এস এম নাজিম উদ্দিন প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০২:৩৩ পিএম
মহান আল্লাহ তাআলা এ পৃথিবীতে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত করে সৃষ্টি করেছেন আর এ মানবকূলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে প্রেরণ করেছেন মহানবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে। রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন মানবকুলের মধ্যে সকল পূর্ণতার অধিকারী। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামিন রূপে (জগৎসমূহের জন্য রহমত) প্রেরণ করেন এবং তার মাধ্যমে মানব জাতির জন্য স্বীয় পথনির্দেশ পরিপূর্ণ মাত্রায় পৌঁছে দেন। তাঁর মাধ্যমে মানবজাতি অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়ে জ্ঞানের আলোকোজ্জ্বল জগতে প্রবেশের সৌভাগ্য লাভ করে। তিনি ছিলেন সকল প্রকার মানবিক গুণাবলির সর্বোত্তম নিদর্শন। তাই মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি আশীষ বর্ষণ করেছেন।
রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মদ (সা.) রবিউল আউয়াল মাসে ধরাধামে আগমন করেন। রবিউল আউয়াল মানে হচ্ছে প্রথম বসন্ত বা বসন্তের প্রথম মাস। বস্তুত তার আগমনে আরব উপদ্বীপে আলোর বসন্তের সূচনা হয়েছিল যা পরে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
যাঁর শান বলে গুনগান করে শেষ করা যায় না। হযরত শেখ সাদী (রহ.) লিখেন,-
"যিনি সাধনায় পূর্ণতার শেষপ্রান্তে পৌঁছেছেন,
যাঁর সৌন্দর্য্যের আলোকে দূর হয়ে গেছে অন্ধকার
যাঁর আচার-ব্যবহার ছিল সৌন্দর্যের আকর
তাঁর ও তাঁর বংশধরগণের উপর বর্ষিত হোক সালাম।"
মহানবী (সা.)-এর আবির্ভাব হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন এই পৃথিবী পাপ-পঙ্কিলতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। এটা আল্লাহর অসীম মেহেরবানী যে পাপে- তাপে দগ্ধ এই পৃথিবীতে তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবীকে এমন একটি আলোকবর্তিকাসহ প্রেরণ করেন যার বদৌলতে বিশ্বের মানুষ পথের দিশা পেয়েছে এবং অনন্ত কাল ধরে পেতে থাকবে। আর তা হচ্ছে মহানবী (সা.)- এর উপর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণী পবিত্র আল-কোরআন।
মহানবী (সা.)-এর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে পাশ্চাত্য মনীষী জর্জ বার্নার্ড শ’ বলেন,-
"Sooner or later, a time will surely come, when the world be freed to admit that the only means to end all its trouble is to follow the perfect teaching and example of the holy prophet".
"শীঘ্রই হোক আর বিলম্বেই হোক, নিশ্চিতই এমন এক সময় আসবে যখন সমগ্র বিশ্ববাসী স্বীকার করতে বাধ্য হবে যে, তাদের সমস্যাসমূহ সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে মহানবীর পূর্ণ শিক্ষা ও দৃষ্টান্তগুলোর অনুকরণ করা।"
আজ পৃথিবীতে মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান যে, তারা সর্বশ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হতে পেরেছে এবং তাঁর উপর অবতীর্ণ আল্লাহর অবিকৃত বাণী পবিত্র কালামুল্লাহ তাদের হাতে রয়েছে। এরপরেও যদি মুসলমানরা হতভাগ্য থাকে এবং দুঃখ-দুর্দশার ও জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, তারা নবীর পথ থেকে দূরে সরে গেছে এবং আল্লাহর কালামকে ত্যাগ করেছে। আর এ কথারই প্রতিধ্বনি করে আল্লামা ইকবাল বলেছেন, "আমরা প্রকৃত মুসলমান হওয়ার কারণেই সে যুগে গৌরবান্বিত ছিলাম, আর বর্তমানে কোরআন পরিত্যাগ করার কারণেই লাঞ্ছনা ও অবমাননার শিকার হয়েছি।"
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, "(হে নবী!) তোমাকে আমি বিশ্বের রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।"
যে নবীর আগমন হচ্ছে মানবজাতির কল্যাণ ও রহমতের মূর্ত প্রতীক হিসাবে গণ্য; তাঁর জন্মের দিন ও মাসের গুরুত্বও অপরিসীম এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাই সারা বিশ্বে প্রতি বছরই মহানবী (সা.) এর জন্ম দিবসকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে পালন করা হয় থাকে। কিন্তু শুধু জন্মদিন পালন করায় যথেষ্ট নয়, আজ সারা বিশ্বের মুসলমানদের দিকে তাকালে আমরা শুধু হতাশা দেখতে পাই। কারণ মহা নবীর (সা.) উম্মত বলে দাবিদার মুসলমানরা যেভাবে সর্বত্র নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছে তা তো আল্লাহর নবী কামনা করেন নি! ইসলাম এমন একটি ধর্ম, এমন একটি মতাদর্শ ও জীবন ব্যবস্থা যা না কারো প্রতি অসম্মান করে, আর না নিজে অসম্মান বরদাস্ত করে। অথচ মুসলমানদের প্রতি তাকালে এর বিপরীত ছবিই ভেসে উঠবে। তাই আজ আমাদেরকে এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে।
মহান আল্লাহ মুসলমানদেরকে ‘খায়রা উম্মাতিন’ বা উত্তম জাতি বলে অভিহিত করেছেন। তাহলে এই কি সে উত্তম জাতির নমুনা? বিশ্বমানবের কল্যাণের জন্যই মুসলমানদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। তারা মানুষকে সৎ কাজে আদেশ দান করবে এবং অসৎ কাজে নিষেধ করবে। কিন্তু আংশিকভাবে এর বাস্তবতা মুসলমানদের মধ্যে পাওয়া গেলেও সার্বিক তা আমরা দেখতে পাই না।
আজ মিলাদুন্নবী মাসের এই অফুরন্ত বরকতকে সামনে রেখে তাই আমাদের প্রত্যাশা, মুসলমানরা আবারও ইসলামের প্রাথমিক যামানার মতো জেগে উঠুক এবং আল্লাহর নবী ও তাঁর আদর্শ ও সত্যাশ্রয়ী সাহাবীগণের জীবনাদর্শে নিজেদেরকে গড়ে তুলে কোরআনের ভাষায় ‘উত্তম জাতি’র মর্যাদায় অভিষিক্ত হোক।
ইসলামে ঐক্যের ধারণা অত্যন্ত ব্যাপক। ইসলামের মূল ভিত্তি তাওহীদ বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এ পৃথিবীতে আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত যত নবী- রাসূল আগমন করেছেন তাঁরা সবাই ছিলেন তাওহিদী জীবন বিধানের প্রচারক ও প্রতিষ্ঠাতা।
যারা তাওহীদ, আখেরাত ও রিসালাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, ঈমান এনেছে তাদের ব্যাপারে আল্লাহর স্পষ্ট বক্তব্য,-
"এবং তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো; তোমরা ছিলে পরস্পর শত্রু এবং তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেছেন। ফলে তারই অনুগ্রহে তোমরা পরস্পর ভাই হয়ে গেলে।" (আলে ইমরান:১০৩).
সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে সকল মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন। সাথে সাথে ঐক্যের ভিত্তি কী হবে তাও এ আয়াত সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ইসলামী ঐক্যের অগ্রপথিক ইমাম খোমেনীর (রহ.) এ প্রসঙ্গে বলেন,
"শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে কোন বিরোধ থাকলে তার সকল মুসলমানের জন্যই ক্ষতিকর। যারা শিয়া ও সুন্নির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে চায় তারা শিয়াও নয়, সুন্নিও নয়। তারা ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত এবং ইসলামী দেশসমূহের উপর দুশমনদের শাসন চাপিয়ে দেয়ার পক্ষে কাজ করছে।"
মহানবী (সা.) বলেছেন,-"আমি মুহাম্মদ, আমি আহমদ ও আমিই সমবেতকারী"।
মুহাম্মদ (সা.)-এর দায়িত্বই ছিল তাওহীদ -বিশ্বাসী মানুষকে একটি জাতিতে সঙ্ঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করা; বস্তুত হয়েছিল তাই।
এছাড়াও মহানবী (সা.) গোটা মুসলিম উম্মাহকে একটি দেহের সাথে তুলনা করেছেন, যার একাংশে কোন ব্যথা অনুভূত হলে তা অন্য অংশে ও সংক্রমিত হয়ে পড়ে। আল্লাহর বাণী ও মহানবীর (সা.) এর এই পথনির্দেশনা পৃথিবীর সকল প্রকার বংশ - গোত্র- জাতিভিত্তিক হিংসা-দ্বেষ ও আত্মম্ভরিতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে এবং শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হিসেবে দাঁড় করিয়েছে তাকওয়া ও খোদাভীতিকে। কাজেই আজ মুসলিম উম্মাহর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হলে তাকওয়া ও ইসলামী নীতিমালাকে সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে।
ঐক্য হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি রহমত। আজ মুসলিম জাহান ঐক্য থেকে বঞ্চিত বলেই পৃথিবীর সর্ব প্রান্তে মুসলমানরা খোদাদ্রোহী সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে মার খাচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে। জাহিলিয়াতের নীতির উপর অবস্থান করে, খোদাদ্রোহী জালেম শক্তিগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ করে মুসলমানরা কখনো তাদের মধ্যে ঐক্য রচনা করতে সক্ষম হবে না। কেন না মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে ফায়দা লোটাই হচ্ছে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। যেসব পরাশক্তি এসব কাজে ইন্ধন যুগিয়েছে, বিশেষ কোন পক্ষকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছে, তাদের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম জনশক্তি ও সম্পদের ধ্বংসসাধন। আর হয়েছেও তাই। মুসলমানদের অনৈক্যের কারণেই অদ্যাবধি ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের মজলুম মুসলিম জাতি গুলোর সমস্যার সমাধানও হচ্ছে না। তাই মহানবী ( সা.)এর পবিত্র জন্ম দিবস উপলক্ষে মুসলিম বিশ্বকে এর তাৎপর্য ও গুরুত্ব উপলব্ধি করতে হবে।
ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হযরত ইমাম খোমেনী (রহঃ) সর্বাগ্রে এই ঐক্যের জন্য আহ্বান জানান। তারই নির্দেশে মহানবী (সা.) এর জন্মের মাস রবিউল আউয়াল কে সামনে রেখে ১২ রবিউল আউয়াল থেকে ১৭ রবিউল আউয়াল পর্যন্ত সময়কে ‘ইসলামী ঐক্য সপ্তাহ’ ঘোষণা করা হয়, যা অতি গুরুত্বের সাথে প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে। এই ঐক্যের উপর গুরুত্বারোপ করে ইমাম খোমেনী (রহ.) বলেন,
"ইসলাম আসার উদ্দেশ্য হচ্ছে জাতিসমূহ তা আরব, তুর্কি, ইরানি, যা-ই হোক না কেন, সবাইকে নিয়ে এক মহান সম্প্রদায় গড়ে তোলা; যার নাম মুসলিম উম্মাহ। এর ফলে যে সংখ্যা ও শক্তি সৃষ্টি হবে তার কারণে ইসলামী সরকার ও কেন্দ্র সমূহের উপর কেউ আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে না। কাজেই এর তাৎপর্য মুসলিম জাহানকে পুনরায় উপলব্ধি করেই তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। আমরা আসন্ন মিলাদুন্নবী ও উক্ত ইসলামী ঐক্য সপ্তাহকে সামনে রেখে মুসলিম জাতি গুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানাচ্ছি এবং জালিমের উপর মজলুমের বিজয় কামনা করছি।”
লেখক: এস এম নাজিম উদ্দিন, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত।