খবর প্রকাশিত: ২৭ এপ্রিল, ২০২৫, ০২:১৬ পিএম
এম আব্দুর রাজ্জাক বগুড়া থেকে : বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার ছাতিয়ানগ্রাম ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি জনপদ শালগ্রাম। এই গ্রামে গত প্রায় ১৫০-২০০ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় নবান্ন উৎসব পালিত হয়ে আসছে। যা শালগ্রাম নবান্ন উৎসব নামে এলাকায় পরিচিত। বলা হয় সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকে শুরু হয়ে আজ পর্যন্ত এই উৎসব চলমান। প্রতি বছর বাংলা ১ অগ্রহায়ণ এবং ইংরেজি ১৬ নভেম্বর শালগ্রামে নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। সাধারণত তিন দিন ধরে এই উৎসব চলে। নবান্নে সকল আত্মীয়-স্বজন, কাছে দূরের বন্ধু-বান্ধব সকলেই এই দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। উৎসবের সময় কাউকে আলাদা করে দাওয়াত দেবার প্রয়োজন পড়ে না। সবাই নিজের মতো করে এসে উৎসবে অংগ্রহণ করে থাকে। উৎসবের সময় গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নানান ধরণের গ্রামীণ খেলা-ধুলা যেমন- হা-ডু-ডু, মোরগ লড়াই, রশি ধরে টানাটানি, হাঁস ধরা, বালিশ যার বিপদ তার, গোল্লাছুট, বউছি, গ্রাম বাংলার বাউল গান, জারি গান ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করে থাকে।উইকিপিডিয়াতে শালগ্রামের নবান্ন উৎসব সম্পর্ক যা জানা যায় তা হল, নবান্ন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যে সকল আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন তার মধ্যে অন্যতম। ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ “নতুন অন্ন”। নবান্ন উৎসব হল নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব। সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই নবান্ন উৎসব বিলুপ্তপ্রায়। তবে এখনও বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু এলাকায় নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশের বগুড়া জেলার আদমদিঘী উপজেলার শালগ্রামসহ আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে আবহমানকাল ধরে নবান্ন উৎসব অত্যন্ত উৎসব মুখর পরিবেশে উদযাপিত হয়ে থাকে।
২০২৪ সালের নবান্নে শালগ্রামে ২০-২৫টি গরু-মহিষ জবেহ করা হয়। প্রত্যেক পরিবারেই নতুন ধানের ঢেঁকি ছাটা চালের নানা ধরনের পিঠা, পায়েশ, মুড়ি, মুড়কি, মোয়া, গজা, খির, নারিকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু দিয়ে অতিথিদের জল খাবার এবং মহিষের গোশত দিয়ে দুপুরের খাবার কিংবা রাতের খাবার দেয়া হয়। যারা রাতে বাড়ি ফিরতে পারবে না তাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়। অত্র এলাকার সকল মানুষ নবান্ন উৎসব কবে আসবে তার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। গ্রামের বাসিন্দা অথচ যারা চাকরি বা অন্য কোন কাজের জন্য গ্রামের বাইরে থাকে তারা দুই ইদের ছুটিতে না আসলেও নবান্নে তাদের আসতেই হবে যে কোন উপায়ে।
শালগ্রামে প্রায় ৩৫০০ ভোটার এবং সাত আট হাজার মানুষের বসবাস। যারা অধিকাংশই মুসলিম। একটি গ্রাম নিয়েই একটি ওয়ার্ড। গ্রামের অধিকাংশ পরিবারই স্বচ্ছল। অস্বচ্ছল পরিবারের সদস্যদের স্বচ্ছল ব্যক্তিরা সহায়তা করে থাকেন। এই গ্রামের মোটামুটি প্রত্যেক পরিবারের কেউ না কেউ দেশের বাইরে অবস্থান করে এবং অনেকেই দেশের ভিতরের বড় বড় পদে আসীন । নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারা গ্রামের উন্নয়নে নানা অবদান রেখে চলেছেন। গ্রামের ভিতরের রাস্তাগুলি পাকা।
শালগ্রাম আবার তালুকদারপাড়া নামেও বিশেষভাবে পরিচিত। মূলত তালুক থেকে তালুকদার। এই গ্রামের মোটামুটি সকলেই সম্পদশালী। এ কারণে প্রত্যেকেই তালুকদার পাড়ার ভিতরেই বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। যাতে নিজ গ্রামের বাইরে যেন সম্পদ অন্য গ্রামে না চলে যায়। তবে সম্প্রতি কিছু মানুষ এই গ্রাম নিয়ে গবেষণা করেছেন। যেমন আদমদিঘী ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের সহকারি অধ্যাপক শেফাউর রহমান তালুকদার। তিনি এবং তার সমমাসয়িক অনেকেই গ্রামের বাইরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন। কারণ তিনি মনে করেন, রক্তের সম্পর্কর আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার ফলে নানা ধরণের জন্মগত ত্রুটি দেখা যাচ্ছে। তিনি Genetic Defect to Consanguineous Marriage এর উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। তাতে দেখা যায়, এই গ্রামের ৮৭% মানুষ নানা ধরনের জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে। এমন কি তিনি নিজেও।
শেফাউর রহমান তালুকদার নবান্ন উৎসব সম্পর্কে বলেন, আমার জানা মতে-আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে থেকে এই নবান্ন উৎসব পালন হয়ে আসছে এবং তার নিজের বংশে প্রায় ১৫০ বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে। তিনি নিজে ১৯৮৬ সালের পর থেকে ব্যক্তিগতভাবে শুরু করেছেন। যা চলমান আছে। তিনি বলেন আমাদের গ্রামে চাকুরির সুবাদে অনেকে অনেক জায়গায় থাকেন। কিন্তু যদি ইদেও ছুটি না পান তবে নবান্নে অবশ্যই ছুটি নিয়ে আসবেন। এবারও তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের পাড়াতে ৮টি মহিষ এবং ৬ টি গরু জবেহ এবং পুরো গ্রামে ২০-২৫টি গরু-মহিষ জবেহ করা হয়েছে। যা দিয়ে আমরা পাড়া-প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই মিলে নবান্ন উদযাপন করব।
তিনি আরও বলেন, আমরা পিতা-মাতা, দাদা-দাদী থেকে শুরু করে বংশ পরম্পরায় ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছি এবং আশা করি আমাদের পরবর্তী বংশধররাও এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখবে। তিনি আরও মনে করেন, ডিজিটাইজেশনের যুগে কারও সাথে কোন দেখা নেই, শুধু মোবাইলে কথা হয়। নবান্ন উৎসবের মাধ্যমে আত্মীয়তা সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হচ্ছে। পাশাপাশি ধনী, গরিবেব মাঝে একটি সুসম্পর্ক তৈরী হচ্ছে। যার ফলে আমরা একটি ভালোর দিকে যাচ্ছি বলে মনে করি।
আদমদিঘী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছাঃ রুমানা আফরোজ শালগ্রাম নবান্ন উৎসব সম্পর্কে বলেন, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য এখন ধরে রাখার প্রানান্ত প্রচেষ্টা দেখে আমি খুবই আনন্দিত, বিমোহিত ও মুগ্ধ। এ উৎসবের মধ্যে দিয়ে পারষ্পরিক সামাজিক বন্ধনের অনন্য নজির সৃষ্টি হয়েছে। গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য কোন ধরনের সহযোগিতার প্রয়োজন হলে তা তিনি করবেন বলে আশ্বাস প্রদান করেন।