NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, সোমবার, এপ্রিল ২৮, ২০২৫ | ১৪ বৈশাখ ১৪৩২
ব্রেকিং নিউজ
জব্বারের বলীখেলায় আবারও চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার ‘বাঘা’ শরীফ Bangladesh reaffirms commitment to fully Implement the CHT Peace Accord Kashmir Violence Conflict can be Solved Diplomatically or Needs a Retaliation Plan Against Pakistan ব্রেন স্ট্রোক পরবর্তী সময়ে সেরে ওঠার যুগান্তকারী ওষুধ আবিষ্কার নিউইয়র্কে প্রবাসীদের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মত  বিনিময় নিজেকে রাজা-বাদশাহ ভাবছেন ট্রাম্প! ‘দাগি’ দেখতে কয়েদির বেশে সিনেমা হলে শতাধিক নিশো ভক্ত Attorney General James Wins Case Against Google for Monopolies in Digital Advertising নিউইয়র্কে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংবাদ সম্মেলন নানা অভিযোগ উত্থাপন : বাংলাদেশ রেমিট্যান্স মেলা  বয়কটের আহবান নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় পুলিশের গুলিতে মানসিকভাবে অসুস্থ  এক ব্যক্তির মৃত্যু
Logo
logo

অনন্তযাত্রায় একজন আলী ইমাম এবং একটি খাটিয়ার গল্প--- লুৎফর রহমান রিটন


খবর   প্রকাশিত:  ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০২:০৯ পিএম

অনন্তযাত্রায় একজন আলী ইমাম এবং একটি খাটিয়ার গল্প--- লুৎফর রহমান রিটন
অনন্তযাত্রায় একজন আলী ইমাম এবং একটি খাটিয়ার গল্প
লুৎফর রহমান রিটন



শিশুসাহিত্যিক আলী ইমামের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কটা এমন যে চাইলে গোটা একটা স্মৃতিকথার বইই লিখে ফেলা যায় তাঁকে নিয়ে। আমার শৈশব-কৈশোরের উত্তাল দিনগুলোয় বিপুল স্নেহ-সান্নিধ্য পেয়েছিলাম মেধাবী এই মানুষটার। আমার বিকশিত হবার সময়টার বড় একটা অংশজুড়ে আলী ইমাম ছিলেন আমার অগ্রজবন্ধুর মতো। আমি ছিলাম তাঁর নিত্যসহযাত্রী। বিটিভিতে অসংখ্য অনুষ্ঠান করেছি আমি প্রযোজক আলী ইমামের। আউটডোরে ইউনিট নিয়ে যাবার সময় প্রায়শঃ আমাকে তুলে নিতেন, তারপর যে কোনো একটা বিষয় নির্ধারণ করে আমার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিয়ে বলতেন--বলতে থাকো। এরকম কতো অনুষ্ঠান যে করেছি আমি তার হিশেব নেই।

ওয়ারি হেয়ার স্ট্রিটে থাকতাম আমি। আর আলী ইমাম ভাই থাকতেন ঠাটারি বাজার বিসিসি রোডে। হাঁটা পথের দূরত্ব। দিবারাত্রির কতো সময় কাটিয়েছি তাঁর সঙ্গে! তাঁর ড্রয়িংরুমের চারপাশের দেয়ালজুড়ে বই আর বই। বইয়ের সমুদ্রে বসবাস এই মানুষটার। ১৯৮৪ সালে কোলকাতা বেড়াতে গিয়েছি আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে, তাঁর স্ত্রী পঁইপঁই করে বলে দিয়েছেন—‘খবরদার যদি কোনো বইয়ের বস্তা নিয়ে ফিরে আসো কোলকাতা থেকে, তাহলে বাড়িতে ঢুকতে পারবে না।’ কিন্তু আলী ইমাম ভাই সত্যি সত্যি বস্তাভর্তি বই নিয়েই ফিরেছিলেন। কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের দোকানে ঢুকে আলী ইমাম ভাইয়ের তো মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। যা দেখেন তা-ই কিনে ফেলেন!(ঢাকা তখনও কোলকাতার বইয়ের ডাম্পিংপ্লেস হয়ে ওঠেনি।)


বিসিসি রোডের নিজেদের বাড়ি থেকে আলী ইমাম ভাই আজিমপুরে শশুরমশাইয়ের বাড়িতে সিফট করলেন। নানান কাজে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আজিমপুর শেখ সাহেব বাজারের মন্দিরলাগোয়া গলিতে আলী ইমাম ভাইয়ের নতুন আবাসস্থলে যাই। একপুত্র এককন্যা নিয়ে ছোট্ট সুখি পরিবার আলী ইমামের। পুত্র অন্তু আর কন্যা অনিতা। অনিতা আমার কন্যা নদীর সমবয়েসী। একদিন আজিমপুরে আলী ইমাম ভাইয়ের বাসায় গেছি। আমাকে দেখে লাফাতে লাফাতে ছুটে এলো ছোট্ট অনিতা। ওর নাক ধরে ওকে একটু আদর করে দিলাম। আলী ইমাম ভাই বললেন—রিটন তুমি ওর নামটা জিজ্ঞেস করো তো। আমি জিজ্ঞেস করলাম—অনিতা মামনি তোমার নাম কি গো?
মাথাটা ঝাঁকিয়ে বেনী দুলিয়ে অনিতা বললো—আমার নাম শিদেবী।
--শিদেবী!
আলী ইমাম ভাই আমাকে বুঝিয়ে দিলেন ও বলেছে ওর নাম শ্রীদেবী।
আমি হেসে ফেললাম—আরে তাই নাকি! তুমিই তাহলে শ্রীদেবী! ইন্ডিয়ান মুভির বিখ্যাত নায়িকা?
একটা লাজুক হাসি হেসে অনিতা বললো—হ্যাঁ তো! আমিই শ্রীদেবী।
বললাম—তাহলে একটু নেচে দেখাও। অনিতা দেখালো। ভারী মজা পেয়ে গেলাম আমি। বললাম—মজা তো! আলী ইমাম ভাই বললেন—মজার এখনো শেষ হয়নি। তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো তো বড় হয়ে ও কী করবে?
আমি জানতে চাইলাম—শ্রীদেবী মামনি বড় হয়ে তুমি কী করবে?
এক সেকেন্ডও দেরি না করে অনিতা বললো—বড় হয়ে আমি আমির খানকে বিয়ে করবো! হিহিহি।
আমিও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। ওকে আদর করে জড়িয়ে ধরি। এইটুকুন ছোট্ট মেয়েটা ওর ভবিষ্যৎ বিয়ের পরিকল্পনা রিটন কাকুকে বলতে পেরে মহা খুশি। আমার দিকে তাকায় আর হাসে হিহিহি।

৩ 
অনেকদিন পর, সেদিনের সেই ছোট্ট পুতুলের মতো মিষ্টি মেয়েটার সঙ্গে এবার বইমেলায় দেখা হয়েছিলো। সে এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা আমার। অন্তু আর অনীতাকে এতো ছোটো দেখেছি! আর এদিকে কোন ফাঁকে যে এরা বড় হয়ে গেলো তা টেরই পাইনি। বিকেলে বইমেলায় চ্যানেল আইয়ের লাইভ অনুষ্ঠান শেষে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি বহেরাতলায়, লিটলম্যাগ চত্বরে। এমন সময় পেছন থেকে ‘রিটন কাকু রিটন কাকু’ বলে কেউ একজন ডাকলো। আমি তাকিয়ে দেখি একজন  শ্মশ্রুমন্ডিত হাস্যোজ্জ্বল মওলানা টাইপ তরুণ আমাকে ডাকছে। কয়েক সেকেন্ড পর দাঁড়িঅলার  হাসিটা রিকগনাইজ করতে পারলাম—আরে এ যে অন্তু! আলী ইমাম ভাইয়ের পুত্র অন্তু! আমাদের অন্তু! ওর হাতে একটা বাচ্চা। ওর প্যান্টের নিচের অংশ পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত মোড়ানো। সহি তরিকায়। ওর বাম পাশে হিজাব পরা একটা মেয়ে। অন্তু পরিচয় করিয়ে দিলো—রিটন কাকু এইটা আমার ওয়াইফ আর এইটা আমার ছেলে। আমি মহা বিস্ময়ে অন্তুকে ওর বউকে আর ওর ছোট্ট ছেলেটাকে দেখি! আমি বিস্ময় না লুকিয়েই বলি—তুমিতো অন্তু একেবারে সহি হুজুর হয়ে গেছো! অন্তু হাসে। ছেলেবেলার সেই মিষ্টি হাসিটা। যে হাসিটা আমার অনেক পরিচিত। অন্তুর ডান পাশে একটা মেয়ে। এই মেয়েটার হাতেও একটা পিচ্চি ছেলে। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে সেই তখন থেকে হাসছে। এই হাসিটাও আমার অনেক পরিচিত। এই হাসিটা অনিতার। আমাদের মামনি অনিতার। আমাদের শ্রীদেবী অনিতার। আমির খানকে বিয়ে না করলেও বিয়ে একটা করেছে সে। রাজপুত্তুরের মতো একটা বরও পেয়েছে সে। আর পেয়েছে ছোট্ট মায়াভরা চোখের হস্যোজ্জ্বল একটা পুত্রসন্তান!

আমি অনিতার মাথায় হাত রাখি—আরে অনিতা! তোমরা কখন এতো বড় হয়ে গেলে! আমি তো তাহলে একদম বুড়ো হয়ে গেছি!

অনিতা হাসে হিহিহি। আপনি বুড়ো হননি রিটন কাকু। নদী কেমন আছে?
আমি বললাম—নদী ভালো আছে। নদীটাও বড় হয়ে গেছে তোমার মতোই!
অন্তু আর অনিতা জানালো—আমার সঙ্গে দেখা করবে বলেই ওরা বইমেলায় এসেছে আজ। ওদের মা-ও আছেন সঙ্গে।

অনিতা আর অন্তুর বাচ্চা দুটোকে আদর করতে করতে বললাম—এই বাচ্চা দুটোর মতোই ছোট্ট এতোটুকুন ছিলে তোমরা দুজন। আর আজ তোমাদের দুজনার হাত ধরে বইমেলায় হাঁটছে তোমাদের বাচ্চারা। কী কাণ্ড কী কাণ্ড!

আমার চোখে জল আসে। আমি সেটা লুকোই। এই আনন্দাশ্রু আমার একান্ত নিজের। এটা আমি কাউকে দেখতে দিতে চাই না। আহা জীবন কী সুন্দর একটা রহস্যঘেরা চলচ্চিত্রের মতো! অতীত আর বর্তমানকে কাট টু কাট মন্তাজ কিংবা ডিজল্ভ পদ্ধতিতে জীবন নামের চলচ্চিত্রটা কয়েক সেকেন্ডে আমাকে পরিভ্রমণ করালো হেয়ার স্ট্রিট টু ঠাটারি বাজার বিসিসি রোড। ঠাটারি বাজার বিসিসি রোড টু আজিমপুর। আজিমপুর টু এলিফ্যান্ট রোড। এলিফ্যান্ট রোড টু টোকিও। টোকিও টু নিউইয়র্ক। নিউইয়র্ক টু অটোয়া। অটোয়া টু বাংলা একাডেমি। বাংলা একাডেমি টু বাংলাদেশ টেলিভিশন। ওম শান্তি!


১৯৯৪ সালে আমি বাড়ি ভাড়া নিলাম আজিমপুরে। শেখ সাহেব বাজার গলিতে। নিয়তি আমাকে ঠেলে নিয়ে এলো এমন একটা বাড়িতে যে বাড়ির বেলকনিতে দাঁড়ালে খুব সরু গলির অপর প্রান্তের জানালায় আলী ইমামকে দেখা যায়। ওরা জানালা খুললেই আমরা আড্ডা দিতে পারি। অন্তু অনীতার মা লিপি ভাবী আর নদীর মা শার্লি কতো কথা যে বলে এখানে দাঁড়িয়ে!

সোম-মঙ্গল যে কোনো বারে গভীর রাত্রিতে সোমরস পান করে আলী ইমাম ভাই বাড়ি ফিরলে ভাবীর সঙ্গে খানিকটা ঠোকাঠুকি হয়। সেই ঠোকাঠুকির অধিকাংশই, বলতে গেলে প্রায় সবটুকুই আমরা শুনতে পাই। আফসোস করে আলী ইমাম ভাই একদিন বলেছিলেন—আচ্ছা রিটন ঢাকা শহরে এতো এতো জায়গা থাকতে তোমাকে আজিমপুরেই বাড়ি ভাড়া নিতে হবে কেনো? আজিমপুরে নিয়েছো ঠিক আছে কিন্তু সেটা শেখ সাহেব বাজারেই হতে হবে কেনো? আর যদি হলোই বা তোমার বাসাটা ঠিক আমার জানলা বরাবরই হতে হবে কেনো? কোনো মানে হয়!
আমি হাসি—আপনি আমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাইলেও নিয়তি আমাদের দূরে থাকতে দেবে না আলী ইমাম ভাই!
আজিমপুরে থাকার সময় নদীর সঙ্গে অনীতার খুব ভাব হয়েছিলো।ওরা দুজন বন্ধু হয়েছিলো।

সময় বহিয়া যায়।
অনেক বছর পর কানাডায় বসে 'আমার প্রথম বই' প্রকাশের গল্পটা লিখতে শুরু করেছিলাম ‘সচলায়তন’ নামের একটা ব্লগে। প্রথম কিস্তিতে বইটিকে ঘিরে আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের যে অবনতি ঘটেছিলো, তার স্বচ্ছ্ব আভাস ছিলো। পরের কিস্তিতে সেই কাহিনি লিখবো বলে ঘোষণা দেয়া ছিলো। বলা ছিলো--চলবে। অর্থাৎ পরের পর্ব আসিতেছে। লেখাটা শার্লি এবং নদীর নজরে পড়ে গিয়েছিলো এবং সঙ্গে সঙ্গে ওরা রুদ্র মূর্তি ধারণ করেছিলো। শার্লি বলেছিলো--খবরদার আলী ইমাম ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটা কথাও লিখবি না। নদী বলেছিলো--বাবা পৃথিবীতে এতো সাবজেক্ট থাকতে আলী ইমাম আঙ্কেলের সঙ্গে তোমার ঝামেলার কাহিনিটাই কেনো লিখতে হবে! তুমি জানো অনিতা আমার বন্ধু। খবরদার তুমি অনিতার বাবাকে নিয়ে খারাপ কথা লিখতে পারবে না।
পারিবারিক ভাবে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে বাধ্য হয়ে আমি ক্ষ্যান্ত দিয়েছিলাম। দ্বিতীয় কিস্তি লেখার সাহস আর করিনি। দ্বিতীয় পর্বটা(ঝামেলার) বাদ দিয়ে লিখেছিলাম তৃতীয় পর্বটা অর্থাৎ আমার 'ধুত্তুরি' নামের বইটার আত্মপ্রকাশ কাহিনি।

দীর্ঘদিবস দীর্ঘরজনী প্রায় সাত বছর কানাডায় আটকে থাকার পর ২০০৭-এর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশে ফিরলাম। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চ্যানেল আই কার্যালয়ে যাওয়ার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমার প্রিয় কিছু মানুষকে সাগর ভাই জড়ো করেছিলেন হোটেল ওয়েস্টিন-এ। যাঁদের সঙ্গে আমার সাতটি বছর ধরে দেখা হয় না। যাঁদের সঙ্গে দেখা হলে আমার মনটা জুড়িয়ে যাবে। প্রিয় সেই মানুষদের মধ্যে আলী ইমাম ভাইও ছিলেন। (সাগর ভাই ইউ আর গ্রেট!)

এরপর প্রতি বছর আমি বাংলাদেশে যাই। প্রিয় মানুষদের অপরূপ সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসি বেশ কিছু দিন। প্রতিবারই আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয় দেখা হয়। আমি ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে গাড়িতে চ্যানেল আই কার্যালয়ে যেতে যেতে যে কজনকে ফোন করে আমার আগমন সংবাদ দিই তার মধ্যে আলী ইমাম ভাইও থাকেন। একবার ১৬ই ডিসেম্বর সকাল থেকে চ্যানেল আই-এর  নতুন কার্যালয়ে(তাজউদ্দিন আহমেদ স্মরণি, তেজগাঁও)সরাসরি সম্প্রচারিত বিজয় মেলায় আমাকে দেখতে  পেয়ে লিপি ভাবী আলী ইমাম ভাইকে ঠেঁসে ধরেছিলেন—রিটন যে ঢাকায় তুমি সেটা আমাকে জানালে না কেনো? আলী ইমাম ভাই আমতা আমতা করেন। এরপর খুব দ্রুত ভাবী চলে আসেন চ্যানেল আই কার্যালয়ের সেই বিজয় মেলায়, আলী ইমাম ভাইকে সঙ্গে করে। আমার আগমন সংবাদ ভাবীকে জানাননি বলে আমার দিক থেকেও কিছু কপট বাক্যবাণ হাসিমুখে গ্রহণ করে নিলেন তিনি।

২০১১ সালে হোটেল ওয়েস্টিনে কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুনের জন্মদিনের উৎসবে আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে অন্যরকম সাজ পোশাকে লিপি ভাবীকে দেখে আমি তো ভীষণ মজা পেয়ে গেলাম! টাইট হিজাবে মাথা বাঁধা তাঁর। শুধু মুখটা দেখা যায়। ফুলস্লিভ ব্লাউজ, হাতের কবজি পর্যন্ত ঢাকা। তারপর কালো একটা পশমী চাদরে পুরো শরীরটাকে এমনভাবে মোড়ানো যে মনে হবে ওয়েস্টিনে নয় কোনো উপাসনালয়ে এসেছেন তিনি। এই লিপি ভাবীকে দেখে আমার বহুদিন আগের সেই লিপি ভাবীর কথা মনে পড়ে যায় যে লিপি ভাবী ছুটির দুপুরে বিসিসি রোডের সরু গলির চিলেকোঠায় আমার সঙ্গে হারমোনিয়মে ডুয়েট গাইছেন—পৃথিবী আমারে চায় রেখো না বেঁধে আমায় খুলে দাও প্রিয়া খুলে দাও বাহুডোর...। আমি ছুটে গিয়ে দুহাতে লিপি ভাবীর হাত দুটো ধরে ফেলি। লিপি ভাবী সাইকোলজির সাবেক অধ্যাপিকা তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিতে তৎপর হয়ে ওঠেন—ছেড়ে দাও ভাই ছেড়ে দাও। কিন্তু আমি ছাড়ি না। বলি—এই অবস্থা ক্যান আপনার? ভাবী অনুনয় করে—প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও ভাইয়া আমি হজ্জ্ব করেছি...শুনে আমি আরো মজা পেয়ে যাই--হজ্জ্ব করেছেন তো কী হয়েছে ভাই তার বোনের হাত ধরবে না! আমি আরো ঠেঁসে ধরি। আমার কাণ্ড দেখে পাশের গোলাকার টেবিলে বসে থাকা আলী ইমাম ভাই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন। মাযহার আর শিরীন বকুল আমার কাণ্ড আর লিপি ভাবীর কাকুতি মিনতি দেখে হেসেই লুটোপুটি। ভাবীর ব্যাখ্যা অনুযায়ী ভাই হই আর যাই হই, হজ্জ্ব করার পর আমি এখন একজন বেগানা পুরুষ। হাহ হাহ হাহ।


আমরা একসঙ্গে বহু জায়গায় গেছি।সেন্ট মার্টিন দ্বীপে গেছি। সুন্দরবন গেছি। কোলকাতা গেছি। চট্টগ্রাম-রাজশাহী কতো জায়গাতেই না গেছি আমরা একসঙ্গে! কখনো টিভির জন্যে অনুষ্ঠান বানাতে। কখনো সাহিত্যের অনুষ্ঠানে। কখনো শুধুমাত্র এককাপ চা পান করতে। হ্যাঁ, গুড়ের চা খেতে এক বিকেলে আমি আর আলী ইমাম ভাই ওয়ারি থেকে সদরঘাট গিয়ে নদী পার হয়ে কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা নামের একটা গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। ওখানে একটা বিখ্যাত চায়ের দোকান ছিলো। আমরা দুজন কয়েক কাপ করে গুড়ের চা খেয়েছিলাম। আমাদের পাগলামির কথা শুনে অনেকেই হেসেছিলো। খাওয়ার ব্যাপারে আমাদের দুজনারই বিপুল আগ্রহ। বহু বিচিত্র খাবার আমরা খেয়েছি।   
১৯৮৪ সাল। আমি আর শিশুসাহিত্যিক আলী ইমাম সত্যজিৎ দর্শন শেষে ঢাকায় ফিরছি কলকাতা থেকে। বেনাপোল বর্ডারে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেলো। আমাদের চোখের সামনে কলকাতা বর্ডার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা তাড়াহুড়ো করে ইমিগ্রেশনের প্রাথমিক ধাপ অতিক্রম করছি। তিনচারজন দালালের খপ্পড়ে পড়লাম। ওরা বললো—দাদা আপনারা তো আজ আর বর্ডার ক্রস করতে পারবেন না। অই যে দেখুন আসল লোকটাই চলে যাচ্ছে সবকিছু গুটিয়ে নিয়ে। আজ আপনাদের সারারাত এইখানেই কাটাতে হবে দাদা। তারচে দুশো রুপি ছাড়ুন, ইমিগ্রেশনের ওই বড় কত্তাকে ধরে একটা সিল লাগিয়ে দেবার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি। এমনিতেই ওই বড় বাবু খুব বদরাগী। আপনারা পড়েচেন ওই বাবুরই হাতে।
আলী ইমাম  ভাই প্রায় রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু আমি বললাম—লাগবে না। আমরা কোনো অবৈধ মাল নিয়ে যাচ্ছি না যে তার জন্যে আপনাদের দুশো রুপি ঘুষ দিতে হবে।
আমার কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো দালালরা। ওদের একজন অন্যজনকে বললো—এই লাল ছার্টটাকে(আমার পরনে লাল শার্ট ছিলো।) ছেকসন চৌছট্টিতে ফেলতে হবে। 
আলী ইমাম ভাই কিছুটা ঘাবড়ে গেছেন। আমাকে ফিসফিস করে বললেন—টাকাটা আমিই দিচ্ছি। তুমি খামোখা ঝামেলায় জড়িও না। আমি বললাম—ভয়ের কিছু নেই। আমি শেষ চেষ্টাটা করি।
একটা দালাল বললো—যান দাদা বড়বাবুর একটা ঝাপ্টা খেয়ে আছুন।
দুটো পাসপোর্ট নিয়ে দৌড়ে গেলাম বর্ডারের শেষ ধাপের শেষ কর্তার কাছে। তিনি তখন সত্যি সত্যি আক্ষরিক অর্থেই ঝাঁপ বন্ধ করছেন। শুধু তালা মারা বাকি। আমি গিয়ে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম—সরি আমাদের একটু দেরি হয়ে গেছে। কাইন্ডলি যদি একটু...
ভদ্রলোক খুব বিরক্তি নিয়ে তাকালেন আমার দিকে। তারপর আমাকে দেখেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন—আরে! আপনি একজন লেখক না? কিছুদিন আগে একটা বইয়ের লাষ্ট কভারে আপনার ছবি আমি দেখেছি! ঢাকাকে নিয়ে লেখা ছড়া। একজন যাত্রী কলকাতা যাবার সময় আমাকে দিয়ে  গিয়েছিলো!
আমি বললাম—জ্বি। ‘ঢাকা আমার ঢাকা’ নাম বইটার। (ওটা সেই বছরই বেরিয়েছিলো!)
--পড়েছি আমি ওটা। দেখুন তো কী কাণ্ড! সেই আপনিই কিনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে!
এরপর ঝাঁপ খুলে ড্রয়ার থেকে সিল-প্যাড বের করে আমাদের দুজনার পাসপোর্টে ধামাধাম দুটো ক্লিয়ারেন্স ছাপ্পড় মেরে দিলেন ভদ্রলোক। দালালগুলোকে বিস্ময়ের অকুল দরিয়ায় নিক্ষেপ করে ভারতের সীমানা পেরিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম বাংলাদেশে।
আলী ইমাম ভাই এখনো সেই সন্ধ্যার গল্পটা বলেন। লাল শার্ট পরা কৈশোরোত্তীর্ণ সদ্য যুবা রিটনের সাহসের প্রমাণ হিশেবে গল্পটা তিনি বলেন প্রায়শঃ।


কথা যে কতো সুন্দর করে বলা যায় তার উপমা আলী ইমাম। বক্তৃতা যে কতো চমৎকার হতে পারে তার উদাহরণ আলী ইমাম। অবিরাম অপরূপ সব শব্দের দুর্দান্ত চয়নে আলী ইমামের কথামালা হয়ে ওঠে অনন্যসাধারণ। বাংলা ভাষা যে কতোটা শ্রুতিমধুর সেটা আলী ইমামের বক্তৃতা শুনলে বোঝা যায়। ছেলেবেলা থেকেই আমি তাঁর বক্তৃতার বিমুগ্ধ শ্রোতা। তাঁর কথা বলার অপূর্ব দক্ষতার একটা ঘটনা বলি।

আমি তখন লাবণী নামের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করি। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায় আমার অফিস। সন্ধ্যার আগে আগে আলী ইমাম ভাই এসে উপস্থিত। আমার পরণে শাদাকালো ঝলোমলো শার্টটার প্রশংসা করে বললেন—তোমাকে নিতে এলাম। চলো যাই টিভিতে। রাত আটটার নিউজের পরপর মিনিট পনেরোর একটা স্পেস পাওয়া গেছে। তুমি আর আমি মিলে সময়টার সদব্যবহার করি চলো। তুমি কয়েকটা বইয়ের পরিচিতি দাও আর আমি একটা ডকুমেন্টারি চালিয়ে ওতে কথা পাঞ্চ করে দেবো ডাইরেক্ট। তো গেলাম। সংবাদ পাঠক তাঁর সংবাদ পাঠ শেষ করা মাত্র আমাকে কন্ট্রোল রুম লাগোয়া নিউজ বুথে বসিয়ে দেয়া হলো। আমি কয়েকটা বইয়ের পরিচিতি তুলে ধরলাম। লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে। আমার অংশটা শেষ হওয়া মাত্র চালু হয়ে গেলো রেকর্ডেড ক্যাসেট। অপরূপ বাংলাদেশের গ্রামের একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো। নেপথ্যে আলী ইমামের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। আমি নিউজ বুথ থেকে বেরিয়ে দেখি একটা মনিটরের সামনে বসে পর্দায় ভেসে ওঠা দৃশ্য দেখে তাৎক্ষণিক ভাবে যুৎসই শব্দমালা বসিয়ে দিচ্ছেন আলী ইমাম। লিখিত স্ক্রিপ্ট ছাড়া চলমান ছবির সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে অবিরাম অর্থবহ বাক্যবিন্যাস এতোটা অনায়াসে করছিলেন তিনি যে আমি তো আমি, কন্ট্রোল রুমের কর্মীরাও বিস্মিত। ক্যামেরায় নৌকার গলুইকে বিগ ক্লোজ শটে ধরা হয়েছে। স্লো মোশানে পুরো নৌকোটা পরিস্ফুট হতে হতে বাংলাদেশের নৌকো সম্পর্কিত একগাদা তথ্য আলী ইমাম ভাই ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছেন সুললিত কণ্ঠে অপরূপ দক্ষতায়। পুরনো দিনের একটা ইট-সুরকি খসে পরা মসজিদের ছবি ভেসে উঠলো স্ক্রিণে। আলী ইমাম ভাই পুরাত্তত্ব-স্থাপত্যকলা আমাদের ঐতিহ্য ইত্যাদির সঙ্গে বর্তমানকে এমনভাবে মেলালেন যে মনে হলো অনেক খাটাখাঁটনি করে রচিত একটা সুলিখিত স্ক্রিপ্ট বুঝিবা তিনি পাঠ করে যাচ্ছেন। কথক হিশেবে আলী ইমামের এই গুণটির কথা অনেকেই জানেন না। এই ব্যাপারে এখনও অনন্য তিনি।


২০০৯ সালে আলী ইমাম ভাই তাঁর ‘ছড়া ও কবিতাসমগ্র’ বইটি সাগর ভাই আমীরুল আর আমাকে উৎসর্গ করেছেন। উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন—‘বাংলা শিশুসাহিত্য ঋদ্ধ হয়েছে/যাদের অবিরাম লেখনীতে/শিশুসাহিত্যে বাংলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত/তিনজন প্রিয়ভাজনেষু/ফরিদুর রেজা সাগর/লুৎফর রহমান রিটন/আমীরুল ইসলাম।’
তিন বছর পর ২০১২ সালে সেই বইটা তিনি আমার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের বন্ধু মহসিন রেজার মাধ্যমে। বইটা হাতে নিয়ে প্রচ্ছদ উলটে উৎসর্গ পাতায় যাবার আগেই পুস্তানির পর প্রথম পাতায় আলী ইমাম ভাই তাঁর ঝকঝকে হস্তাক্ষরে লিখেছেন—‘রিটন, তুমি ছিলে আমার দুই সহোদরের সহপাঠি। পুরনো ঢাকার ঠাটারি বাজার-এ কেটেছে স্মৃতিময় কিশোরকাল। আজ বার্ধক্যের সীমায় উপনীত হয়ে বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধি করছি তুমি আমার সেই দুই সহোদর অপু আর কাজল(যাদের নাম রেখেছিলাম সত্যজিৎ প্রভাবিত আর পথের পাঁচালিতে মগ্ন হয়ে)এর চাইতেও আমার জীবনে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদান রেখেছ।
শুধু রক্তের সম্পর্কটাই কি মানুষের জীবনে প্রধান?
আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।
আলী ইমাম ৬/৩/১২’

আসলেই।
রক্তের সম্পর্কটাই মানুষের জীবনে প্রধান নয়। কোনো কোনো সম্পর্ক রক্তের সম্পর্কের  চাইতেও বেশি। আমার উদ্দেশে লেখা আলী ইমাম ভাইয়ের এই বাক্যটি এক ঝটকায় আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো নব্বুইয়ের দশকের এক দুপুরে। বিটিভি ভবনে আলী ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রচন্ড ঝগড়া হলো। আলী ইমাম ভাইয়ের স্বভাবের মধ্যে মুহূর্তে চোখ পল্টানির একটা ব্যাপার আছে। আমার ওপরেও সেটা প্রয়োগ করে ফেলেছিলেন। তখন বিটিভি রামপুরা ভবনের একটি কক্ষে পাশাপাশি টেবিলে বসেন আলী ইমাম, মোহাম্মদ আবু তাহের, ম হামিদ, হাবীব আহসান, এবং খ ম হারুণ। আমার সঙ্গে চোখ পল্টানি দেবার সময় ওরাও কেউ কেউ ছিলেন। আমিও রিয়্যাক্ট করেছিলাম প্রচণ্ড ভাবে। রামপুরা ভবনটার বাইরের পৃথিবীতে তাঁর সঙ্গে আমার মোলাকাতের ঘোষণা দিয়ে আমি বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠতেই ছুটতে ছুটতে আলী ইমাম ভাই আমার পাশে ঊঠে বসলেন। স্বভাবগত আচরণের জন্যে বারবার দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু আমি কঠোর অবস্থান থেকে নড়ি না। মৌচাকের দিকে রিকশা যাচ্ছে। মালিবাগ রেল ক্রসিং-এ রিকশা থামলে আলী ইমাম ভাই আমার একটা হাত চেপে ধরলেন। তারপর এমন অদ্ভুৎ একটা কথা বললেন যে আমার সমস্ত রাগ পানি হয়ে গেলো। আলী ইমাম ভাই বললেন—দেখো রিটন আমি মরে গেলে আমার খাটিয়া তোমাকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে সবার আগে। তুমি মরে গেলে সবার আগে আমাকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে তোমার খাটিয়া। আমাদের তো এভাবে ঝগড়া করা মানায় না! 

মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে অবাক করা দৃশ্যটা ভেসে উঠলো। খাটিয়ায় শুয়ে আছি আমি। খাটিয়ার হাতল কাঁধে বিষণ্ণ অশ্রুসজল আলী ইমাম আরো অনেকের সঙ্গে আমার কফিনটি বহন করে চলেছেন! ডিজল্ভ। এবার খাটিয়ায় আলী ইমাম ভাই। খাটিয়ার হাতল কাঁধে বিষণ্ণ অশ্রুসজল আমি আরো অনেকের সঙ্গে আলী ইমাম ভাইয়ের কফিনটি বহন করে চলেছি! আহারে!

প্রিয় আলী ইমাম ভাই, গতকাল থেকে অটোয়ায় শুরু হয়েছে বরফের মৌসুম। সারাদিন সারারাত ধরে বরফ পড়েছে। জানলায় যতোদূর চোখ যায় শুধু শাদা আর শাদা। এখন, এই মুহূর্তে অপরাহ্নের ঝকঝকে রোদে চকচক করছে বরফের শাদা কণাগুলো। আপনার একটা বইয়ের নাম ছিলো ‘শাদা পরি’। শাদা বানানটা আপনি তালেব্যশ্য দিয়ে লিখেছিলেন। তাতে করে শাদাটার নাকি ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পায়! কানাডার শাদার ঔজ্জ্বল্যে আজ বারবার আপনার  প্রসন্ন মুখচ্ছবিটাই ভেসে ভেসে উঠছে। আর ভেসে উঠছে আপনার কথিত সেই খাটিয়ার ছবিটাও। কী আশ্চর্য! ওখানে একবার আপনি শুয়ে থাকেন তো আরেকবার আমি।             
২০ নভেম্বর ২০১৪

পুনশ্চ >
বাংলাদেশ থেকে সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে আজ খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙলো শাহাবুদ্দিন নাগরীর হোয়াটসএপ মেসেজে। ঘুম ঘুম চোখে দেখি নাগরী ভাই লিখেছেন--রিটন শোক সংবাদ। আলী ইমাম ভাই ইন্তেকাল করেছেন। তাঁর বিদেহী আত্মার জন্যে দোয়া করো...
আমার সকালটা এলোমেলো হয়ে গেলো।
সেই সাত সকালেই ফোন করলেন বন্ধু দিনু বিল্লাহ--ওস্তাদ আলী ইমাম মারা গেছেন। আমার সঙ্গে অতো ঘনিষ্ঠতা ছিলো না কিন্তু আপনার কাছে তাঁর এতো গল শুনেছি যে মনে হলো ঘুম ভাঙিয়ে হলেও খবরটা আপনাকে জানানো দরকার...
এরপর ঢাকা থেকে ফোন করলেন আবেদ খান--রিটন আলী ইমামের মৃত্যু সংবাদটি জানার পর প্রহমে তোর কথাই মনে পড়লো আমার...
আবেদ ভাইকে আমি আলী ইমাম কথিত সেই খাটিয়া বিষয়ক কথাটা বলি। বলতে বলতে ভেঙে পড়ি। আমার পৃথিবীটা ঝাপসা হয়ে আসে। অশ্রুর প্রবল প্লাবন এসে আমার কণ্ঠকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবেদ খান বলেন--তোর সঙ্গে পরে কথা বলবো রে। তুই নিজেকে সামলে নে আগে।

ঢাকায় আমি ফোন করি অন্তুকে, আলী ইমামের পুত্র ডাক্তার তানভীর ইমাম অন্তুকে। আমার ফোনটা রিসিভ করে অন্তু বললো--রিটন কাকু, আমি এখন বাবার লাশ নিয়ে একটা মসজিদে অপেক্ষা করছি। এখানে বাবার গোসল হবে।
আমি বললাম--কাকু এই সময়টায় তোমার বাবার কফিনের পাশে আমারও থাকবার কথা ছিলো অন্তু......।

আহারে জীবন! জীবন আমাদের সঙ্গে কী রকম কানামাছিই না  খেলে! কথা ছিলো আগে কিংবা পরে আমরা একে অন্যের খাটিয়া কাঁধে তুলে বহন করবো। সমাহিত করবো। কিন্তু নিয়তি সেটা হতে দিলো না......।
আপনার কফিন থেকে সাড়ে বারো হাজার কিলোমিটার দূরের দেশে বসে নিরবে অশ্রুসজল বিদায় জানাই আপনাকে।

২০২০ সালের একুশের বইমেলায় ঝিঙেফুলের স্টলে কয়েকটা শুক্র-শনির বিকেলে জীবনের শেষ দেখার দিনগুলোতে বহু বেদনার কিছু কাহিনি আমাকে বলেছিলেন আপনি। খুব কাছের মানুষ বলে জানা নিজের একান্ত আপন মনে করা মানুষদের অবজ্ঞা অসম্মান অপমানের গল্পগুলো আমাকে বলতে গিয়ে কণ্ঠ বারবার ধরে আসছিলো আপনার। কয়েকবার আপনি অশ্রু লুকিয়েছেন আমার কাছ থেকে। আপনার নখের যুগ্যি নয় এমন মানুষদের মাধ্যমে আপনাকে করা অসম্মানগুলো আমাকে জানাচ্ছিলেন যখন, তখন, কান্নার গমককে গিলে ফেলতে গিয়ে কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছিলেন আপনি। ঝিঙেফুলের কর্ণধার খসরু ভাই সেই দৃশ্য দেখে দূরে সরে গিয়েছিলেন।
আমি আপনার হাতটা ধরে রেখেছিলাম। আপনি ফের বলেছিলেন ওই খাটিয়ার গল্পটা আহা...।     

প্রিয় আলী ইমাম, বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের অবিস্মরণীয় নায়ক,  কিশোর পাঠকদের প্রিয় লেখক, অগ্রজ বন্ধু আমার, ভাইয়ের অধিক ভাই বন্ধুর অধিক বন্ধু আমার, শান্তিময় হোক আপনার অনন্তযাত্রা।
অমৃতলোকে পরম শান্তিতে থাকুন আমার আলী ইমাম ভাই...

২১ নভেম্বর ২০২২