NYC Sightseeing Pass
ঢাকা, রবিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৫ | ১৪ বৈশাখ ১৪৩২
ব্রেকিং নিউজ
জব্বারের বলীখেলায় আবারও চ্যাম্পিয়ন কুমিল্লার ‘বাঘা’ শরীফ Bangladesh reaffirms commitment to fully Implement the CHT Peace Accord Kashmir Violence Conflict can be Solved Diplomatically or Needs a Retaliation Plan Against Pakistan ব্রেন স্ট্রোক পরবর্তী সময়ে সেরে ওঠার যুগান্তকারী ওষুধ আবিষ্কার নিউইয়র্কে প্রবাসীদের সাথে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের মত  বিনিময় নিজেকে রাজা-বাদশাহ ভাবছেন ট্রাম্প! ‘দাগি’ দেখতে কয়েদির বেশে সিনেমা হলে শতাধিক নিশো ভক্ত Attorney General James Wins Case Against Google for Monopolies in Digital Advertising নিউইয়র্কে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংবাদ সম্মেলন নানা অভিযোগ উত্থাপন : বাংলাদেশ রেমিট্যান্স মেলা  বয়কটের আহবান নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় পুলিশের গুলিতে মানসিকভাবে অসুস্থ  এক ব্যক্তির মৃত্যু
Logo
logo

স্বাধীনতায় আত্ম বলিদান - নন্দিনী লুইজা


খবর   প্রকাশিত:  ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০৬:৪৩ এএম

স্বাধীনতায় আত্ম বলিদান -   নন্দিনী লুইজা

 

স্বাধীনতায় আত্ম বলিদান

 




 

নন্দিনী লুইজা

 

পুব আকাশে রক্তিম আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে সূর্য উদিত হচ্ছে। আকাশে লাল নীলের আভা এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতরণ হয়েছে। পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত। কে জানে আর কিছুক্ষণ পরে এই দেশের মাটিতে শুরু হবে অশান্ত পরিবেশ। স্বাধীনতার মাস ২৬ শে মার্চ, পঁচিশে মার্চ থেকে শুরু হয়েছে চারিদিকে গোলাগুলি, অশান্ত পরিবেশ এই পরিবেশে জীবনের সব কর্মকান্ড নিয়ম ভঙ্গ করে অনিয়মের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারপরও মানুষের বাঁচার আকুতি। এই দূর্যোগের মাঝেই স্বর্ণা আর আক্তার তাদের বিবাহিত জীবন শুরু করে। অনিশ্চিত জীবনের ভাবনা থেকেও তারা ভাবে দেশে স্বাধীনতা অর্জন হলে নিজেরাও প্রশান্তিতে স্বাধীন দেশে বাস করবে। 

 

নারী-পুরুষের সহবাসে কখন যে একটি ভ্রুনের জন্ম হয় এটা বোঝা মুশকিল। তবে অপ্রত্যাশিত ভাবে জন্ম নেওয়া ভ্রুণ আমাদের মত অনুন্নত দেশে অকালে মৃত্যু হয়। যা অনেক দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশে একটি ভ্রুনের প্রতীক্ষায় বছরে পর বছর অপেক্ষা করে, তাদেরকে পুরস্কৃত করে। মৃত্যু ভ্রুণের আর্তনাদ নিয়ে কথোপকথন আর কত বিচার সালিশ চলবে বাংলার মাটিতে। 

 

স্বর্ণা আর আক্তারের মধ্যে অনেক দিনের প্রেম। তারা একে অপরকে ভালোবাসেই শুধু নয়, তাদের মধ্যে বিশ্বাস এতটাই শিকড় গেড়ে বসেছে যে একটা সময় তাদের ভালোবাসার পরিণয় ঘটে। 

 

বিশ্ববিদ্যালয় যখন শেষ বর্ষে দুজনে তাদের মাঝে বিশ্বাস যেন উদ্বেগের কারণ না হয়, আজকের দিনের মত তখন মোবাইল ছিল না। চিঠিই ছিল এক মাত্র ভরসা। আজকের লেখা  চিঠি সাতদিন পরে পৌঁছাবে, এই সাত দিনে অনেক ঘটনাই ঘটে যেতে পারে। তাই তারা দুজন  সিদ্ধান্ত নিল  জীবন একটাই, এত চাপ নেওয়া যাবে না। ফলে তারা পরিবারকে না জানিয়ে নিজেরাই নিয়মের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তবে দুই পরিবারই জানতো স্বর্ণা ও আক্তারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। কিন্তু বর্তমানে এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের বিষয়ে দুই পরিবারের কেউই জানতো না। যে তারা নিজেরাই এ কাজটি করে ফেলেছে। স্বর্ণ ও আক্তার, পরিবারের ব্যাপারে কোন অমত ছিল না কিন্তু সব সময় তো সব পরিবেশ অনুকূলে থাকে না তাই দুই পরিবারকে না জানিয়ে এমন একটি স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের বছরে। 

 

নিশ্চিত জীবনে দুজন চলছে টোনাটুনির মত, বেশ আনন্দে কাটছে দিন। বিবাহের কথাটা জানে না পরিবার,তাই দুজন একত্র হতে চাইলে তাদের সুবিধা মতো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আক্তার, স্বর্ণার বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা করার জন্য চলে যায়। যে দুজনে স্বল্প আয়ের নিজেদের সামর্থের মধ্যে থেকে হোটেলে উঠে। দুজনের কাছে খুব সামান্য টাকা তারপরেও তাদের আনন্দ আর তৃপ্তির প্রাচুর্য এমন এক পর্যায়ে, সেখানে হয়তো অনেক অর্থবিত্ত ব্যক্তিরা হার মানে। কখনো রুটি খেয়ে, কখনো বা বিস্কুট পাউরুটি খেয়ে তারা ঠিকই আট দশজন বাবুদের মতো ফিট ফাট জীবন চালিয়েছে। হোটেলে বেয়ারাদের কেও খুশি করেছে । কখনই তারা খাবারের জন্য বাহিরে যেত না যেহেতু অর্থ কম তাই রুমে খাবার কিনে এনে দুইজন মানুষ এক হয়ে কি সুখেই না দিন কাটিয়েছে। কখন যে অন্য অস্তিত্ব বহন করেছে তা বুঝতে পারিনি। একদিন হঠাৎ করে স্বর্ণার মাথা ঘোরে, বমি বমি ভাব হয়। আশপাশে মেডিকেলের দোকানে গিয়ে ঔষধ কিনে খায় কিন্তু মাথা ঘোরা, বমি ভাব বন্ধ হয় না।পরবর্তীতে প্রেগনেন্সি টেস্ট করতে গিয়ে ধরা পড়ে স্বর্ণা গর্ভবতী। সেই খবর শুনে আক্তার স্বর্ণকে সেদিন বিকেলে স্পেশালভাবে দই খাইয়ে ছিল। সেই সময়ে ১০ টাকার অনেক দাম ছিল। আজও পর্যন্ত স্বর্ণা সেদিনের কথা ভুলতে পারেনা। এর কিছুদিন পর তারা সিদ্ধান্ত নিল ঢাকায় ছোটখাটো চাকরি করবে তাই দুজনে মিলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সেখানে তারা স্বল্প দামের হোটেলে ওঠে। প্রচন্ড গরম আমের সময় বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে আমের আচার, আমের চাটনি বিক্রি হচ্ছে। কাঁচা আম মাখা বিক্রি হচ্ছে এগুলো দেখে স্বর্ণার খুব লোভ লাগে। শুনেছে গর্ভবতী অবস্থায় কোন কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, তবে টক জাতীয় খাবারের প্রতি একটু লোভ হয়। স্বর্ণের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। তাই ঢাকায় যেখানেই ঘুরাঘুরি করুক না কেন স্বর্ণা বেশ মজা করে কাঁচা আমের চাটনি, বিভিন্ন মাখা, জলপাই তেঁতুলের আচার মাখা খেয়েছে। সেই সুন্দর স্বর্ণালী দিনগুলি আজও কেন জানি মনে দোলা দেয়। ছিল না অর্থের প্রাচুর্য, অনেক হিসেব করে ২ টাকা বাঁচিয়ে চলতে হয়েছে কিন্তু ভালোবাসা ছিল অফুরান। একে অপরকে কোনোক্রমেই এতটুকু কষ্ট ছুঁয়ে যায়নি যা কিনা এখন স্বল্পতেই দুঃখ কষ্ট বেদনা কে জয় করতে বেশ বেগ পেতে হয়। দিন চলে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে স্বর্ণার গর্ভের সন্তানটি বড় হচ্ছে এক মাস থেকে দু মাস কিন্তু স্বর্ণার মুখে চিন্তার ছাপ। যদিও স্বর্ণার গর্ভের সন্তান আসার খবর যতটা আনন্দ দিয়েছিল, দেশের স্বাধীনতার লড়াই,সন্তানের ভবিষ্যৎ চিন্তায় দুজনে বেশ ক্লান্ত। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কি করবে। যেখানে তাদের ভবিষ্যৎ সামনে কি আছে কিছুই জানে না। তাই তারা অনাগত শিশুর নিরাপদ আশ্রয় দিতে পারবে কিনা এই ভাবনা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। স্বর্ণা এবং আক্তারের পরিবার মধ্যবিত্ত গোচের। তবে স্বর্ণার আত্মসম্মান এত বেশি, সে চায় না তার নিজের কাঁধের বোঝা অন্যের কাছে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা আরাম করবে। অর্থাৎ সে সন্তান জন্ম দিবে সে সন্তান মা বাবার কাছে দিয়ে মানুষ করবে এমন মানসিকতা স্বর্ণার নয়। মা কষ্ট করে ছেলে মেয়ে মানুষ করলো তারপর নাতি নাতনি মানুষ করা এটা অমানবিক মনে হয়। নিজস্ব ভাবনা-চিন্তা এবং বেঁচে থাকার আর একটা ঢং আছে সেখানে নিজের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়া সত্যিই ঠিক না।

 

তাই কঠিন সিদ্ধান্তটা স্বর্ণাকেই নিতে হলো। গর্ভপাত করবে এই গর্ভপাত করতেও টাকা পয়সা প্রয়োজন। তার আগে স্বর্ণা মানুষের বিভিন্ন টোটকা শুনে সেই মোতাবেক গর্ভপাত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু সফল হয়নি। অস্ত্রোপচারে যেতেই হচ্ছে এ বিষয়ে আক্তার দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়ল। স্বর্ণা আক্তারকে সাহস দিচ্ছিল এটা এমন কোন বিষয় না। আর এ ব্যাপারে যদি কখনো ভবিষ্যতে সমস্যা দেখা দেয়! স্বর্ণা কোন কিছুই মাথায় নেবে না, কেউ কাউকে দোষারোপ করবো না।

 

চারিদিকে শুরু হয়ে গেছে গোলাবারুদের অগ্নি ফুলকি, মানুষের ছোটাছুটি, আহাজারি, বন্ধুক, কামানের শব্দ এমন একটা অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা স্বর্ণার কাছে মনে হয়েছে যুক্তিযুক্ত। যদিও এখন বর্তমানে স্বর্ণা ভাবে ওই সময়ে আত্মবিশ্বাসটা কমে গেল কেন? কেন অমন পরিস্থিতিতে নিজেকে স্থির রেখে কঠিন সিদ্ধান্ত না নিয়ে চড়াই উৎড়াই করে জীবনটা পার করা যেত!! যদিও এখন ভাবনাটা অনেক সহজ। ১৯৭১ সালে তা মোটেও সহজ ছিল না, এটাও সত্য। 

 

একটা নির্দিষ্ট দিনে সিদ্ধান্ত হলো-  স্বর্ণা গর্ভপাত করবে। কিছু টাকা পয়সা হাতে নিয়ে স্বর্ণা  আর আক্তার চলে গেল তার বন্ধুর বাসায়। যে বন্ধু অনেক আগেই বিয়ে-শাদী করে তাদের ঘরে সন্তান আছে। এই বন্ধুটা আক্তারের অনেক ছোটবেলার বন্ধু। ওই সময় বন্ধুর বউ ভাবি অনেক সহযোগিতা করেছিল। তার কাছে স্বর্ণা কৃতজ্ঞ। সে একজন দেইমা বলি আর নার্স বলি দক্ষ ব্যক্তিকে স্বল্প টাকায় ডেকে নিয়ে আসে। কিন্তু নার্স এত অল্প টাকায় কাজ টা করতে রাজি হয় না, কারণ সময় অনেক গড়ে গেছে। সেই পরিমাণ টাকা না থাকায় স্বর্ণা তার সোনার কানের দুল জোড়া বিক্রি করার জন্য আক্তারের হাতে দিয়ে বলে এই দুর্যোগের মধ্যে যে টাকায় পারো বিক্রি করে নিয়ে এসো। যদিও আক্তার মন খারাপ করছিল তারপরেও করার কিছু ছিল না। এই দুর্দিনে কারো কাছে টাকা ধার চাওয়া অমানবিক। নার্স স্বর্ণাকে দক্ষতার সঙ্গে গর্ভপাত করায়।

 

যখন নল ঢুকিয়ে দিয়ে নরম লাল পিন্ডে আঘাত করছিল ভেতর থেকে একটি প্রার্থনার চিৎকার আসছিল -"মা আমাকে মেরো না আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। তুমি কেন বোঝনা আমি তোমার কষ্ট বুঝতে পারি। পৃথিবীতে আমাকে তুমি আসতে দিলে না তুমি মা না তুমি খুনি"। আজ স্বর্ণা নিজেকে খুনি হিসেবেই মাঝে মাঝে অতল গহব্বরে হারিয়ে যায়।

 

বিবেকের আদালতে বিচার হয় ফাঁসির মঞ্চের অদৃশ্য দড়ি এখনও স্বর্ণা স্বপ্নে দেখতে পায়। এটাও ভাবে, যে সন্তানকে সে পেটে ধরেছে তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব যদিও সৃষ্টিকর্তার উপরে তারপরেও মাতৃত্বের স্বাদ স্বর্ণা পেয়েছে। ভবিষ্যৎ জীবনে চলার ক্ষেত্রে জীবনটা যেন অশান্তিতে, অনিহার কারণ হয়ে না উঠে সে কারণেই গর্ভের সন্তানকে হত্যা করা হয়েছে। দাইমা বলছিল এটা তোমার ছেলে সন্তান। আহা আহারে জীবন এতোই কষ্টের, এতোই বেদনার, সেই বেদনার নীল কষ্টে এখনো স্বর্ণা একা বসে বসে ভাবে। ছেলের নাম প্রেম করা অবস্থায় পছন্দ করে রেখেছিল, এমনকি সেই নামে একটা কারুশিল্প তৈরি করেছিল। যেদিন গর্ভের ছেলে সন্তান কে হত্যা করে সেই দিন স্বর্ণা চিৎকার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সেই কারুকার্য ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। 

 

আজ এত বছর পর অতীতের কথা মনে পড়ায় বার বার দু চোখ অশ্রুসিক্ত হয় আর সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। হে আমার সৃষ্টিকর্তা আমি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পরিবারের আট দশটা মানুষের ভবিষ্যতের কারণে এ ধরনের হত্যা আমি করেছি। বৃহত্তর স্বার্থে আমার এই হত্যাকাণ্ড। স্বর্ণা ভাবে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করলেও আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না কখনও। 

 

স্বর্ণা নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় - দেশ স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে কত সন্তান যে অসময়ে অকালে প্রাণ হারিয়েছে, কত মা তার সন্তানকে দেশের জন্য আত্মবলিদান করেছেন, পাঠিয়ে দিয়েছে যুদ্ধে । স্বর্ণাও না হয় পরিবারের বৃহত্তর স্বার্থে আত্মত্যাগ করল। মুক্তির শপথ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে কত মানুষ অসময়ে প্রাণ হারিয়েছে স্বর্ণাও দেশের মতো পরিবারের মুক্তি চেয়ে এমন কঠিন সিদ্ধান্ত সেই দিন নিতে হয়েছিল। দিন চলে যায় দিনের রং বদলায় কিন্তু মাতৃত্বের রং কখনোই বদলায় না।




 

নন্দিনী লুইজা

শিক্ষক, লেখক, কবি ও প্রকাশক

বর্ণপ্রকাশ লিমিটেড