাল নেহেরুর বাবা মতিলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত বন্ধু এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টাও ছিলেন। দাদা মারা যান ভারতবর্ষ বিভক্ত হবার আগে। সম্ভবত ১৯৪৫ সালে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, দাদার রাজনৈতিক জীবন নিয়ে দাদার মৃত্যুর পর কেউ আর কোন কথা বলেনি বা তাঁর সম্পর্কে লেখেওনি। চাচা জীবিত কালে অনেকবার বলেছি চাচাকে দাদার রাজনীতি সম্পর্কে কিছু লিখে যেতে। চাচা লিখে যান নাই। কেন লিখেন নাই জানিনা। বলেছিলেন "তুই লেখ"। আমার দাদা মারা গেছেন আমার জন্মের অনেক আগে। আমি আমার দাদাকে দেখিনাই তার গল্প শুনেছি শুধু। শুনতে শুনতেই দাদার সাথে আমার এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, অনুপস্থিতির সাথে উপস্থিতির সম্পর্ক। এই সম্পর্কটাও একটা সম্পর্ক।
আজকে হঠাৎ মনে হল, আব্বা বহু বছর আগে চাচা সম্পর্কে যে কথাটা বলেছিলেন সেই কথা। চাচার পরিণতিটা দুঃখজনক হতে পারে। আব্দুল গফফার চৌধুরী, বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য কলামিস্ট এবং গদদো লেখক ছিলেন। তাঁর মতামতের সাথে বা চিন্তার সাথে আমাদের ভিন্ন মত বা দ্বিমত থাকতেই পারে। কিন্তু তার অবদান এবং ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সাহিত্য অঙ্গনের সম্পর্ককে বিচ্ছিন্ন করে দেখা যায় না। বিশেষ করে তাঁর একুশে ফেব্রুয়ারির কবিতা, ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলনের ওই সময়
বরকত, সালামের মৃত্যুতে লেখা, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, আমি কি ভুলিতে পারি"। এই গানের সুর দেন আরেক বড় শিল্পী এবং সুরকার আলতাফ মাহমুদ।
তখন থেকে এখন পর্যন্ত এই গান বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটা মানুষেরই জানা। জানিনা পৃথিবীতে এমন একটা গান যেটা প্রতি বছর গীত হয়
সেরকম গানের সংখ্যা কয়টা!
অল্প সংখ্যক হতে পারে, তার মধ্যে আব্দুল গফফার চৌধুরীর লেখা উল্লেখিত গান অন্যতম। বাংলা সাহিত্যে অনেকের মতে আব্দুল গফফার চৌধুরীর ছোট গল্প "আজান", একটা অসাধারণ গল্প। এছাড়া তার বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কলামের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, এবং গদদের ভঙ্গি
উপমহাদেশে বিকল্প আছে কি-না জানিনা। আব্দুল গাফফার চৌধুরী বাংলার পাশাপাশি যদি ইংরেজিতেও লিখতেন, উপমহাদেশে তাঁর আরেকটা বিশেষ জায়গা হয়ে যেত।
যাইহোক, লেখাটা আব্দুল গফফার চৌধুরীর 'গুনোগান" গাওয়ার জন্য না। যে প্রসঙ্গে এই লেখাটা সেটা হচ্ছে উল্লিখিত লেখকের একটা নির্দিষ্ট দলের প্রতি যে সমর্থন ছিল, সেই দলের সবার সাথে যে সম্পর্ক ছিল, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সাথে। সেই তুলনায় আব্দুল গফফার চৌধুরীর মূল্যায়ন অথবা তাঁর অবদানের স্বীকৃতি মিলেছে বলে মনে হয় না।
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সাথে অনেকের সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। এই নিউইয়র্কেও তাঁর ব্যাপারে বলতে তাঁর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে অনেকেই ছিলেন। কিন্তু আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুর পর, তাঁকে নিয়ে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কোন স্মৃতিচারণ বা আলোচনা অনুষ্ঠান দেখি নাই, শুনি নাই।
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুর পর, ঢাকা থেকে এন আর বি, প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার অনুজপ্রতিম এম ই চৌধুরী শামীম, একটা অনুষ্ঠান করেছেন নিউইয়র্কে। শামীম তখন নিউইয়র্কে বেড়াতে এসছিলেন। ঐ সময় আব্দুল গফফার চৌধুরীর মৃত্যু হয় লন্ডনে।
তাৎক্ষণিক তাঁকে স্মরণ করে শামীম নিউইয়র্কে একটা অনুষ্ঠান করেন। সেই অনুষ্ঠানে অনেকের উপস্থিতিকে অনেকে বিরোধিতা করেন। কি আশ্চর্য তাইনা!
একেও সম্পর্ক বলে! এর চরিত্র আরেকরকম। কারো মৃত্যু হলে, সেই অনুষ্ঠানে কে কথা বলবে মৃত ব্যক্তিকে স্মরণ করে এখানেও আমাদের সম্পর্কের
রাজনীতি। তাই মনে হয় রাজনীতির সম্পর্ক বিষয়টা বহু ক্ষেত্রেই অমানবিক এবং অসৌজন্যমূলক।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক আন্তরিক এবং শর্ত মুক্ত হওয়াটা ভালো। ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের চিন্তা থেকে বা স্বার্থ থেকে যে সম্পর্কগুলি তৈরি হয়, সেসবের পরিণতি ভীষণ দুঃখজনক। আব্দুল গাফফার চৌধুরী সব সময় একজন রাজনৈতিক সচেতন বোদ্ধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁর সাথে তাঁর জীবিত কালে যাদের সাথে সম্পর্ক নিজের চোখে দেখেছি, তাঁর মৃত্যুর পরপরই সেই সম্পর্কগুলিকে নিজের কাছে অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে।
তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় অনেক টেলিভিশনে প্রচার করতে শুনেছি তাকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে। কোথা থেকে তারা সেই সংবাদটি পেল জানিনা। অথচ সরকার থেকেই তার জন্য নির্দিষ্ট সমাধিস্থল মিরপুর বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে রাখা ছিল। তারপরও এরকম ভুল প্রচার, অন্তত এটা প্রমাণ করে যে, জীবিত কালে গফফার চৌধুরীর সাথে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক অথবা বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে যে সম্পর্ক উনি রাখতেন, তার জীবন অবসানের সাথে সাথেই সেটা মাটির সাথে মিশে যায়, এবং সেই সম্পর্কের প্রতি নূন্যতম কোন শ্রদ্ধা দেখালেও সীমিত ছিল। মনের মধ্যে প্রশ্ন আসে সারা জীবন একটা নীতি আদর্শ বা দলের সমর্থন করে সেই দলের সাথে একটা অন্যরকম সম্পর্ক থাকবার পরেও জীবন চলে যাওয়ার পর সেই সম্পর্কের কোন ভেলু থাকে না কেন! আমরা সেই সম্পর্ককে শ্রদ্ধা দেখাই না। সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষ যখন এভাবে আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর হয় তখন সম্পর্কের গভীরতা নিয়েও প্রশ্ন জাগে।
ভাবছিলাম আব্বা কি করে বুঝতে পেরেছিলেন যে দাদার মতোই পরিণতি ঘটতে পারে চাচার! আমার বাবা রাজনীতি করতেন না। ওনার মুখে রাজনীতির কোন কথা শুনতাম না। ওনার জীবন যাপন ছিল অন্যরকম। আমাকে রাজনীতির ব্যাপারে একটু উৎসাহী দেখে প্রায়ই বলতেন, এটা তোমার কাজ না। রাজনীতি তুমি করতে পারবে না। তোমার সাথে রাজনীতির সম্পর্ক হবে না রাজনীতি কর্মী হিসাবে। তাই এটার প্রতি মনোযোগ দিও না। রাজনীতি ছাড়াও দেশের সাথে সম্পর্ক করা যায়, মানুষের সাথে সম্পর্ক করা যায়। তুমি সেই সম্পর্ককে গুরুত্ব দিবে।
আব্বার কথা 'সম্পর্কের" ব্যাপারে আজকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। আজকে আব্বা বেঁচে থাকলে হয়তো জিজ্ঞাসা করতাম, প্রচলিত রাজনীতির সাথে ব্যক্তি মানুষের সম্পর্ক এবং সেই সম্পর্কের পরিণতি অনেক সময় হতাশার হয় কেন? এই সম্পর্কগুলি সামাজিক অন্যান্য সম্পর্কের মধ্যে কতটা প্রভাব বিস্তার করে, সেই প্রভাবের ফল কতটা ইতিবাচক আর কতটা নেতিবাচক !
Email. [email protected]