দিনাজপুরে ব্যতিক্রম পেশায় লক্ষাধিক নারী
Abdur Razzak
প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০২:৩০ পিএম

এম আব্দুর রাজ্জাক উত্তরবঙ্গ থেকে :
দিনাজপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীরা সংসারের অভাব মোচনে, ভিন্নতর এক পেশা বেঁছে নিয়েছেন। গ্রাম-গঞ্জ থেকে সংগ্রহ করে আনা চুলের জট ছাড়িয়ে এবং হেয়ার ক্যাপ তৈরি করে মাসে রোজগার করছেন ৬ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। এতে সংসার থেকে অভাব দুর করতে পেরেছেন দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ,ঘোড়াঘাট,বিরামপুর,চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলার ৮০টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক নারী। মুলতঃ নারীরাই এ ব্যতিক্রম পেশার উদ্যোগতা।
নারীরা মাথা আঁচড়ানোর পর ফেলে দেন তাদের জট বাধা চুল। আর সেই জট বাধা চুল সংগ্রহ করে এনে জট ছড়ানো এবং হেয়ার ক্যাপ তৈরি এদের কাজ। অন্যান্য পেশার মতোই ৮ ঘণ্টার পরিশ্রমে নিজেদের সংসারের কাজের ফাঁকেই নারীরা এ ব্যতিক্রম কাজ করে খুঁজে পেয়েছেন স্বাবলম্বী হওয়ার পথ।
জট বাধা চুলের জট ছাড়িয়ে তা দিয়ে তৈরি করছেন হেয়ার ক্যাপসহ চুলেরই নানা পণ্য। পরিশ্রমের সাথে মজুরীর সংহতি থাকায় স্থানীয় নারীরা সংসারের পলাতক মূহুর্তগুলোকে কাজে লাগাচ্ছেন। বাড়তি উপার্জন করে সংসার থেকে দূর করছেন অভাব।
এমনটাই জানালেন, এ ব্যতিক্রম পেশায় নিয়োজিত নবাবগঞ্জ উপজেলার মরিয়ন বেগম। তিনি জানালেন,তার স্বামী তাতে ফেলে অন্যত্র চলে যাওয়ার এক সন্তান নিয়ে তিনি মহা বিপদে পড়েন। কিছু দিন পর বাবা-মা আর ভাই-বোনেরাও জেনো ভারি বোঝা মনে করা শুরু করে। বর্তমানে এ পেশায় জড়িয়ে তিনি প্রতিমাসে আয় করেন, আঠারো হাজার টাকা। সে টাকা দিয়ে সন্তানের পড়া-লেখার পাশাপাশি দিব্যি সংসার চলছে,তার। কিছু জমিও কিনেছেন তিনি। আগামীতে তিনি বাড়ি তৈরির স্বপ্নও দেখছেন।এমনি ভাবে অসংখ্য নারী আজ স্বাবলম্বী।
সংসারে অভাব-অনটনে অনেকে ছেড়ে দিয়েছিলেন পড়া-লেখা। এসব কিশোরী-যুবতি এখন এ ভিন্নতর পেশায় খুঁজে পেয়েছেন নিজের আত্ম-কর্মসংস্থান। উপার্জিত অর্থ দিয়ে যোগাচ্ছেন, নিজের পড়া-লেখার খরচ। হেয়ার ফ্যাশন নামে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ নবাবগঞ্জ,ঘোড়াঘাট,বিরামপুর,চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলার কয়েকটি গ্রামে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তারা চালিয়ে আসছে,এ ব্যতিক্রম প্রকল্প।এতে হয়েছে,অনেকের কর্মসংস্থান।
প্রত্যন্ত পল্লীর নারীরা সংসারের অভাব মোচনে,ভিন্নতর এক পেশা বেঁছে নিয়েছেন। গ্রাম-গঞ্জ থেকে সংগ্রহ করে আনা চুলের জট ছাড়িয়ে এবং হেয়ার ক্যাপ তৈরি করে মাসে রোজগার করছেন ৬ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। এতে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসছে,তাদের।এলাকার দরিদ্র নারীর পাশাপাশি স্কুল ও কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা।শিক্ষার্থীরা নিজের লেখাপড়াসহ সংসারের খরচে ভূমিকা রাখছেন।
শিক্ষার্থী বিলকিস আরা জানান, করোনার মধ্যে দীর্ঘদিন কলেজ বন্ধ ছিল। তখন সময় বেশি পেতাম এবং কাজও বেশি হতো। একটি ক্যাপ তৈরি করতে একদিনের মতো সময় লাগতো। এখন কলেজ চালু হওয়ায় কাজ কম করতে পারছি। তারপরও গত আগস্ট মাসে ৪৫০০ টাকা আয় করেছি। বাবার কাছে টাকার জন্য হাত পাততে হয়না। এ কাজ করে নিজের খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারে টাকা দিয়ে সহযোগিতা করা হয়।
হেয়ার স্টাইল এর স্ত¡াধিকারি মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার অধীনে ২৫ জন ক্যাপ তৈরির কাজ করে। এরমধ্যে সাতজনই ছাত্রী। তারা পড়াশুনার পাশাপাশি এ কাজ করে। আর গৃহবধূরা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি এ কাজ করে বাড়তি আয় করে। সকাল থেকে চলে দুপুর পর্যন্ত। মাঝখানে একটা বিরতি। এরপর আড়াইটা থেকে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। নিজের কাজের পাশাপাশি সবার কাজ দেখভাল করি। কারো কোন সমস্যা হলে শিখিয়ে দিয়। এ কাজ করে প্রায় ১২ হাজার টাকার মতো আয় করে থাকি। এছাড়া দলের অধিনায়ক হিসেবে তদারকি করায় বাড়তি আরও কিছু টাকা দেয় মহাজন। যে টাকা উপার্জন করি, এতে সংসার এখন ভালোভাবেই চলে। কিছু টাকা জমিয়েছি। জমি কিনে একটা ভালো বাড়ি বানানোর স্বপ্ন আছে।
‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’, ‘একটা ছিল সোনার কন্যা/মেঘ বরণ কেশ’। চুল নিয়ে এমন হাজারো গান-কবিতা রয়েছে। বিশেষত নারী সৌন্দর্যের বর্ণনায় বারবার সামনে আসে লম্বা ঘন কালো চুল। সৃষ্টির আদিকাল থেকে নারীর পাশাপাশি পুরুষের সৌন্দর্যের বিশেষ অংশজুড়ে রয়েছে এই চুল।এখন শুধু নারীর সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, ফ্যাশন সচেতন ছেলেদের কাছেও চুল সাজগোজের অংশ। সেজন্য এককালে মেয়েরাই কেবল চুলের যত্ন-আত্তি করলেও এখন ছেলেরাও নজর দিচ্ছে চুলে। চুল ঝরে পড়লে নারী-পুরুষ উভয়েরই সৌন্দর্যের ছন্দপতন ঘটে। হারানো সৌন্দর্যের প্রতীক ফেরাতে
টাক মাথায় ব্যবহার করা হয় পরচুলা। আর এই পরচুলাই দিনে দিনে জায়গা বাড়িয়ে নিচ্ছে বাজারে। চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পরচুলা তৈরির জন্য এখাতে শিল্পও গড়ে উঠেছে। সম্ভাবনাময় এই ক্ষুদ্র শিল্পের প্রসার ঘটেছে দিনাজপুর জেলা-জুড়ে। আর তাই,এই চুল নিয়ে ব্যতিক্রম পেশায় নিয়োজিত হয়ে পড়েছে,উত্তরের জেলা দিনাজপুরের লক্ষাধিক নারী।
হেয়ার ক্যাপের কারখানা ঘুরে দেখা গেছে,ক্যাপ তৈরিতে লাগে মাথার ড্যামি, চুল, নেট, সুচ, সুতা, চক ও পিন।
চিরিরবন্দরের ডাঙ্গার হাট এলাকায় একটি কারখানায় সরজমিনে দেখা গেলো পরচুলা বা চুল দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতের কাজ করছেন অসংখ্য নারী। এ কারখানায় বিভিন্ন বয়সী মরিয়ম,জুলেখা, আশা, সোনালী, মাজেদা,তনু খাতুন, শাহানারা খাতুন, মিনা আকতার, শিখা রাণী,নায়মা,ম্যেসুমি সহ ৮০ জন নারী কয়েক মাস থেকে কাজ করছেন। তারা সবাই দরিদ্র ও স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী। প্রতিটি টেবিলে স্ক্রুর সাহায্যে আটকানো আছে প্লাস্টিকের ড্যামি মাথা। আর ড্যামি মাথা ওপর একটি নেট বা জাল।আর এ জালের ফাঁকে ফাঁকে সুচের ফোঁড়ে ফোঁড়ে খুব মনোযোগ দিয়ে একটি একটি করে চুল আটকানো হচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে একই দৃষ্টিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। ড্যামি পুরো মাথায় সূক্ষ্ম ভাবে চুল আটকানো সম্ভব হলেই ক্যাপ তৈরির কাজ শেষ। মনোযোগ আর দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক ভাবনা থেকে এক সময় তৈরি হচ্ছে মনোরম টুপি। তাদের হাতের কারিশমায় তৈরি হচ্ছে এ পরচুলা ক্যাপ। আর মাথার ওপর ঝুলছে এনার্জি লাইট। প্রতিটি টেবিলে দুইজন করে দুইপাশে চারজন কারিগর কাজ করছেন মনোযোগ দিয়ে। মনোযোগ দিয়ে কাজ না করলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা।
দিনাজপুর- আসনের সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক জানালেন, এ পেশায় জড়িয়ে এলাকার ২৫ টি গ্রামের প্রায় ২০ হাজার পরিবারে ৫০ হাজার নারী পেয়েছে,অভাব-দরিদ্রতা থেকে মুক্তি।তাদের তৈরি হেয়ার ক্যাপসহ চুলের বিভিন্ন পণ্য চলে যাচ্ছে,ভারত,চীন, জাপান,থাইল্যান্ড,সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার,আমেরিকা সহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রে।
তিনি বলেন,এ উদ্যোগের প্রসার বাড়ছে। অনেকে গ্রহণ করছেন, এমন উদ্যোগ। যাতে অবহেলিত নারীরা সম্পৃক্ত হতে পারে এ কর্মসংস্থানে। স্বাবলম্বী হচ্ছে, অনেক নারী। দূর হচ্ছে, সংসারের অভাব-অনটন।
উচ্ছিষ্ট চুলগুলো মূল্যবান পণ্যে রূপান্তর করছেন,অবহেলিত নারী নিপুণ কারিগরেরা। আর এ পণ্যটির দেশ-বিদেশে চাহিদা বাড়ায় এতে আত্ম-কর্মসংস্থানের পাশাপাশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেকেই।