খবর প্রকাশিত: ২৮ এপ্রিল, ২০২৫, ১২:৫২ এএম
এম আব্দুর রাজ্জাক উত্তরবঙ্গ থেকে :
অপরূপ সৌন্দর্যের মায়ায় ঘেরা এই বাংলার রূপ। কখনো সবুজের হাতছানি আবার কখনো অচেনা কোনো পাখির সুর। কখনো শান্ত দীঘির জল, কখনো মাথার ওপর বিশাল আকাশ। এই রূপের মোহে বন্দি হয় যে কেউ। এমনই এক প্রাকৃতিক স্থান নওগাঁর আলতাদীঘি উদ্যান।
শালবনের নিবিড় ভালোবাসা জড়িয়ে আপনি যখন এগিয়ে যাবেন তখন পায়ে বেদনার মর্মর সুর তুলবে শুকনো পাতার দল। নির্জন বনে চেনা অচেনা পাখির সুরে হয়ত উদাসী হয়ে উঠবে আপনার মন। আপনার পায়ে হাঁটা পথের পুরোটা জুড়ে সঙ্গী হয়ে থাকবে শান্ত এক দিঘীর জল, নাম যার আলতাদীঘি। পথ হাঁটতে হাঁটতে একসময় থেমে যেতে হবে কাঁটা তারের বেড়ার প্রান্তে। সূচালো কাঁটার তার জানান দেবে, ওপারে ভিন্ন দেশ। তারপর আবার এই দিঘীর কাছ ঘেঁষে হেঁটে চলা।
নওগাঁ জেলার ধামুইর হাট বাজার থেকে উত্তরে এ দিঘীর অবস্থান। নামকরণ থেকে শুরু করে জন্ম ইতিহাস— সবকিছুতেই জড়িয়ে রয়েছে কল্পকথা। কথিত আছে অক্ষয় কুমার চৌধুরানী (জন্ম- মৃত্যু অজানা) আদেশ করেন, তিনি যতদূর হেঁটে যাবেন ততদূর পর্যন্ত দীঘি খনন করতে হবে। এভাবে তিনি এককিলো হাঁটার পর কর্মচারীরা তার পায়ে আলতা ছুঁয়ে দেন আর বলেন, ‘রানী মা, আপনার পায়ে রক্ত’। এ কথা দাঁড়িয়ে যান রানী। আর একারণেই এই দিঘীর নামকরণ করা হয় ‘আলতাদিঘী’।
উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় বনভূমি শাল বনের মাঝখানে আলতাদিঘীর অবস্থান। ভারতের বর্ডার এর পাশ ঘেঁষে চলে গিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের প্রায় সীমান্ত ঘেষা, নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলা থেকে ৫ কিঃমিঃ উত্তরে আবিলাম মাদ্রাসা রোড ধরে ১০-১২ কিলো দূরে একটি ঐতিহাসিক দিঘীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সুবিশাল বনভূমি।
কথিত আছে, আনুমানিক ১৪০০ সালে এ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন রাজা বিশ্বনাথ জগদল। রাজার রাজত্বকালেই একবার পানির প্রকট অভাব দেখা দেয়। মাঠ ঘাট শুকিয়ে চৌচির হওয়ায় আবাদি জমিতে ফসল ফলানো হয়ে ওঠে অসম্ভব। হঠাৎ একদিন রাণী স্বপ্নে দেখলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না পা ফেটে রক্ত বের হবে ততক্ষণ তিনি হাঁটতে থাকবেন এবং যেখানে গিয়ে পা ফেটে রক্ত বের হবে ততদূর পর্যন্ত একটি দিঘী খনন করে দিতে হবে।
প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা দূর করে রানী স্বপ্ন অনুযায়ী হাঁটার সিদ্ধান্ত নিলেন। সঙ্গে ছিল রানীর পাইক পেয়াদা, লোক লস্কর। অনেক দূর হাঁটার পরও যখন রানী থামছিলেন না, তখন পাইক-পেয়াদারা ভাবলেন এত বড় দিঘী খনন করা রাজার পক্ষে সম্ভব হবে না। এসময় তাদের একজন রানীর পায়ে আলতা ঢেলে দিলেন আর চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘রানী মা, আপনার পা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। একথা শুনে রানী সেখানেই বসে পড়েন।
রাজা বিশ্বনাথ ওই স্থান পর্যন্ত একটি দিঘী খনন করে দিলেন। এরপর অলৌকিকভাবে মুহূর্তেই বিশুদ্ধ পানিতে ভরে ওঠে দিঘী। রাণীর পায়ে আলতা ঢেলে দেয়ার প্রেক্ষিতে দিঘীটির নামকরণ করা হয় আলতাদিঘী।
আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানে রয়েছে মেছোবাঘ, অজগর বানরসহ নানা বন্য প্রানী। বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, পোকামাকড় রয়েছে এখানে। যার মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো শালগাছকে আলিঙ্গন করে গড়ে ওঠা উঁই পোকার ঢিবি।
২৬৪ এককের বিশাল বনভূমির ঠিক মাঝখানেই রয়েছে প্রায় ৪৩ একর আয়তনের আলতাদিঘী। এটি ১ দশমিক ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং শূন্য দশমিক ২ কিলোমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট। যদিও গুরুত্ব অনুযায়ী এই বনভূমি বা দিঘীর যত্ন নেওয়া হয় নামমাত্র।