NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, শনিবার, মে ১০, ২০২৫ | ২৭ বৈশাখ ১৪৩২
Logo
logo

নারীর ক্ষমতায়নে রবীন্দ্রনাথ: আধুনিকতার অগ্রদূত


আকবর হায়দার কিরণ   প্রকাশিত:  ১০ মে, ২০২৫, ০৫:২৫ এএম

নারীর ক্ষমতায়নে রবীন্দ্রনাথ: আধুনিকতার অগ্রদূত

নন্দিনী লুইজা

 "নারীকে তার স্বত্বা দিতে হবে। মানুষের মর্যাদা দিতে হবে।" — এই কথাটি আজকের নারীবাদী আন্দোলনের দাবি মনে হলেও, এই চেতনাই শতবর্ষ আগেই উচ্চারণ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে ছিলেন অগ্রগামী ও মানবতাবাদী চিন্তক। তিনি সাহিত্য, দর্শন এবং সামাজিক ভাবনায় নারীর স্বাধীনতা, মর্যাদা ও আত্মপ্রকাশের পক্ষে সুস্পষ্ট অবস্থান। তিনি কেবল কবি ছিলেন না, ছিলেন এক সমাজদ্রষ্টা। তাঁর লেখনীতে আমরা খুঁজে পাই নারী স্বাধীনতার সূক্ষ্ম অথচ সাহসী রূপরেখা।   নারীর স্বাতন্ত্র্য ও আত্মমর্যাদা ব্যক্তি। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, নারীকে কেবল গৃহিণী বা ভোগ্য বস্তু হিসেবে দেখার সংস্কৃতি ভেঙে দিতে হবে। তিনি নারীকে মানবিক মর্যাদা ও ব্যক্তিসত্তার অধিকারী হিসেবে তুলে ধরেছেন। ‘চণ্ডালিকা’ নাটকে প্রভাবতী চরিত্রের মাধ্যমে তিনি নারীর আত্মজাগরণ ও আত্মসম্মানকে গুরুত্ব দিয়েছেন।  নারীর শিক্ষার অধিকার ন্যায় সঙ্গত, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন- নারীশিক্ষা ছাড়া জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই শান্তিনিকেতনে নারীশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি ও নারী শিক্ষার্থী ও শিক্ষিকাদের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করেছেন।

 নারী শিক্ষক নিয়োগ করেছেন, এমনকি নারী ছাত্রদের জন্য আবাসিক ব্যবস্থাও গড়ে তুলেছেন।"জ্ঞানলাভে পুরুষ-নারীর ভেদ নেই। বিদ্যার পথ সকলের জন্য উন্মুক্ত হওয়া উচিত" — এই নীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন। যা তিনি তা বাস্তবে প্রয়োগ করেছেন, তা আজও চলমান।   বাঁধাধরা লিঙ্গভিত্তিক ভূমিকার প্রতিবাদ তিনি অনেক সাহিত্যকর্মে দেখিয়েছেন। নারী কেবল সংসার বা সন্তান পালনের যন্ত্র নয়, বরং একজন সৃষ্টিশীল ও চিন্তাশীল মানুষ। ‘নষ্টনীড়’ গল্পের চারুলতা বা ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের কুমু চরিত্রে এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।   সমাজে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মান ও সহযোগিতা বজায় থাকবে। তিনি বলেন নারী-পুরুষের সম্পর্ককে আধিপত্যের নয়, সহাবস্থানের ভিত্তিতে দেখতে হবে। তাঁর মতে, নারীকে অবজ্ঞা করে পুরুষ নিজেও পূর্ণতা পায় না। এই দৃষ্টিভঙ্গি ‘স্ত্রীর পত্র’ ও ‘শেষের কবিতা’র মতো রচনায় বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

  সামাজিক সংস্কার ও মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখার ক্ষেত্রে নারীও পুরুষ উভয় কে  সহনশীল হতে হবে। নারীর উপর সমাজের চাপিয়ে দেয়া কুসংস্কার ও বিধিনিষেধের বিরোধিতা  কবি করেছেন। বিধবা পুনর্বিবাহ, বাল্যবিবাহ রোধ ইত্যাদি বিষয়ে তিনি সরাসরি অবস্থান নিয়েছিলেন।  রবীন্দ্রনাথ নারীর অধিকারকে দেখেছেন মানবাধিকারের অংশ হিসেবে। তাঁর মতে, নারী যদি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে না পারে, তবে সমাজের বিকাশও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তাই তিনি বারবার বলেছেন, "স্ত্রীলোকের প্রধানত একটি কাজ আছে, তা হল মানুষের পরিচয় লাভ করা।" (চিঠিপত্র)   তিনি ধর্মীয় বা সামাজিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিধবা বিবাহের পক্ষে সওয়াল করেছেন, নারীকে ধর্মীয় ও সামাজিক শৃঙ্খলমুক্ত জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।

তাঁর গানেও উচ্চারিত হয়েছে নারীর মর্যাদা:"নারী হে, তব গতি মুক্তির মহাস্রোতে..."  তাঁর সাহিত্যকর্মে নারীচরিত্রের যে গঠন, তা ঔপন্যাসিক সাহসে ভরপুর। 'নষ্টনীড়'-এর চারুলতা, 'যোগাযোগ'-এর কুমু, 'চোখের বালি'-র বিনোদিনী কিংবা 'চণ্ডালিকা'-র প্রভাবতী— এরা কেউই নিছক করুণা বা প্রেমের পাত্রী নয়, বরং আত্মপরিচয় সন্ধানী, সিদ্ধান্তপ্রবণ, সংগ্রামী একেকজন মানুষ।   রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, নারীর স্বাধীনতা মানে পুরুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়, বরং একে অপরের পরিপূরক হয়ে এগিয়ে চলা।

"নারীকে যদি মানুষরূপে না দেখি, তবে সে কেবল শোভাবস্তু হয়ে থাকে; আর মানুষরূপে দেখলে সে হয় সহযাত্রী।" (প্রবন্ধ: ‘নারী’)  সার্বিকভাবে রবীন্দ্রনাথ নারীর ক্ষমতায়নকে শুধু একটি সামাজিক বা রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবেে দেখেননি, বরং একটি নৈতিক ও মানবিক প্রয়োজন হিসেবে দেখেছেন।   এইসব ভাবনার মাঝে রবীন্দ্রনাথ যেন আজও আমাদের সমাজে প্রাসঙ্গিক। নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে রাষ্ট্রনীতি যতই লেখা হোক না কেন, এই চেতনাগত স্বাধীনতা— নারীর মন ও চেতনায় আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেই দিশা দেখান— যেখানে নারী আর অবলা নয়, পূর্ণাঙ্গ মানুষ। তাইতো সাহস দিতে গিয়ে বলেছেন -"যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে"।

  নন্দিনী লুইজা লেখক ও প্রকাশক বর্ণপ্রকাশ লিমিটেড