NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, সোমবার, এপ্রিল ২৮, ২০২৫ | ১৫ বৈশাখ ১৪৩২
Logo
logo

৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যার এক কলংকময় দিবস


খবর   প্রকাশিত:  ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, ১২:১৫ এএম

৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যার এক কলংকময় দিবস

 

শিব্বীর আহমেদ: ৭ নভেম্বর, এই দিনটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক কলংকের দিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর, খুনি খন্দকার মোশতাক স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ঠান্ডামাথার খুনি জেনারেল জিয়া মিলে অবৈধভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু মোশতাক তিন মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। জিয়া তাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই ক্ষমতা দখল করে নেয়। ইনডেমনিটি দিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করে দেয়। খুনীদের পুরস্কৃত করে, মন্ত্রী বানায়, একই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে এরশাদ, খালেদা জিয়া। জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন এবং ১৯৭৫ সালের পর ১৯বার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। প্রতিবার অভ্যুত্থানকালে, জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনী, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হাজার হাজার কর্মকর্তা ও সৈন্যকে নির্মমভাবে কোর্ট মার্শালের নামে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে এবং এদের মধ্যে বড় একটা অংশ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। প্রকৃতপক্ষে ৭ নভেম্বর হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস। ১৯৭৫ সালের এদিন থেকে শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের হত্যার ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। শুরু হয় আবারো পাকিস্তানের ভাবধারায় দেশকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। ১৯৭৫ সালের পনের আগস্টের কালরাত্রিতে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি ঘাতকরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর একই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি জেলখানার অভ্যন্তরে ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মাত্র চারদিন পরই সাতই নভেম্বর থেকে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যাকান্ড।

১৯৭৫ সালের এদিনে তথাকতিত সিপাহী বিপ্লবের নামে প্রথমে হত্যা করা হয় তিন খ্যাতনামা মুক্তিযোদ্ধাকে। এরা হলেন- খালেদ মোশাররফ বীরউত্তম, কে এন হুদা বীরউত্তম এবংএ টি এম হায়দার বীরবিক্রম। দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তরে অবস্থানকালে সকালে তাদের একেবারে কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে দুজন কোম্পনি কমান্ডার আসাদ এবং জলিল। লেখক গবেষক গোলাম মুরশিদ তার ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে লিখেছেন, ’কর্নেল শাফায়াত জামিল বিদ্রোহের খবর পেছের থেকে গিয়েছিলেন বঙ্গভবনে। কিন্তু যখন বিদ্রোহী সেনারা স্লোগান  দিতে দিতে বঙ্গভবনের কাছাকাছি পৌঁছে যায় তখন তিনি সঙ্গীদের নিয়ে দেয়াল টপকে পালিয়ে যান।’

এর আগে ৬ নভেম্বর ভোর রাতে গৃহবন্দী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে যায় বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুকের ল্যান্সার বাহিনীর একটি দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার অন্যতম ঘাতক ল্যান্সার মহিউদ্দিন ছিলো এই দলের নেতৃত্বে। তারা জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসে কর্নেল রশিদের দুই নম্বর অ্যাটিলারি রেজিমেন্টের দপ্তরে। গোলাম মুরশিদ আরো বলেন, মুক্তি পেয়েই জিয়াউর রহমান সদ্য নিযুক্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহামস্মদ সায়েমের অনুমতি ব্যতিরেকে বেতারে ভাষণ দিতে চলে যান। ’৭১-এর ২৭ মার্চের মতোই সংক্ষিপ্ত ঘোষণা দিয়ে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দাবি করেন। পরে অবশ্য পদবী বদলিয়ে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন।পরবর্তী সময়ে গণভোট (হ্যাঁ-ভোট ও না-ভোট), প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন এবং পার্লামেন্ট নির্বাচন দিয়ে জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলেও তার আমলে ২০টির বেশী অভ্যুত্থান হয়েছিল বলে বিভিন্ন তথ্যে পাওয়া যায়। এসব অভুত্থানে অসংখ্য সামরিক সদস্য নিহত হন বলে জানা যায়। প্রায় প্রতি তিন মাসে একটি করে অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল জিয়ার শাসন আমলে বলেও বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে গোলাম মুরশিদ বলেন, ‘একবার ফারুক-রশিদ ইত্যাদির শৃংখলা ভঙ্গকে ক্ষমা করার পর জিয়া সেনাবাহিনীকে শৃংখলার মধ্যে ফিরিয়ে আনতে খুবই চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একটার পর একটা অভ্যুত্থান সেনাবাহিনীতে হতেই থাকে। প্রতিটি অভ্যুত্থানের পর বহু সেনা সদস্যকে তিনি ফাঁসিতে ঝোলান। অনেককে বিনা বিচারে পাইকারিভাবে হত্যা করে গণকবর দেয়া হয়। বিশেষ করে ’৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিমান বাহিনীর অভ্যুত্থানের পর শত শত লোককে বিনা বিচারে অথবা সংক্ষিপ্ত বিচারে হত্যা করা হয়। ফলে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, বিমান-বাহিনীতে মাত্র ১১ জন কর্মকর্তা থাকেন। তাদের মধ্যে বিমান চালাতে পারতেন মাত্র তিনজন।’ মার্কাস ফ্র্যান্ডার মতে এই অভ্যুত্থানের কারণে আড়াই হাজার সেনা সদস্য নিহত হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত সমালোচিত বিতর্কিত দিন ৭ নভেম্বর। ১৯৭৫ সালে সংগঠিত এদিনের ঘটনা জাতীয় রাজনীতিতে যে ওলটপালট করে দেয় তার রেশ থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি বাংলাদেশের রাজনীতি। দেশবিরোধী রাজাকার আলবদর বাহিনির কাছে ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হলেও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির কাছে এই দিনটি মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস। ইতিহাস সঠিক পর্যালোচনরা করেও এই দিবসের প্রতিই রায় পাওয়া যায়।

১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যাকারিরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ভাবাদর্শের যে জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনেরা দেশকে আবারও সে জায়গায় নিয়ে যায়। ৩ নভেম্বর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে হত্যাকারিদের উৎখাত ও সেনাবাহিনীর মধ্যে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছিল। সামরিক আদালতে কর্নেল তাহের ও জাসদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের প্রচেষ্টা নিয়েছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতায় সামরিক আদালতে বিচারের নামে প্রহসন করে কর্নেল তহেরকে হত্যা ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।হত্যা ক্যু আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মাধ্যমেই বিএনপির অভ্যুদয়। ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান বহু মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক ও অফিসারের লাশের ওপর দাঁড়িয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। জিয়া শুধু অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করাই নয়, সেই ক্ষমতা নিষ্কণ্টক রাখতে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর অফিসার হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছিলেন।

সেনা ছাউনিতে বিএনপির জন্ম। জনগনের প্রয়োজনে জনগনের মাঝ থেকে উঠে আসা কোন রাজনৈতিক দল নয় বিএনপি। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে অগণতান্ত্রিক ভাবে তারা দল গঠন করেছে। আজ যারা বিএনপি’র শীর্ষ ক্ষমতায় বসে আছে তারা সবাই সেই উচ্ছিষ্ট গ্রহণ করেই বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। আর গত একযুগ ধরে এই অশুভ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি বিএনপি নির্বাচনকে বর্জন করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা এমনকি নির্বাচন ঠেকানোর নামে শতশত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে গণতন্ত্র নস্যাৎ করতে চেয়েছে। কিন্তু দেশের জনগণ তা সফল হতে দেয়নি।

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত কর্নেল শাফায়াত জামিল রচিত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর শীর্ষক বইতে লিখেছেন: ‘সিপাহী বিদ্রোহে অংশ নেয়া সিপাহীরা ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত এবং তারা কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো ব্যাটালিয়নে ছিল না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যড়যন্ত্র এবং জঘন্য হত্যাকান্ডে লিপ্ত হওয়ার জন্যই বিশেষ মহল ৭ নভেম্বরের হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিল। আর বিশেষ মহলের নেপথ্যে কারা ছিল তা জাতির কাছে আজ স্পষ্ট।’

লেখক ও গবেষক আনোয়ার কবির বলেন, ‘৭ নভেম্বর প্রথম প্রকাশ্যে হত্যার শিকার হন ২ জন সেক্টর কমান্ডার ও ১ জন সাব সেক্টর কমান্ডার। আর এই ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ২১ জুলাই ১৯৭৬ সালে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন আরেকজন সেক্টর কমান্ডার। এ ছাড়া, সেনাবাহিনীর ভেতরে ১৩ জন হত্যার শিকার হন। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও কোনো সেক্টর কমান্ডারকে হারাতে হয়নি। আর তাই হত্যার নৃশংস ভয়াবহতা ৭ নভেম্বরকে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ে পরিণত করেছে।’স্বাধীন বাংলাদেশে রক্তাক্ত ১৫ অগাস্ট, ৩ নভেম্বরের ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে। এই দিন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার কলঙ্কিত ষড়যন্ত্রের দিন, বিশ্বাসঘাতকতার দিন, পাকিস্তানি ভাবাদর্শের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টার দিন। আর স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধের তিন বীর সেনানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল ৭ নভেম্বরের ঘটনাবহুল ও কলংকময় দিন। বিদ্রোহ ও অরাজকতার বলি হয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম, কে এন হুদা বীর উত্তম এবং এ টি এম হায়দার বীরবিক্রম। সে সময় সেনাবাহিনীর মধ্যে কোনো চেইন অফ কমান্ড ছিল না।

দীর্ঘদিন ঠান্ডা মাথার খুনি জিয়াউর রহমানের দল বিএনপি বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে বিপ্লব ও সংহতির নামে একটি মিথ্যা আজগুবি তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করেছে। কিন্তু আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ এখন বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস সঠিক তথ্য জানতে শুরু করেছে। বর্তমান প্রজন্মকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না। বিশ্বাসঘাতক দেশদ্রোহী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরশাসক আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ঠান্ডমাথার খুনি জিয়াউর রহমান বাংলা, বাঙালির আর বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী খলনায়ক হিসেবে স্থান পাবে। ৭ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যার এক কলংকময় দিবস হিসাবেই বর্তমান এবং আগামীর প্রজন্মের কাছে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।

- শিব্বীর আহমেদ

কথাসহিত্যিক সাংবাদিক ও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান।