খবর প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০৬:০০ এএম
মেলোড্রামা, শব্দটা সাধারণত নাটকের সাথে যুক্ত। গ্রিক 'মেলোস' (Melos) আর ফরাসি 'ড্রেম' (Drame) মিলে মেলোড্রামা। গ্রিক ভাষায় 'মেলোস' শব্দের অর্থ গান। "ড্রামা" অর্থ নাটক। তাই মেলোড্রামা বলতে বোঝায় গীতিময় নাটক। অনেকে বলেন, সংগীত সহযোগে অলংকৃত এবং আবৃত্তিযোগ্য কোন কিছুকেই মেলোড্রামা বলে।
ইতালিতে যেমন "অপেরা" রূপে এটা বোঝানো বা ব্যবহৃত হতো তেমনভাবে ফ্রান্স এবং জার্মানিতেও মেলোড্রামা শব্দ অপেরার প্রতি শব্দ হিসাবেই গৃহীত হয়। আঠারো শতকের শেষ দিকে এই শব্দটার অর্থ কিছু পরিবর্তিত হয়। জার্মানিতে অপেরার যে অংশটুকু বাদ্যযন্ত্র (অর্কেস্ট্রা) সহযোগে কথিত হতো তার নাম দেয়া হয় মেলোড্রামা। গানের সাহায্যে নির্বাক চরিত্রের ভাবাবেগ প্রকাশের যে পদ্ধতি তাকে ফ্রান্সে বলা হতো মেলোড্রামা। উনিশ শতকের প্রথমে ইংল্যান্ডেও এই মেলোড্রামা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ফরাসি এবং জার্মান থিয়েটারের প্রভাবে। ক্রমে এই কথাটার অর্থ দাঁড়ায়, গানযুক্ত আকস্মিক এবং রোমাঞ্চকর ঘটনা প্রধান
গুরুগম্ভীর নাটক। পরবর্তীকালে অর্থ সংকোচের ফলে মেলোড্রামা বলতে নিকৃষ্ট ট্রাজেডি বা ব্যর্থ ট্রাজেডি বোঝানো হয়। একে ট্রাজিডির "Plebeian relative" বলে।
কোন মহৎ জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী অবলম্বনে ট্রাজিডির প্লট রচিত হয়। নিয়তিতাড়িত চরিত্র এমন কাজ করে যা তাকে শ্রেয় বা প্রেয় ফলদান করবে বলে ভাবে। কিন্তু সেই ফল সে পায় না। তখন নেমে আসে হতাশা। জীবনের সবকিছু বিবর্ণ, বিষাদময় হয়ে ওঠে। তীব্র ব্যথার আঘাতে বুক ভেঙ্গে যায় কখনো, কখনো। তবু চরিত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়। জীবনের এই শোচনীয় পরিণাম ট্রাজিডির উপজীব্য। ট্রাজিডির এই ভাব গভীরতাকে যে নাটক ধরতে পারেনা, বরং অতিরঞ্জনের ফলে নাটকেপোনাপূর্ণ হয়ে ওঠে, চরিত্রের মধ্যে থাকেনা সেই ব্যক্তিত্ব, তাকে আমরা সাধারণত "মেলোড্রামা" বলি। বাংলায় যাকে অতি নাটক বলা হয়। "ফারস", যেমন কমেডির তুলনায় নিম্নমানের রচনা ও অভিনয়, তেমনি ট্রাজিডির তুলনায় মেলোড্রামা নিম্নমানের।
যেমন নাটকের কাহিনীতে মিলন এবং হাস্যরসের বাড়াবাড়ি থাকলে তাকে আমরা ফার্স্ বলি। তেমনি নাটকে অতিরিক্ত দুঃখ-কাতরতাও মেলোড্রামায় পরিণত হয়।
অনেক সময়ই বলা হয় যে, মেলোড্রামা হবে বিষাদান্ত এবং এই জাতীয় নাটককে ট্রাজিডির গোত্রে ফেলা হয়েছে। তবে এটা না বললেই নয় যে, আঠারো শতকের ফ্রান্সে প্রায় কুড়ি বছর ধরে যেসব মেলোড্রামা লেখা হয়েছিল তার প্রায় সবই ছিল মিলনান্ত। আবার উনিশ শতকের মেলোড্রামার প্রায় পুরোটাই বিষাদান্ত।
এতগুলি কথা বলার কারণ, বাংলাদেশের বিগত পাঁচ দশকের রাজনীতিকেও আমাদের সামগ্রিক জীবনে এক ধরনের মেলোড্রামাও বলা যায়, যদি মেলোড্রামা কথার অর্থ বুঝে থাকি। কবে থেকে শুরু এই নাটকের? বলা যায় আমাদের স্বাধীনতার পরপরই এই নাটকের যাত্রা শুরু, পালাবদল শুরু। প্রথম দৃশ্যে অনেক কিছুর সাথে যেটা প্রবল ভাবে অনেকের চৈতন্যে নাড়া দেয় সেটা, বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক কর্মী কমরেড সিরাজ শিকদারের হত্যার গল্প।
এরপর ১৯৭৫ এ শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকান্ড। কয়েক বছরের মধ্যেই ১৯৮১ তে ঘটে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আরেক নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। এইসবগুলিই আমাদের রাজনীতির একেক পর্বের "মেলোড্রামা" র দৃশ্য এবং বাস্তবতাও। আমাদের চলতি রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন দলের গর্জন "উন্নতি" এবং তাদের সাফল্য অর্জনের "গীত" যেখানে কেবল লাভের অংককে বড় করে দেখানো হয়, প্রশ্ন, এই লাভের গুর কে খায় বা খাচ্ছে!
আমাদের অন্যায় এবং দুর্নীতি দেশের অনেক উন্নয়নকে খাটো করে দিচ্ছে। কিছুদিন আগেও এই দুর্নীতিকে ক্ষমতাসীন সরকার স্বীকার করতেন না। এখন তাঁরাই বলছেন, দুর্নীতির কারণেই নাকি তাঁদের উন্নতির গল্প এবং অর্জন ধরা পড়ছে না। এটা আরেক ট্রাজিডি। কোথাও, কোথাও এই ট্রাজেডি বাস্তবতার মঞ্চে মেলোড্রামাও হয়ে যাচ্ছে। পুঁজির দূরবীত্তায়ন অথবা দুর্বৃত্তপনায় মানুষের জীবন আজকে বিপর্যস্ত। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্তদের জীবন নাটক বাস্তবতার মঞ্চে এক মেলোড্রামার বাস্তবতাও। মেলোড্রামা অর্থ যদি হয়, উত্তেজনাপূর্ণ, রোমাঞ্চকর, ঘটনা প্রধান, নানান কন্ট্রাডিক্ট্রী, শ্রেণীরচরিত্র মুখ্য জয় বা পরাজয় নির্দেশক। তাহলে এই সবকটাই আছে আমাদের প্রচলিত রাজনীতির প্রত্যেকটা স্তরে। বিপরীতে যে সুচিন্তা এবং মুক্তচিন্তা রাজনীতিকে একটা জনকল্যাণের পথ দেখাবে বা সেই পথে হাঁটাবে তার শূন্যতাই লক্ষ্য করি আমাদের বিগত পাঁচ দশকের বিভিন্ন রাজনীতির করুন পরিণতিতে। আজও তা বিরাজমান।
বিগত পাঁচ দশক ধরে আমাদের অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং কেবল মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে এক ধরনের
"হ য ব র ল"; অর্থনীতির দুর্বল অবকাঠামো গড়ে তুলেছি, সেই অর্থনীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রখ্যাত সমাজ চিন্তাবিদ আকবর আলি খান বলেছেন, "শুয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি"! বিগত পাঁচ দশক আমরা "অর্থনৈতিক মানুষ" বা "মানুষ হিসাবে অর্থনীতিবিদ" এর কোনটাই গড়ে তুলতে পারি নাই।
সেই অনেক কাল আগে, উনিশ শতকে ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদদের ভবিষ্যৎ বাণীতে হতাশ হয়ে ঐতিহাসিক কার্লাইল অর্থনীতির নাম দিয়েছিলেন, "হতাশাবাদী বিজ্ঞান" (dismal science) প্রখ্যাত চিত্র সমালোচক জন রাস্কিন অর্থনীতিকে এক রকমের "জারজ বিজ্ঞান" ( bastard science) বলেন। মানুষের স্বার্থ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মাতামাতি দেখে, অনেকেই আবার একে "শুয়রের দর্শন" (pig philosophy) বলেও উল্লেখ করেন। যাই হোক, বিগত পাঁচ দশকে আমরা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের কল্যাণে এই অর্থনীতির জটিলতা থেকে এবং এর বাস্তব ট্রাজিডি থেকেও দেশের সাধারণ মানুষকে ইতিবাচক অর্থে তাদের অর্থনৈতিক কোন কল্যাণ সাধন করতে পারিনাই। আমাদের অর্থনীতিও আমাদের রাজনীতির বড় ট্রাজেডি।
আমাদের রাজনীতির মেলোড্রামা ক্রমান্বয়ে নিকৃষ্ট ট্রাজেডি অথবা ব্যর্থ ট্রাজিডির দিকেও আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে। কেবল বাংলাদেশকেই না বৃহত্তর অর্থে বা গ্লোবাল অর্থে সারা বিশ্বেই এই মেলোড্রামা চলছে। এই নাটক কোন কোন মানুষের জীবনে আরেক করুন নাটক যার, নির্দেশক সমাজের প্রভাবশালী শ্রেণি এবং রাজনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খানের ভাষায় যদি বলি, সমাজে "সমাজতত্ত্ববিদ হচ্ছেন, এমন কিছু ব্যক্তি যিনি কোন অপরাধ ঘটলে অপরাধী ছাড়া আর সকলের দায়িত্ব খুঁজে বেড়ান। সাংবাদিক হচ্ছেন, এমন একজন ব্যক্তি যিনি নিজে যা বোঝেন না তা সবাইকে বুঝিয়ে বেড়ান। দার্শনিক হলেন, এমন ব্যক্তি যিনি সমাধানহীন সমস্যার দুর্বোধ্য ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। রাজনীতিবিদ হলেন এমন কিছু ব্যক্তি যারা সারা দুনিয়াকে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেন অথচ নিজের খাসলত এক চুলও পরিবর্তন করেন না।
কূটনীতিবিদ হলেন এমন ব্যক্তি যিনি কিছু না বলে কথা বলতে পারেন"! এই সবগুলি চরিত্র আমাদের জীবন নাটকের মঞ্চে মেলোড্রামা রূপেও দেখি।
এক কথায় এইসব আমাদের যাপিত জীবনের এক এক Melodrama 'র অংশ। যখন যেটাতে শ্রেণী অবস্থানের কারণে সুবিধা নিজেকে রক্ষা করবার জন্য, সেটাই মঞ্চস্থ করি অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। তাই সব কিছুতেই আমাদের একটা অতিরিক্ত "প্রতিক্রিয়া" ব্যক্ত হয় যা কখনো, কখনো অনেকের জীবনের ট্রাজিডিকে হাস্যরসের বিষয় করে তুলতে চাইলেও প্রভাবশালী শ্রেণির সেই অভিনয় এতই নিম্নমানের যা দেখলেও হাসি পায়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার এবং তার প্রতিপক্ষ দল এমন কিছু পলিটিক্যাল মেলোড্রামা তৈরি করতে যাচ্ছেন এবং করছেন যার পরিণতি অতি নাটকীয় হতেও পারে। অথবা করুন হতে পারে। দুইয়েরই সম্ভাবনা আছে। আমাদের রাজনৈতিক সামনের পরিবর্তন বা সংস্কার সেটা "ফারস" হবে, না কমেডি, না ট্রাজেডি, না মেলোড্রামা! বিষয়টা ভাবনার আকাশেও ঠাঁই করেছে।
নভেম্বর, ২৫, ২০২২
নিউইয়র্ক
Email, [email protected]